৬ ই মে ৫০ মিনিট মেঘের ভেলায় ভেসে ভেসে সকাল পৌনে দশটায় ভুটানে ল্যান্ড করলো ড্রুক এয়ারলাইন্সের এয়ারবাস A319 । নেমে আসলাম পারো নগরীতে ভুটানের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্হাপত্যকলায় নির্মিত একমাত্র এয়ারপোর্টে ।
বিনা বাধায় এগিয়ে যাচ্ছি কাস্টমস চেকিং এর দিকে, সাইনবোর্ড দেখে আমার স্বামী বুঝলো ডিক্লারেশন দেয়ার কিছু নেই, ২০০ স্টিক সিগারেট ফ্রি। কিন্ত কাস্টমস চেকিং এ ২ প্যাকেট বেনসন নিয়ে সে ধরা খেল।স্ক্যানিং এর আগে তারা জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই আইনের প্রতি প্রচন্ড শ্রদ্ধাশীল আমার স্বামী জানিয়ে দিল সুটকেসে থাকা ২ প্যাকেট সিগারেটের কথা।
আমরা জানতাম না বর্তমানে ভুটানে সকল প্রকার তামাক সেবন নিষিদ্ধ।
অবশ্য নিতে পারতো, কিন্ত তার জন্য ২০০% ট্যাক্স সহ এখানে সেখানে বিভিন্ন কাগজ পত্রে সই সাবুদ, মহা হান্ঙ্গামা। ফলে প্যাকেট দুটো বিসর্জন দিয়ে আমরা রওনা হোলাম।
তবে হার মানার পাত্র সে নয়। চেহারাটা সিরিয়াস করে আমার উদ্দেশ্যে বল্লো,
'বুঝলে, যা হলো ভালোই হলো, এবার যদি আমার সিগারেটের নেশাটা ছাড়তে পারি সাত দিনে'।
আমি আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলাম না, বুঝলাম নিজের মনকেই স্বান্তনা দিচ্ছে।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে থিম্পুর দিকে যাচ্ছি
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই দেখলাম আমাদের জন্য আগেই ঠিক করে রাখা ট্যুরিস্ট কোম্পানীর গাইড কাম ড্রাইভার কুমার ঝা চকচকে লেটেস্ট মডেলের হিউন্দাই গাড়ি নিয়ে হাজির। উল্লেখ্য কুমার এই গাড়ি নিয়ে সাতদিনই আমাদের সাথে ছিল।
যাক ৪৫ মিনিটের ড্রাইভ রাজধানী থিম্পুর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
রাস্তায় এসেই প্রথমেই ভুটান সম্পর্কে একটা ধাক্কা খেলাম। আমার ধারণা ছিল হয়ত প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরপুর প্রাচীন কোনো দেশ তার মান্ধাত্বা আমলের ঐতিহ্য নিয়ে চুপচাপ পড়ে আছে কোনো এক কোনায়। কিন্ত তা নয়। এত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন সাজানো গোছানো চকচকে রাস্তা ঘাট আমিও কল্পনাও করিনি।
থিম্পুর উদ্দেশ্যে যাত্রা
এখানে বলে রাখা ভালো এয়ারপোর্টে অন এ্যরাইভাল যে ভিসা দেয় তা শুধু ভুটানের তিনটি শহর ফুয়েন্টশোলিং, থিম্পু আর পারো র জন্য।
অন্য জায়গায় যেতে হলে তার জন্য আলাদা করে ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে ভিসা নিতে হয়। তবে এটা ট্যুর কোম্পানি ব্যবস্থা করে। আমরা আরো তিনটি বিভাগে যাবো বলে সে তিন জায়গার ভিসা নিতে হবে। সুন্দর আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে থিম্পু পৌছালাম।
