থাইল্যান্ড যাবার আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম আর কোথাও যাই না যাই ব্রীজ অন দ্যা রিভার কাওয়াই দেখতে যাবই।এতবার সিনেমায় দেখা।
সুবর্নভূমি এয়ারপোর্ট থেকে সুকুমভিৎ সয়া (রোড) ৩ এ উঠলাম এক এ্যপার্টমেন্টে।ওটা ছিলো আমার হাসব্যান্ডের কলিগ ফিজির লুই মাভানার আস্তানা।খুব হাসি খুশী টাইপ আর বিশাল দেহের অধিকারী লুই ফিজির আদিবাসী গোত্রের।সে আগেই বলে রেখেছিল তার ওখানে উঠার জন্য। তার ফ্যামিলি এ্যামেরিকায়। ৪ বেড রুমের বিশাল বাসায় সে একা থাকে।
গিয়ে দেখলাম আমাদের জন্য তার বিশাল আয়োজন সাত তালার সুইমিং পুলের পাশে।১১ তালায় লুইয়ের ফ্ল্যাটে ব্যাগ সুটকেস রেখে ৭ তালায় আসলাম।উনি নিজে আমাদের জন্য বিফস্টেক তৈরী করছে সাথে পাস্তা আর আলুর ভর্তা,রুটি, ফলের জুসএবং নানা রকম কোমল ও হার্ড ড্রিংকস।আমার ছেলেকে সে খুব ভালোবাসে।ওর পছন্দের আইস টি এনে রাখতেও ভুল করেনি।লুই সহ আমরা চার জন।কিন্ত এত খাবার যে পুলে আরো ৪/৫ জন ছিল তাদের কেও শেয়ার করার জন্য ডাকা হলো। লুইয়ের সাথে আমার হাসবেন্ডের খুবই ভালো সম্পর্ক।তারা এক সাথে অনেক দেশে তাদের জাতিসংঘের স্টাফদের ট্রেনিং দিয়েছে।
যাক এসব গল্প । রাতে বের হোলাম একটু ঘুরে দেখতে ।পাশেই বিখ্যাত বামরুনগ্রাদ হসপিটাল। আশেপাশে প্রচুর বাংগালী হোটেল।সেখানে বসেই জাকির বলে একজন ট্যুরিস্ট এজেন্টকে ডেকে আনা হলো।বিভিন্ন ট্যুর কোম্পনীর সাথে কাজ করে।পাচ দিনে পাঁচটা ট্যুর প্রোগ্রাম ঠিক হলো।শেষ তিনটা ট্যুরে আমি আর আমার ছেলে যাবো,কারন তার ওয়ার্কশপ। ভোরে বাস আসবে আমাদের পিক করতে।ব্যাংকক দিন রাত সারাক্ষনই জেগে থাকে।রাত এগারোটার মধ্যে লুইয়ের মাহাজাক এ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসলাম। পরদিন ফিরে এসে সুইস পার্ক হোটেলে উঠবো। লুই অবশ্য তার বাসায় থাকার জন্য বলছে কিন্ত আমরা রাজী হইনি।
ভোর বেলা তৈরী হতে না হতেই ইন্টারকমে ডাক, আপনাদের জন্য গাইড মিজ সুসি অপেক্ষা করছে।এক হাতে মাখন লাগানো পাউরুটির পীস আরেক হাতে ব্যাগ তাড়াতাড়ি নেমে আসলাম। গাড়ীতে আরও ছয়জন ট্যুরিস্ট বসে আছে বিভিন্ন দেশের ।রুটি চিবাতে চিবাতে তাদের হাই হ্যালো গুড মর্নিং এর জবাব দিতে দিতে মাইক্রোবাসে উঠে বসলাম। গাইড নিজের পরিচয় দিয়ে আমাদের সাথেও পরিচিত হলো।
রওনা হোলাম কান্ঞনাবুরির উদ্দ্যেশ্যে,যেখানে আমার স্বপ্নের ব্রীজ অন দ্যা রিভার কাওয়াই। থাই ভাষায় বুরি অর্থ প্রদেশ। ব্যাংকক থেকে এর দূরত্ব ১২৮ কিলোমিটার।
কিন্ত একি!
