গোয়ালন্দ ঘাট। ফেরী পার হওয়ার জন্য সিরিয়ালের অপেক্ষায় বাসে বসে আছে সুমনা। প্রায় দু ঘন্টা হতে চল্লো, বিশাল গাড়ি আর বাসের এই লাইন একই জায়গায় ঠায় দাড়িয়ে আছে।কোনো নড়াচড়া নেই।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে অভ্যস্থ ড্রাইভার একটু পর পর হেল্পারকে দিয়ে পান আনিয়ে খাচ্ছে আর স্টিয়ারিং হুইলের উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছে।
এক যাত্রী থাকতে না পেরে বলে উঠলো,
'কি ব্যাপার ড্রাইভার সাহেব আর কতক্ষন বসে থাকা লাগবে'?
নির্বিকার ড্রাইভার চমকে উঠে পুচুৎ করে জানালা দিয়ে পানের পিক ফেলে কোনো দিকে না তাকিয়ে বল্লো,
'এত ব্যাস্ত হইছেন কেন ? যখন সিরিয়াল আইবো তখনি পার হমু। ইচ্ছা কইরা কি বইসা আছি নাকি '!
বাসের জানালা খোলা, নদীর এত কাছে তা ও কোনো বাতাস নেই, গরমে সবাই হাঁস ফাঁস করছে। সুর্যটা ঠিক মাথার উপর।
একটা ছোটো বাচ্চা কেঁদেই যাচ্ছে। বাবা মা কেউ ই শান্ত করতে পারছে না।
বিরক্ত একজন যাত্রী বল্লো, 'ভাই বাচ্চাটাকে নিয়ে একটু বাইরে ঘুরে আসুন না'!
বিব্রত বাবা লজ্জায় লাল হয়ে ছেলে কোলে নেমে পড়লো।
পথের পাশের ছোটো ছোটো হোটেল গুলোয় পুড়ি আর সিংগারা ভেজে স্তুপ করে রেখেছে । কোথাও বা গরম ভাতের ব্যবস্থা ।অনেক যাত্রী নীচে নেমে চা সিগারেট খাচ্ছে।
সুমনার ও ভীষন ইচ্ছে করছিল গরুর ঘন দুধের গরম ধোঁয়া উঠা এক কাপ চা খেতে। কিন্ত একা মানুষ, সাথে একটা ভারী ব্যাগ ওটা নিয়ে নীচে নামা সম্ভব নয়, আবার রেখে যেতেও ঠিক সাহস হয়না।
পাশের মহিলা মাথায় যেন কি এক সুগন্ধী তেল মেখেছে, তার তীব্র উৎকট গন্ধে মাথাটা ধরে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সুমনা সেই গন্ধ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। কি করে যে এমন তেল মাখে মানুষ!
দুরে একটা ছনের ঘর দেখা যাচ্ছে,যার চালের মধ্যে কচি লাউয়ের লতা বেয়ে উঠেছে। দু একটা ছাগল চরে বেড়াচ্ছে বেড়ার ধারে। এসব দেখে বাড়ীর কথা মনে হচ্ছে বারবার করে সুমনার। কোনোদিন একাকী এত দুর কখোনো আসেনি। কিন্ত বাড়িতে বাবা মা ছাড়া তার বড় এক পঙ্গু ভাই আর এক সাত বছরের ছোট্ট ভাই । এই দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন সুমনা, যাকে দারিদ্রের সংসার টেনে অকালে বুড়িয়ে যাওয়া আধা গ্রাম আধা শহরে ছোট্ট এক মুদী দোকানী বাবা সর্বস্ব খরচ করে বি, এ পাশ করিয়েছে ।আজ তাদের একমাত্র আশা ভরসার স্হল সে। সে ঢাকায় যাচ্ছে একটি এন জি ও তে চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে।
মনটা সেদিন থেকে কেমন যেন করছে সুমনার । যেদিন দেখলো আরিফ নতুন বৌ নিয়ে তার পাশ দিয়ে হেসে হেসে গল্প করতে করতে রিকশার হুড উঠিয়ে চলে যাচ্ছে। সুমনাকে দেখেনি। ওদের দেখে চট করে গাছের আড়ালে চলে গিয়েছিল। ওদের হাসিমুখে গল্প করতে দেখে বুকটা টনটন করে উঠেছিল, বুকে হাত দিলে বোধহয় হাতে রক্ত লেগে যেত।
ওকেও দোষ দেয়না সুমনা। সে তো নিজেই ফিরিয়ে দিয়েছে তার তিন বছরের ভালোবাসার মানুষ আরিফকে। তার জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করবে সে।
বাড়ীতে একাকী অসুস্থ মা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে অনবরত স্থানীয় কলেজের শিক্ষক আরিফকে। এক হারা গরনের উজ্বল শ্যামলা মিষ্টি চেহারার সুমনাকে আরিফের মা র ও অপছন্দ ছিল না।
কিন্ত সুমনা কি করে একাকী নিজের সুখের কথা ভাববে !