রাজধানী থিম্পু স্বাগত জানাচ্ছে।
যাক, পারো আর থিম্পু নিয়ে অনেকেই লিখেছে ব্লগে তাই আমি এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাইনা। আমি লিখবো এর পর থেকে। অবশ্য পারো র একটা বৌদ্ধ মন্দির নিয়ে একটা পোস্ট দেয়ার ইচ্ছা আছে।
থিম্পু পৌছে দুদিন ঘুরে যা দেখার দেখলাম তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিশাল এক পাহাড়ের চুড়ায় বিশালাকৃতির এক বৌদ্ধ মুর্তি নির্মান। এ নির্মান কাজ চলছে ভুটানের রাজার নির্দেশে, ভুটান আর জাপানের মিলিত অর্থনৈতিক এবং কারিগরী সহায়তায়।
থিম্পুতে পাহাড় চুড়ায় বৌদ্ধমুর্তি
থিম্পু থেকে রওনা দিলাম দোচু লা র উদ্দ্যেশে। ভুটানি ভাষায় লা অর্থ পাস। দুর্গম পাহাড়ের এপাশ থেকে ও পাশে যাওয়ার জন্য পাস বা গিরিপথ যে কোনো ভাবেই হতে পারে, যেমন ভ্যালির মধ্যে দিয়ে, টানেল করে অথবা পাহাড় অতিক্রম করে। থিম্পু থেকে মধ্য ভুটানের দিকে যেতে হলে দশ হাজার দুশো ফুট উচু পাহাড়ের চুড়ার উপর দিয়ে এই দোচু পাস অতিক্রম করে যেতে হয়।
পাহাড়ের চুড়ার উপরএই পাস এর ঠিক উপরে একটি রিসোর্ট আছে।
বা দিকে থিম্পু থেকে রাস্তাটা উঠে এসে দশ হাজার দুশো ফুট উচু পাহাড়ের চুড়ায় দোচু লা রিসোর্টের সামনে বাক নিয়ে ডান দিক দিয়ে নেমে পুনাখার দিকে চলে গেছে।
আমরা সেখানে দুদিন ঠিক না দেড় দিন থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। ট্যুরিস্ট
কোম্পানীর গাড়ি আমাদের পৌছে দিচ্ছে থিম্পু থেকে ৪০ মিনিটের ড্রাইভ। পাহাড়ি আঁকা বাকা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, পথের দুপাশে পাইন, ফার, হেমলক গাছের ঘন অরন্য আর কত পাহাড়ি আর বাহারি ফুলের মেলা।
কিছু দুর পর পর মহিলারা রাস্তার পাশে বিভিন্ন ফল নিয়ে বসে আছে। কুমার জানালো সিজনের সময় এক কেজি আপেল ১০ নিউট্রাম। এখন চাচ্ছে ২০০ নিউট্রাম কেজি, অর্থাৎ চারশ বাংলাদেশি টাকা । ভুটান আর ইন্ডিয়ান টাকার মান সমান। আমরা বাংলাদেশে ৭৫ টাকায় ডলার কিনে ওখানে পেয়েছি মাত্র ৪৩ ভুটানি টাকা।
রাস্তার পাশে পাশে ফলের পসরা।
পাহাড়ের চুড়োয় পৌছাতে না পৌছাতেই প্রচন্ড শীত জেকে ধরলো আমাদের। সেখানে এক চত্বরের মাঝখানে ছোট্ট একটা গোল টিলার উপর একটি স্মৃতি সৌধ। গাইড জানালো আসাম থেকে এসে আশ্রয় নেয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী উলফাদের উৎখাতের জন্য সেখানে ছোটো ছোটো কয়েকটি অভিযান হয়েছিল। সফল এই অভিযানে যে সমস্ত বীর ভুটানি যোদ্ধারা মারা গিয়েছিল তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্য রাজমাতা ২০০৩ সালে ১০৮ টি স্তুপের এই সৌধটি তৈরী করেন।