প্রথমেই গাইড আমাদের নিয়ে গেল নারিকেল গাছের ফুল থেকে খেজুরের মত রস বের করে চিনি বানানোর কারখানায়! রস গুলো জ্বাল দিয়ে মিছরীর মত তৈরী করছে। সবাইকে আবার টেস্ট করালো, উদ্দেশ্য বিক্রী। কিন্ত ট্যুরিস্ট রাও চালাক।তারাও কিছুই কিনলোনা।সুসির কোনো খবর নেই।কারখানার অবস্হা দেখে মনে হোলো কুটির শিল্প জাতীয় কিছু। আমাদের শাইখ সিরাজ হলে হয়ত তার খুব ভালো লাগতো। গরমের মধ্যে খোলা আকাশের নীচে চিনি বানানো তাও যদি পরিচ্ছন্ন পরিবেশ হতো !! আমিতো ভীষন ধৈর্যশীল! আমার স্বামী এক নজর আমার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরে হাসি দিয়ে বল্লো'দেখো বুদ্ধিটা কিন্ত খারাপ না, আমাদের দেশেও কত নারিকেল গাছ আছে'।
আমি অন্য দিকে চেয়ে রইলাম।
ব্লগের ভাষায় আমার মিজাজটা চ্রম খ্রাপ হওয়ার আগেই বাসে উঠার জন্য ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজীতে ডাক আসলো মিজ সুসির।
এবার আমাদের আসল গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু হলো। মিজ সুসির মুখে কথা খুব কম! কারন বুঝলাম ভাষা সমস্যা।আমি বুঝিনা যেই দেশ ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থেকেই ইংরেজ ভাষী লোকজনের কাছে উন্মুক্ত, তাদের ইংরেজী ভাষার উপর দখল বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়।
নো হ্যাভ ছাড়া ইয়েস নো পর্যন্ত নলেজও খুব কম।
সাধারনতঃ গাইডরা প্রচুর কথা বলে সবার সাথে সবাই যেন ফ্রি হতে পারে সেই সাথে আশে পাশের ভৌগলিক বিবরণ বা যা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে তার একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাসও তুলে ধরে ।এক্ষেত্রে উনি প্রচন্ড এক বাক সংযমী গাম্ভীর্যপুর্ন গাইডের ভুমিকায় অবতীর্ন হয়ে বসে রইলেন।
যাক আমরা যাচ্ছি অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি থাইল্যান্ডের কান্ঞনাবুরির দিকে। এটা বার্মা থাইল্যান্ড সীমান্ত এলাকা যেটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় একটি ভয়াবহ রনাঙ্গনের পশ্চাদভূমিতে পরিনত হয়েছিল।ছোট ছোট সবুজ পাহাড়, প্রচুর গাছ পালা আর ছবির মত গ্রাম পারি দিয়ে আসতে আসতে দুপুর বারোটার মত বাজলো।
আমরা এসে থামলাম কাওয়াই নদীর থেকে একটু দুরে, পাহাড়ের ফাকে ফাকে বয়ে যাওয়া এক অপরূপ লেকের ধারে।অনেকটা আমাদের ফয়স লেকের মত।তবে কোনো রাইড বা পার্ক জাতীয় কিছু নেই ভীষন নিরিবিলি ।এখানে লান্চের জন্য যাত্রা বিরতি।
যথারীতি বার্জের উপর উন্মুক্ত রেস্টুরেন্ট। নানারকম থাই খাবার ।ভয় লাগছে কি আছে এর মধ্যে কে জানে।হাসি খুশী ওয়েটার টাকে বল্লাম নো পর্ক, সে আমার দিকে হা করে হাসি মুখে চেয়ে রইল।বুঝলাম সে কিছুই বুঝতে পারছেনা। উঠে গিয়ে মিজ সুসিকে খুজে বের করে বল্লাম ওয়েটারকে বোঝানোর জন্য। অন্যান্য দেশে গাইডরা আগেই জানতে চায় খাবার ব্যাপারে কারো কোনো চয়েজ আছে কিনা? এখানে তা নেই। যত কম কথা।
পাশের টেবিলে দেখলাম ডিমের বিশাল এক ওমলেট সার্ভ করছে।
ডিম দেখলেই আমার স্বামী পাগল হয়ে যায়! সে তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ওয়েটারকে ডেকে দেখালো আমাদেরও এরকম একটা দেয়া হোক। ভাত খাচ্ছি ডিম ভাজা দিয়ে । সব খাবারের মধ্যে থাই সসের কেমন একটা গন্ধ ভালো লাগেনা।