'আমাকে মাফ করে দাও আরিফ', চোখের পানিকে চোখের মধ্যেই শক্ত করে ধরে রেখে ধরা গলায় শুধু এটুকু বলতে পেরেছিল শেষ দিন আরিফের অনেক অনুনয় বিনয়ের জবাবে।
সুমনার মা অবশ্য আরিফ সুমনার ব্যাপারটা জানতো। সেদিন সন্ধ্যায় বেড়ার গায়ে শুকোতে দেয়া শতবার তালি দেয়া তার রং চটা মলিন শাড়ি আর সুমনার বাবার জীর্ন লুঙ্গিটা এনে ঘরে এসে দেখে মেয়েটা তার ওপাশ ফিরে চৌকিতে শুয়ে আছে। পিছন থেকে শীর্ন পিঠটা দেখা যাচ্ছে।
অবেলায় শুয়ে থাকা সুমনাকে দেখে মায়ের মনটা যেন কেমন করে উঠলো। পাশে বসে জানতে চায় কি হয়েছে তার। কতদিন মেয়েকে আদর করেনি,ভালো করে কথা বলার সময় হয়নি!দুঃখের সংসারে কাজ করতে করতে কখন যে সময় চলে যায়, দেখতে দেখতে কত বড়টি হয়ে গেছে মেয়ে।
মায়ের আদরে আর আকুল প্রশ্নে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি সুমনা। নিঃশব্দে দুই চোখের পানিতে চোখ ভাসিয়ে বলেছিল 'মা আমি আজ আরিফকে ফিরায় দিয়েছি'।
"কেন কিসের জন্য " মায়ের আশ্চর্য প্রশ্ন!
না মা আমার এখন বিয়ে হলে এই সংসারের কি হবে ?
'এইটা কি কোনো কথা হইলো! আল্লাহ ভাগ্যে যা রাখছে তাই হইবো'।
'না মা আমি এ ভাবে তোমাদের ফালায় নিজে একলা সুখী হইতে পারমু না'।
মেয়ে কে জড়িয়ে থাকা সুমনার মা বুঝতে পারে না সেও কি একটু খুশী হয়েছে কি না আরিফকে ফিরিয়ে দেয়ায় ! যদিও স্বার্থপরের মত চিন্তা, কিন্ত দারিদ্রতার সাথে অনবরত সংঘর্ষ করে যাওয়া তার মনটা ও যেন কিছুটা কোমলতা হারিয়ে ফেলেছে মনে হচ্ছে।
ভাঙ্গাচুরা ঘরের চারিদিকে সন্ধ্যার ঘোলাটে আলোয় একবার চোখ বুলিয়ে যেন মেয়েকে জোর করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে সুমনার মা।বাস্তব যে কি কঠিন সেটাও তো সত্যি। অনেকক্ষন বসে থাকে অসহায় মা মেয়ে দুজন সেই অন্ধকারে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।
'আমড়া নিবেন আপা, বরিশালের মিষ্টি আমড়া' ?
কিশোর আমড়া আলার ডাকে বর্তমানে ফিরে আসে সুমনা। কাঠির মাথায় গাথা ফুলের মত আমড়া নিয়ে ছেলেটা অনেক আশা নিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। একটা কিনে নিল যতটা না খাবার জন্য তার চেয়েও বেশি ছিল ছেলেটার প্রত্যাশার চাহনী, ঠিক তার পঙ্গু ভাইটির মত।
আমড়া হাতে বাসে বসে বসে সুমনা ভাবছে পুরো পরিবার তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। কিন্ত আরিফের সাথে এতদিনের ভালোবাসাটুকু ভুলতে ও যে সে পারছে না। বুক ভেঙ্গে এক বিরাট দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো।
এসময় রূপালী রঙের এক পাজেরো জীপ সুমনাদের বাসের পাশ দিয়ে সাঁ করে সব সিরিয়াল টপকে ফেরীর দিকে চলে গেল।
অধৈর্য সেই প্রথম যাত্রী বলে উঠলো, 'কি ব্যাপার ড্রাইভার সাহেব ঐ জীপটা যে কোনো সিরিয়াল মানলো না'!
'মনে হয় কোনো আত্মীয় স্বজনের হইবো' চালকের নির্লিপ্ত উত্তর।
'কার আত্মীয় ?
'ঐ যে ফেরী চালায় যারা, তাগো'।
'আত্মীয় হলেই তারা আগে চলে যাবে' বিস্মিত যাত্রীর উত্তর !
এসময় থাকতে না পেরে আরেক জন বলে উঠলো, 'ভাই আপনি কি নতুন আসছেন নাকি এই দেশে ! জানেন না এখানে আত্মীয় স্বজন, মামা, খালু থাকলে সব কাজেই ফাস্ট '!
অনেক বার শোনা, তারপরও কথাটার পুনারাবৃত্তিতে বুকটা যেন হিম হয়ে উঠলো সুমনার।
কিন্ত সুমনার তো সেরকম বলার মত কোনো মামা খালু নেই !
যারা আছে তারা সামান্য কৃষিজীবি !
তদবীরের জন্য চাই অনেক হোমরা চোমড়া তেল চুকচুকে ক্ষমতাবান কেউ।
সুমনা জানে হাড় জিরজিরে, পুষ্টিহীন, নিরীহ কৃষক শ্রেনী দিয়ে আর যাই হোক তদবীর চলে না।