ধীরে বহে নীল
আসলেই কি ধীরে বহে নীল ! আমাদের দেশের মেঘনা যমুনা দেখার পর নীল নদ দেখে আমি আশ্চর্যই হয়ে গেলাম। কোনো ঢেউ নেই, ঘোলা জলের প্রবল স্রোতের কোনো ঘুর্নিপাক নেই, পাড় ভাঙার কোনো তান্ডব নেই, একেবারেই নিস্তরঙ্গ, পরিস্কার, নীল রংএর বয়ে যাওয়া এক উচ্ছল তটিনী।
সত্যি বলতে কি এমন শান্ত শিস্ট নদীই আমার খুব ভালোলাগে, দেখলে মনে হয় ডুবে যাবার কোনো ভয় নেই। আর সাতার যে আমি জানিনা। তবে ভালো করে তাকালে বোঝা যায় যে সে কতটুকু খরস্রোতা, কারন প্রতি সেকেন্ডে নীল তার বুকের মাঝখান দিয়ে ৩.১ মিলিয়ন লিটার পানি অপসারন করে যাচ্ছে।
প্রাচীন মিশরীয় সুর্য দেবতা এ্যাটন নামের জাহাজের ছবি।
সেরাটন হোটেলের এই পাঁচ তারকা জাহাজ এ্যাটন নীল নদের পারে লুক্সর সেরাটনের জেটীতে বাঁধা, আমরা যখন কিংস ভ্যালিতে ফারাওদের সমাধি দেখে ফিরে এলাম, দেখি জাহাজের ক্রুরা আমাদের দুজনের জন্য অপেক্ষা করছে জেটির সাথে লাগানো সিড়িতে।
তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ডাইনিং এ খেতে বসেছি, বাকী সবাই খাচ্ছে। ব্যুফে সিস্টেম, হঠাৎ আমার স্বামী জানালা দিয়ে তাকিয়ে বল্লো, 'দেখো জাহাজটা চলছে'।
আমি অবাক হয়ে গেলাম! এর মধ্যে বেশকিছু দুর চলে এসেছি কিন্ত একটু টের পাইনি এও কি সম্ভব! প্রথমে একটানা ভোঁ ভোঁ করে সাইরেন বাজবে, কালো ধোঁয়া বের হবে , এর ওর সাথে ধাক্কা ধাক্কি করবে, তারপর ঢেউ এর সাথে বারি খেতে খেতে প্রচন্ড শব্দ করে চলবে, এটাই তো নিয়ম! কিন্ত না, একটুও আওয়াজ না,একটুও দুলুনি না, মনে হচ্ছে যেন ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছি কোথায়!
জাহাজে আমাদের কেবিন
আমরা যাবো লুক্সর থেকে আসোয়ান। চারদিনের ভ্রমন সুচী। পথ কিন্ত অল্প। তবে আস্তে আস্তে দেখতে দেখতে যাবো।
রুমে ফিরে এসে জানালার কাচে চোখ রেখে তাকিয়ে আছি ...এই সেই নীল নদ। বুরুন্ডির উচুভুমিতে লেক ট্যাংগানিকার উত্তরে কাগেরা নদীতে উৎপন্ন হয়ে লেক ভিক্টোরিয়ায় পড়েছে। নীল নদের পানির তিনটি উৎসের সবচেয়ে বড়টিই হচ্ছে এই ভিক্টোরিয়া লেক।
উপর থেকে তোলা লেক ভিক্টোরিয়া
নীলের বিশাল অববাহিকায় মিশর ছাড়াও রয়েছে তানজানিয়া, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা,কেনিয়া এবং কঙ্গো। গ্রীক দেবতা নেইলস এর নাম থেকে নীল নামটির উৎপত্তি। প্রাচীন মিশরীয়দের মতে নীলের দেবতার নাম হাপি
প্রাচীন মিশরীয়রা একে অর বা আর বলে সম্ভোধন করতো, যার অর্থ কালো, কারন প্রতি বৎসর বন্যার পর সেখানে কালো পলিমাটির একটি আস্তরন পরতো যার কারনে এই নাম।
পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এই নদ দীর্ঘ ৬৬৯৫ কিমি পথ দুরন্ত বেগে পাড়ি দিয়ে গিয়ে বিশাল এক বদ্বীপের সৃস্টি করে শেষে ভুমধ্যসাগরের বুকে আছড়ে পড়েছে ।
বিশাল এক ব দ্বীপের সৃস্টি করে ভুমধ্যসাগরের বুকে নীল
মনে মনে ভাবছি যদি এই নদী না থাকতো তবে মিশর হতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় মরুভুমি সাহারার ই একটি অংশ। এর প্রমান হিসেবে বলা যায় যে, নীলের দুই তীরের কয়েক কিমি পর থেকেই শুরু হয়েছে গাছপালা হীন আদিগন্ত বিস্তৃত উষর বালুকাময় ভয়ংকর মরুভুমির। তাইতো নীল নদকে বলা হয় মিশরের প্রান।এখানে যত গাছপালা, ফসলের ক্ষেত ও ফলের বাগান আর মানুষের বসতি সবই নীলের তীর ঘেষে। ফলে এই সীমিত জায়গাগুলোতেই জমি দখলের জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন মানব গোস্ঠির মধ্যে শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগীতা।
