নীল নদ
রঙের মধ্যে নীল আমার প্রিয়, এই নীল নামটা সবসময় আমার মনের মধ্যে স্নিগ্ধ, সুন্দর, কোমল এক মায়াবী ভাব এনে দেয়। আর নীল নদের কথা শুনলেই মনে হতো কি সুন্দর জানি সেই নদী। ছোটোবেলা থেকেই কত বই, কত ছবি, কত সিনেমা, এমনকি পুঁথিতেও নীল নদের কত কাহীনি শুনেছিলাম যা কিনা আমার সেই ছোট্ট মনের মধ্যেই একটা সুগভীর দাগ কেটে গিয়েছিল ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আমার বাবা অসম্ভব সুন্দর করে পুঁথি পাঠ করতে পারতেন। আব্বা পুঁথি থেকে বলতেন মিশরের নীল নদের গল্প, সেদেশের রাজা সেই অত্যাচারী ফেরাউনদের গল্প।
সাঁঝের আধারে নীল
নীল নদের নামটি আমি প্রথম যে কাহীনি থেকে শুনেছিলাম তা ছিল মুসা {আ:} এর জীবন কাহীনি থেকে। আব্বার মুখ থেকে শোনা ওনার জীবনের দু:খের কাহীনি আমার শিশু মনে যে কি গভীর আলোড়ন সৃস্টি করেছিল তা আমি এখন আর ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা।
শুধু চোখের পানি মুছতে মুছতে উঠে যেতাম আর আবার এসে বসতাম।মাঝে মাঝে আব্বার পিঠে মুখ লুকিয়ে বলতাম 'আব্বা আর পড়োনা'। কিন্ত আমার ভাই বোনেরা শুনতে চাইতো।আব্বা তখন আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে পড়তে থাকতেন ওদের জন্য।
ফেরাউনদের মুর্তি আবু সিম্বলের মন্দিরে
পুঁথি থেকে জেনেছিলাম অনেক অনেক বছর আগের কথা, সে সময় মুসা নবীর বাবা আমরাম বর্তমান প্যালেস্টাইন থেকে তার পরিবার পরিজন নিয়ে মিশরে এসে বসবাস শুরু করেন । জাতিতে বনী ইসরাইলী বা হিব্রুরা সে সময় মিশরে দাস হিসেবে চিন্হিত ছিল।
নদী থেকে পাওয়া তাই নাম মোজেস
১৩৯২ খৃস্টপুর্বে মিশরেই জন্ম হয় মুসা নবীর। তিন ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো ছিলেন তিনি।ঐ সময়ে ফারাও ১ম টুথমিস ঘোষনা করেছিল যে, হিব্রুদের ছেলে সন্তান হলে তাকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরে ফেলতে হবে। তার ভয় যেহেতু এরা অত্যন্ত সুঠাম দেহের অধিকারী এবং বলশালী, সুতরাং যে কোনো সময় তারা সংখ্যাগরিস্ঠ হয়ে মিশরের ক্ষমতা দখল করতে পারে। আর সে আশংকায় যুবক ও বয়স্কদেরও অত্যন্ত কঠোর শারিরীক পরিশ্রমের কাজে নিয়োজিত রেখেছিল।
নীল নদের পাড়ে নল খাগড়ার বন
ফারাওর ঘোষনা শুনে মুসা নবীকে তার মা নীল নদের পাড়ে একটি ঝুড়িতে করে নল খাগড়ার বনে লুকিয়ে রাখতেন। কিন্ত তিন মাস বয়সের সময় আর না পেরে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে তিনি তার নয়নের মনি, কলিজার টুকরা মুসাকে আলকাতরা মাখানো এক বেতের ঝুড়িতে ভরে নীল নদে ভাসিয়ে দিলেন।
মুসা নবীকে অনুসরণ করছেন মরিয়ম
এটা দেখে মুসা নবীর সাত বছরের বড় বোন মরিয়াম নীল নদের তীর ঘেষে হেটে হেটে তার প্রান প্রিয় শিশু ভাইটিকে বহন করা ঝুড়িটি অনুসরণ করতে লাগলেন।সে সময় ফারাওর মেয়ে হাটসেপসুট নীল নদের তীরে স্নান করতে এসেছিল।তিনি ঝুড়িটি দেখে কৌতুহলী হয়ে তার সখীদের নির্দেশ দেন ওটাকে তীরে আনার জন্য, ঝুড়িটা খুলে দেখেন দেবশিশুর মত ফুটফুটে এক বাচ্চা তার ভেতরে শুয়ে আছে। তারা দেখেই বুঝতে পেরেছিল এ কোনো হিব্রু পরিবারের ছেলে।