আমরা সেখানে নামতে না নামতেই মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেলাম। কিন্ত কোনো বৃস্টি নয়।
স্মৃতি সৌধের সামনে মেঘের ভেতর আমার স্বামী আর গাইড
যাক কিছু ছবি টবি তুলে কাঁপতে কাঁপতে রিসোর্টে ঢুকলাম।পথের থেকে অনেকগুলো সিড়ি ভেঙ্গে হোটেলে উঠতে হয়। প্রথমেই আমাদের রুমে নিয়ে গেল দুটো মেয়ে। ভুটানে যত হোটেল দেখলাম তাতে মেয়ে কর্মচারীর সংখ্যাই বেশী। এবং তারা যথেষ্ট পরিশ্রমীও বটে। কি ভারী ভারী লাগেজ অনায়াসে টেনে সিড়ি বেয়ে তুলে নিয়ে গেল আমরা হা করে চেয়ে রইলাম। আমার তো আমাকেই টেনে তুলতে কষ্ট হচ্ছিল।
কাঁচে ঢাকা বারান্দা আলা রুম পর্দা সরালেই ৯০ ডিগ্রি এ্যংগেলে সব দেখা যায়। জানালা দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছি অবাক বিস্ময়ে অপুর্ব সেই মেঘের খেলা।যেখান থেকে পরিস্কার আকাশ থাকলে হিমালয়ান রেন্জ দেখা যায় খালি চোখে।
দোচু লা য় আমাদের রুম
মেয়েগুলো এসে দুটো রুম হিটার আর একটা কাঠের চুলা জেলে দিল। এরপর যেন আমি স্বাভাবিক হতে পারলাম। এর মধ্যে নীচে আমাদের চা খেতে ডাকলো। রাতে আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। কোনো জন মানুষের চিন্হ বা শব্দও নেই চারিদিকে। মাঝে মাঝে শুধু দু একটা বেওয়ারিশ কুকুরের ঘেউ ঘেউ চিৎকার ছাড়া। সেই নিস্তব্ধতায় সারারাত ভালো করে আমার ঘুমই হলো না।
পরদিন সারা বেলা বসে বসে মেঘের খেলা দেখলাম। সেখানে একটি শক্তিশালী বাইকুলার লাগানো অবজারভেটরী ও ছিল। কিন্ত দুঃখের বিষয় প্রচুর মেঘ থাকায় আমরা হিমালয়ান রেন্জের উপর সূর্যোদয়ের খেলাটা পরিস্কার দেখতে পারিনি।
বাইনাকুলারের সামনে আমার স্বামী হিমালয়ান রেন্জ দেখার চেস্টায়
পরদিন সাড়ে নটায় কুমার গাড়ি নিয়ে আসলো। এর পরের গন্তব্য ভুটানের প্রাক্তন রাজধানী পুনাখা ডিসট্রিক্ট, সেখান থেকে আধঘন্টা দুরত্বে আরেকটি বিভাগ ওয়াংডিতে লান্চ করে আমরা যাবো ৬০ কি:মি দুরে সাড়ে তিন ঘন্টা ড্রাইভের আঁকা বাকা পাহাড়ি পথ ধরে পবজিখা বলে ফুলে ফুলে ভরা এক অপুর্ব উপত্যকায়।
পবজিখা যেখানে তিব্বত থেকে উড়ে আসা কালো গলার অত্যন্ত দুর্লভ লাজুক মৌসুমী পাখি ব্ল্যাক নেক ক্রেন ঘুরে বেড়াচ্ছে অবাধে।
এছাড়াও ১৫/১৬ রংগের রডোড্রেনডন তার অবর্ননীয় রূপের শোভা নিয়ে পথের পাশে ফুটে আছে, সেই সাথে আছে অজস্র টিউলিপ।
দুর্লভ ব্ল্যাক নেক ক্রেন।
অপার সৌন্দর্যের সেই লীলাভুমি পবজিখাতে আমাদের জন্য বুকিং দেয়া আছে একটি বিদ্যুত বিহীন প্রাচীন এক ঐতিহ্যবাহী ফুলে ফলে শোভিত ফার্ম হাউস যেখানে আমরা একদিন থাকবো।