মাথার উপর ত্রিপল টাঙ্গানো চারিদিক খোলা বার্জ রেস্টুরেন্ট ঝিরিঝিরি বাতাসে পানিতে দুলছে হালকা ভাবে ।সামনে ছোট ছোট সবুজ পাহাড় টলটলে পানির লেক।খেতে খেতে দেখলাম ছোট একটা বার্জে বিভিন্ন বয়সী কয়েকজন নারী পুরুষ বেশ দামীএবং আধুনিক পোশাক পরা হাতে ও ঝুরিতে বেশ কিছু ফুল নিয়ে প্রার্থনা করে পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে গেল। বোধহয় কোনো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান হবে,সুসির কোনো পাত্তা নেই নিজেরাই আন্দাজ করলাম।
খাবার পর্ব শেষ এবার অল্প দূরেই মূল গন্তব্যস্হল।
ব্রীজ অন দ্যা রিভার কাওয়াই
১৯৪৩ সনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বার্মায় মিত্র বাহীনির সাথে যুদ্ধরত জাপানী সৈন্যদের রসদ সরবরাহের জন্য কাওয়াই নদীর উপর এই সেতুটি নির্মিত হয়েছিল।থাইল্যান্ড থেকে বার্মা ৪১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ কে বলা হতো ডেথ রেলওয়ে।কারন এটা তৈরী করতে যেয়ে হাজার হাজার মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল। থাই অংশে থাই এবং মালয়ী রা আর বার্মার বর্ডারের এই দিকটায় ছিল যুদ্ধবন্দীরা।এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল বৃটিশ,ডাচ আর অস্ট্রেলিয়ান সৈন্য।১৯৪৩ সনে এরা প্রথমে একটি কাঠের সেতু এবং কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে একটি স্টীলের সেতু নির্মান করে যা এখনও টিকে আছ।এই দুটো ব্রীজই জাপানী সেনাবাহীনি মিত্র বাহীনির যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রমের মাধ্যামে তৈরী করিয়ে নিয়েছিল। সম্পূর্ন হাতে তৈরী ব্রীজ দুটো নির্মানে সহায়তা নেয়া হয়ে ছিল শুধু হাতীর।তিনটি স্প্যানের তৈরী ব্রীজটির বাকানো স্প্যানগুলো আনা হয়েছিল জাভা থেকে।পরবর্তীতে ১৯৪৫ সনে মিত্রবাহনীর বোমাবর্ষনে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সোজা স্প্যানগুলো জাপান থেকেএনে বদলানো হয়।
এর উপর দিয়ে প্রতিদিন তিনটি ট্রেন পরবর্তী এবং শেষ স্টেশন নামটক যাওয়া আসা করে ১০ কিলোমিটার গতিতে। মোট ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ।এখানে একটা মজার ব্যাপার হলো এই নদীটার নাম ম খ্লং।তবে সিনেমা তৈরী হয়েছিল যেই বইটি অবলম্বনে তার লেখক একে কাওয়াই নদী বলে উল্লেখ করে যা কিনা আর একটু দুরে প্রবাহিত। সিনেমা দেখার পর হাজার হাজার পর্যটক এই নদীকে কাওয়াই বলে উল্লেখ করায় কতৃপক্ষ ম খলং পরিবর্তন করে এই নামটি রেখে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কান্ঞনাবুরির দিকের স্টেশন যার নাম কাওয়াই স্টেশন তার চারিদিকে মিউজিয়াম, ক্যাফে আর স্যুভেনির শপ।
রেল লাইনের দুপাশে কি সেই অপূর্ব নৈসর্গিক নয়নাভিরাম দৃশ্য যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা।