ফারাওর বোন হাটসেপসুট মুসা নবীকে নদী থেকে তুলে আনেন
শিশুটি দেখে তার ভীষন মায়া হয় এবং তিনি তাকে পোষ্য নেয়ার চিন্তা করেন, কিন্ত এই দুগ্ধপোষ্য শিশুর জন্য দরকার একজন ধাত্রী মায়ের। তাদের আলোচনা শুনে মরিয়ম, এগিয়ে আসেন ধাত্রী মা জোগাড়ের প্রস্তাব নিয়ে। ফারাওর বোন রাজী হলে মরিয়ম পরিচয় গোপন করে তার মাকে ই ধাত্রী হিসেবে নিয়ে আসেন। বাচ্চা পালার বদলে সে কিছু আর্থিক সাহায্য লাভ করবে বলে বলা হলো । ফলে মায়ের কোলেই বড় হতে থাকেন শিশু মুসা ।
ফারাওর বোনই তার নাম রাখেন মুসা, যার অর্থ নদী থেকে উদ্ধারকৃত।
মুসা যার নামের অর্থ নদী থেকে উদ্ধারকৃত
মুসা নবীর জীবন কালে মোট তিনজন ফারাও মিশর শাসন করেছিলেন, তারা হলেন ফারাও কন্যা হাটসেপসুট, ২য় টুথমিস ও ৩য় টুথমিস। হাটসেপসুট যে কিনা মুসা নবীকে উদ্ধার করে প্রতিপালন করেছিলেন তিনিই ছিলেন মিশরের সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। কিন্ত কোনো মহিলা মিশরের শাসক হতে পারবেনা আইন থাকায় তিনি তার সৎ ভাই ২য় টুথমিসকে বিয়ে করে যৌথ ভাবে দেশ শাসন করতে থাকেন।
রানী হাটসেপসুট
২য় টুথমিস মারা গেলে হাটসেপসুট তার স্বামীর অন্য রানীর গর্ভজাত পুত্র ৩য় টুথমিসের সাথে একত্রে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। এই ৩য় টুথমিসের সাথেই একজন মিশরীয় রাজপুত্র হিসেবে লালিত পালিত হতে থাকেন মুসা নবী। তিনি হেইরোগ্লিফিক ,কিউনিফরম প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষা লিখতে ও পড়তে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। কিন্ত যতই সে রাজপ্রাসাদে রাজপুত্রের মত আরাম আয়েশে আর শিক্ষা দীক্ষায় বড় হচ্ছিল তথাপি সে তার জাতিগত পরিচয় এক মুহুর্তের জন্যও বিস্মৃত হননি।
মাইকেল এন্জেলোর তৈরী মুসা নবীর ভাস্কর্য
মুসা(আঃ) অনেক সময় অসহায় ভাবে দেখতেন বিনা কারণে তাদের সম্প্রদায়ের লোকদের উপর মিশরীয়দের অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতন। একদিন যার প্রতিবাদ করেছিলেন এক মিশরীয়কে হত্যার মাধ্যমে। উনি জানতেন এর পরিনতি ভয়াবহ। যার ফলশ্রুতিতে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন সিনাই উপত্যকায় মিদান নামে এক মরুদ্যানে।
সেখানে এক রাখাল বালিকার সাথে তার পরিচয় হয় তিনি ছিলেন সোয়েব (আঃ)এর মেয়ে, পরে তাকে তিনি বিয়ে করেন। সেখানেই থেকেই তিনি তার শ্বশুরের মেষের পাল চড়াতেন।
একদিন উনি যখন মেষ চড়াচ্ছিলেন সে সময় তার কাছে আল্লাহর এক নির্দেশ আসে । সেটা হলো তিনি যেন মিশরে গিয়ে তার গোত্রের লোকদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন।
মেষ চড়ানোর সময় ওহী নাজিল
আল্লাহর আদেশে মুসা (আঃ) মিশরে গিয়ে ফারাওর কাছে তার জাতি ভাই বনী ইসরাইলীদের মুক্তির জন্য আবেদন জানালে ফারাও ৩য় টুথমিস তা অগ্রাহ্য করেন।কারন তিনি তখন তাদের দিয়ে তার রাজ্যে বিশাল বিশাল সব সৌধ নির্মান করাচ্ছিলেন। মুসা নবীর কোনো অনুরোধেই যখন ফারাও কর্নপাত করছিলনা তখন আল্লাহর নির্দেশে মিশরে একটার পর একটা (মোট দশটা) ভয়াবহ দুর্যোগ ঘটতে লাগলো, যেগুলো সম্পর্কে মুসা নবী আগেই ফারাওকে সতর্ক করে দিচ্ছিলেন।