পুনাখা দোচু লা থেকে আড়াই ঘন্টা ড্রাইভ। তবে কি:মি তে হিসেব করলে অনেক কম ।পাহাড়ের দুপাশের সে অবর্ননীয় সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যাচ্ছি। বেশ কয়েক জায়গায় নেমে ছবিও তুল্লাম।
পুনাখা জং । জং অর্থাৎ বিভাগের প্রধান সরকারী এবং ধর্মীয় কার্যালয়।
কিন্ত পাহাড়ি সেই জিগ জ্যাগ পথে ক্রমাগত ডান- বা, ডান- বা করতে করতে আমি রীতিমত অসুস্থ পড়তে শুরু করলাম। পুনাখা র যে সমস্ত দ্রস্টব্য তার কিছুই আমার দেখা সম্ভব হলো না। আমি আস্তে আস্তে পেছনের সীটে শুয়ে পড়লাম। আমার ছেলে আর স্বামী এ অবস্থায় গাড়ি থেকে নেমে এক নজর চোখ বুলালো মাত্র।
সেখান থেকে আধাঘন্টা দুরত্বের ওয়াংডির নির্ধারিত হোটেল।কথা ছিল এখানে খাওয়া শেষে আধা ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে পবজিখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়া। খাওয়া তো দুরের কথা আমি আর মাথা তুলতেই পারছিনা।
বল্লাম 'আমি এখানে থাকি তোমরা ঘুরে আসো'।
কিন্ত তাই কি আর হয়!
শেষ পর্য্ন্ত আমার অবস্থা দেখে আমার স্বামী আর গাইড কুমার পরামর্শ করে পবজিখা যাওয়া বাতিল করলো। সেখানে যাওয়ার জন্য আমাদের মাথা পিছু ৮০ ডলার বেশী দিতে হয়েছিল। উল্লেখ্য ট্যুরে পার হেড ৩৫০ ডলার আমাদের থিম্পু পৌছেই পে করতে হয়েছিল। নাহলে ২৭০ ডলার লাগতো ওয়াংডি পর্যন্ত ঘুরে আসতে।
যাই হোক বিকেলের দিকে একটু সুস্থ লাগায় ওয়াংডি শহরটা ঘুরে দেখলাম। আমার ছেলেতো ফোঁস ফোঁস করতেই লাগলো সারাক্ষন,
'আম্মুকে নিয়ে আর কোথাও যাওয়া যাবেনা'।
ওয়াংডি হোটেলে আমাদের রুমের বারান্দা থেকে পাহাড় আর নদী।
সকালে নাস্তা খেতে বসেছি। একটু পরে আমরা পুনাখা যা আমি আগের দিন দেখতে পারিনি তা দেখে থিম্পু রওনা হবো।
নাস্তা খাচ্ছি আর কথা বলছি একটু আধটু। পাশ দিয়ে বালতি হাতে যাচ্ছিল ম্যানেজার না মালিক বুঝলামনা এক ভুটানি মহিলা, যিনি গতকাল ডেস্কে বসে আমাদের রুম বরাদ্দ দিয়েছিল। আমাদের দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখে থমকে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
"ম্যাডাম কা বিমার ঠিক হো গ্যায়া"?
আমার স্বামী দেখলাম চমকে গিয়ে তার ঠিক সামনে বসা আমার মাথার উপর দিয়ে তার চিন্তা ক্লিস্ট চোখদুটো কোন সুদুরের পানে নিবদ্ধ করতে চেস্টা করছে। বুঝলাম তার মন চলে গেছে দেশে আর সেখানে কোন্ ম্যাডামের আবার বিমার হলো তা আবিস্কারের চেষ্টায় তার মন প্রচন্ড ব্যাস্ত !
চার/ পাঁচ দিন হলো দেশের খবর ছাড়া!
আমি এক মুহুর্তের মধ্যে ভদ্রমহিলার কার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন বুঝে উত্তর দিলাম, 'ও ইয়েস, ইয়েস, নাউ আই এ্যাম ফাইন'।
আমার স্বামী দ্বিতীয় বার চমকে আমার দিকে তাকালো আর বুঝতে পারলো,
নাহ্ পৃথিবীতে আরো ম্যাডাম আছে !