প্রথমে আমরা ব্রীজটা হেটে এপার ওপার হোলাম। এরপর ট্রেনে চড়ে ৫ কিলোমিটার দুরে নামটক।পাহাড়ের ভেতরে গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে যাচ্ছে কখনও পাশে নদী কখনও সবুজ ঘন গাছ ঘেরা পাহাড়, মনে হচ্ছিল স্বপ্নরাজ্য।ভুলে যাচ্ছিলাম কত যুদ্ধবন্দী আর সাধারন মানুষের জীবনের বিনিময়ে তৈরী এই ডেথ রেলপথ।গিরিখাত গুলোতে বন্দীরা কাঠ দিয়ে হাতে ব্রীজের মত করে তৈরী করেছে রেলপথ ইংরাজীতে যাকে বলে ভায়াডাক্ট। যুদ্ধ শেষে নিরাপত্তার কারনে সমস্ত রেলপথ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে থাই সরকার, শুধু একটু অবশিষ্ট আছে পর্যটকদের জন্য। কাঠের তৈরী একটি ভায়াডাক্টের ছবি।এর উপর দিয়ে ট্রেনে করে আমরা গেলাম নামটক।
ওয়াম্পো ভায়াডাক্ট
এরপর আমরা মিজ সুসির সাথে গেলাম জিয়াথ ওয়ার মিউজিয়ামে।এখানে আছে জাপানীদের হাতে বন্দী বৃটিশ অস্ট্রেলিয়ান ও ডাচ সৈন্যরা কি অমানুষিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করতে করতে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছে তার নিদর্শন। ভাংগাচোড়া বেড়ার ঘর,রোদ আর বৃস্টির পানির অবাধ প্রবেশ, শোয়ার জন্য বাশের চিকন বেন্ঞ ।বেড়ায় টাংগানো রয়েছে ছেড়াখোড়া কাপড় চোপড় পড়া অর্ধনগ্ন হাড্ডিসার অভুক্ত এবং অসুস্হ সৈনিকদের সাদা কালো ছবি।জঙ্গলের মধ্যে মাইলের পর মাইল যাতায়াত ও তাদের বাধ্যতামূলক শ্রমে তৈরী এই ব্রীজ ও রেলপথ যা হাজার হাজার সৈনিককে মৃত্যর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে মিউজিয়ামটি তৈরীতে বৃটেন অস্ট্রেলিয়া থাই এবং হল্যান্ড সরকারের সাথে জাপান সরকারও সহযোগিতা করেছে।এই পাচটি দেশের আদ্যাক্ষর নিয়েই জিয়াথ শব্দটি।
এরপর আমরা আসলাম কান্ঞনাবুরি ওয়ার সিমেট্রি তে।যুদ্ধের পর হাজার হাজার মৃত সৈনিকদের দেহের অবশিষ্টাংস সংগ্রহ করে সারিবদ্ধ ভাবে এখানে সমাহিত করা হয়েছে। ৬৯৮২ জন অস্ট্রেলিয়ান বৃটিশ এবং ডাচ সৈনিকের কবর আছে এই সিমেট্রিত।যেমনটি আছে আমাদের চট্টগ্রাম ও ময়নামতীতে।
যুদ্ধ হত্যা রক্তপাত আমার কখনই ভালো লাগেনা। সমস্ত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কথা ভুলে গেলাম যখন সেই মৃত সৈনিকদের নাম ফলকগুলো পড়তে লাগলাম। জন্ম আর মৃত্যুর সন লেখা।
ফলকগুলোতে আরও উৎকীর্ন আছে কত বাবা মায়ের আহাজারি। কত ভাই বোন আর স্ত্রীর চোখের পানি গায়ে মেখে শুয়ে আছে ১৮থেকে ৪০বছরের কিশোর তরুন যুবা। প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে কতদূরে আত্নীয় পরিজনহীন অবস্হায়।বিনা প্রয়োজনে অল্প বয়সেই বিভীষিকাময় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে সুদূর এক ভিন্ন দেশের ভিন্ন মাটিতে।
শেষে গেলাম একটি রেলওয়ে মিউজিয়াম যেখানে সেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় চালিত কয়লার ইন্জিন সহ রেলগাড়ী সংরক্ষিত আছে।
ওয়ার মিউজিয়ামে প্রদর্শিত আছে সমরাস্ত্রের যন্ত্রপাতি পোশাক ছবি এসব।
সব কিছু দেখে যখন ব্যাংককের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলাম তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।
দেখে আসলাম আমার স্বপ্নের ব্রীজ অন দ্যা রিভার কাওয়াই দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে।
কাল যাবো পাতায়া মনে হয় দিনটা আনন্দেই কাটবে।
********
ছবিগুলো নেট থেকে নেয়া...