শেষ ঘটনাটি ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর, দশমবার মুসা নবী বলেছিলেন এবার মিশরে এমন এক রোগ দেখা দেবে যাতে প্রত্যেক মিশরীয়র বড় ছেলেটি মারা যাবে । তার ভবিষ্যৎ বানী ফলে গেল,এ থেকে ফারাওর বড় ছেলেও রক্ষা পেলনা। এই পর্যায়ে ভগ্ন হৃদয়ে ফারাও তাদের মুক্তি দিতে এবং মিশর ত্যাগ করতে দিতে রাজী হলেন
হাথরের মন্দিরে ৩য় টুথমিস
বনী ইসরাইলীরা জানতো ফারাও যে কোনো সময় মত বদলাতে পারে।এ জন্য তারা যখন খুব দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখনই ফারাও তার মত বদলে সৈন্যদের আদেশ দিলেন তাদের ধরে আনার জন্য। ফারাওর সৈন্যরা তাদের ধাওয়া করে লোহিত সাগরের পাড়ে নিয়ে আসলো। এক ভয়ংকর ফাদে পরে বনী ইসরাইলীরা তখন দিশেহারা। তাদের এক দিকে উন্মত্ত ঢেউ এর মুকুট পড়া সুনীল লোহিত সাগর, আর আরেক দিকে ফারাও ও তার সৈন্য।
ঠিক এমন সময় এক অলৌকিক ঘটনা ঘটলো। আল্লাহর নির্দেশে মুসা নবী তার হাতের বিশাল লাঠিটা সমুদ্রের দিকে উচিয়ে ধরার সাথে সাথে লোহিত সাগরের পানি দুই ভাগ হয়ে গেল।
লোহিত সাগর পার হয়ে আসলেন মুসা নবী
মুসা নবী তার অনুসারীদের নিয়ে সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে যে অলৌকিক পথের সৃস্টি হলো, সে পথ পাড়ি দিয়ে সিনাই উপত্যকায় চলে আসলেন। ফারাওর সৈন্যরা সে পথে তাদের অনুসরণ করতে গেলে মুসা নবীর নির্দেশে আবার দু ভাগ হওয়া সমুদ্রের পানি মিশে এক হয়ে গেল।
আর সেই লোহিত সাগরের বুকে সলিল সমাধি ঘটলো ফারাও তৃতীয় টুথমিস ও তার সৈন্যদের । তবে সেই লোহিত সাগরও এই অহংকারী নিষ্ঠুর ফারাওকে তার বুকে স্থান দেয়নি । ফিরিয়ে দিল তাঁর নিজ সাম্রাজ্য মিশরের দিকে থাকা সমুদ্র সৈকতে । অবশেষে তাঁর মমিকৃত দেহবশাষের ঠাই হলো লুক্সরের রাজাদের উপত্যকার ( কিংস ভ্যালী ) ৩৪ নং সমাধি কক্ষে। এ মমিটি বর্তমানে মিশরের যাদুঘরে রয়েছে যা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল ।
পরিচালক Cecil B. DeMille অপুর্ব সুন্দর করে এই ঘটনাটি দেখিয়েছেন তার বিখ্যাত ম্যুভি টেন কমান্ডমেন্টস এ।
এর পরের ঘটনা সে অন্য কাহীনি। রসুল (সাঃ) ছাড়া কোরান শরীফে নবীদের মধ্যে একমাত্র মুসা নবীর নাম সবচেয়ে বেশী অর্থাৎ আনুমানিক ১৩৬ বার উল্লেখ করা হয়েছে।
নীল নদ।
কিন্ত আমাদের ছোটোবেলায় আমার বাবা পুঁথি থেকে করুন সুরে এসব করুন কাহীনি যখন পড়ে শোনাতেন তখন আমার দু চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তো।
সেই ছিচ কাঁদুনে উপাধিটা আমার আজো আছে!
আর সেই সব করুন কাহীনির সাথে বারবার আসতো নীল নদের কথা। কারন এগুলো ঘটেছিল হাজার হাজার বছর আগে এই নীল নদেরই পাড়ে।
এই করুন উপখ্যানগুলো বুকে নিয়ে আজও ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে নীল।
শেষ।
ধীরে বহে নীল
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০২০ সকাল ১০:০১