আসোয়ানের কাছে নীল নদ
আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে এই নীল নদেরই দুই তীরে ঘটেছিল পৃথিবীর সর্ব প্রথম সভ্যতার উন্মেষ। সেই হাজার বছর আগে থেকে মিশরে বর্তমানে এখনো যা কিছু ঘটে চলেছে, তা এই নীল নদের তীর ঘেষেই ।
এই নীল নদ দেখেছে তার তীরে মিশরের ইতিহাসে সর্ব প্রথম উল্লেখযোগ্য ফারাও চতুর্থ রাজবংশের স্নেফ্রু , খুফুদের। আর তাদের তৈরি পিরামিড, যা আজও প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম আশ্চর্য হয়ে বিষ্ময় সৃস্টি করে চলেছে।
গিজার পিরামিড
পরবর্তীতে কায়রো থেকে ৫০০ কিমি দুরে নীল নদের তীরে গড়ে উঠেছে রাজধানী থীবস যা এখন লুক্সর নামে খ্যাত। সেখানে রাজা আমেন হোটেপ, তুতেন খামেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় টুথমিস, পুরুষের সাজে সজ্জিত রানী হাটসেপসুট আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় র্যামেসিস ছাড়াও আরও কত দোর্দন্ড প্রতাপশালী এক একজন শাসক শাসন করে গেছে মিশর, যাদের কীর্তি আর গৌরবে সমুজ্জল তাদের রাজত্ব কাল।
পুরুষের পোশাকে সজ্জিত রানী হাটসেপসুটস
ভাবছি কত কারু শিল্প ও সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছিল এখানে,কত শত আবিস্কার। নীল নদের পাড়ে জন্ম নেয়া একরকম নল খাগড়া থেকে তৈরী কাগজই তো বিশ্বখ্যাত প্যাপিরাস, তাতে লেখা কত ইতিহাস, কত ছবি । তীর ঘেষে কত নতুন নতুন ইমারত ও সৌধের নির্মান যা কালের নির্মম কষাঘাতে আজ ধ্বংসাবশেষে পরিনত।
ক্ষমতার জন্য কত যুদ্ধ, কত হিংসা -বিদ্বেষ, কত অত্যাচার কত শত হাজার লোকের সুখ-দু:খ হাসি -কান্না কত ইতিহাসের সাক্ষী এই নীল।
প্যাপিরাসে আঁকা নীল নদ দিয়ে ভেসে যাওয়া নৌকায় ফারোকে নিয়ে দেবতা হাথর
যুগ যুগ ধরে ঐতিহাসিকরা হয়তো রাজা রানীদের কথাই লিখে গেছেন। কিন্ত সাধারণ মানুষের কথা কি লিখেছে তারা বা আদৌ কি জানে তাদের ইতিহাস !
কিন্ত তা হয়তো জানে নীল নদ, কিন্ত তার যে ভাষা সেটা বোঝার সাধ্য তো মানুষের নেই । তাই সে যদি বা কিছু বলেও কোনো কোনো সময় তা আমাদের না বোঝাই থেকে যায়।
আমাদের জাহাজের মতন আরো জাহাজ নীলের বুকে
স্বপ্নের দেশ মিশর কত কল্পনা করেছি তাকে নিয়ে । এখানে যে কখনো এত তাড়াতাড়ি আসবো সত্যি ভাবিনি। অসম্ভব ভালোলাগার নাম নীল নদ। জানালা দিয়ে তাকে চেয়ে দেখছি, এক শান্ত, সুনীল, স্বচ্ছ এক স্রোতস্বিনীকে যার মধ্যে নেই কোনো ঢেউয়ের তোলপাড়, ঘোলা জলের তীব্র স্রোত,শুধু কুল কুলু রবে একই ভাবে বয়ে যাচ্ছে সেই আদি অনন্ত যুগ ধরে। নদীর দু তীরে নল খাগড়া আর বিচ্ছিন্ন কিছু খেজুর গাছ, যার ফাকে ফাকে দু একটা ঘোড়া আর গাধা আপন মনে ঘাস খেয়ে চলছে। তারাও কোনো শব্দ করছেনা। তার অদুরেই দেখা যাচ্ছে সবুজের চিন্হ বিহীন লাল লাল পাহাড়ের সারি।
বিকেলে আমরা যাবো লুক্সরের বিখ্যাত উন্মুক্ত যাদুঘর বলে ঘোষিত রাজা আমনহোটেপ নির্মিত কার্নাকের মন্দির দেখতে।
গাছের অনতিদুরে লাল পাহাড়ের সারি
http://www.somewhereinblog.net/blog/June/29272013
চলবে..
ছবি ঃ আমাদের ক্যমেরায়
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:০২