নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, দ্রব্যমূল্য সামাল দেয়া, দলীয় কর্মীদের কোন্দল- এ ছাড়া আরো অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ম করে সরকারের দেশ চালানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতা নিয়ে এখন জোর সমালোচনা হচ্ছে। শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সরকারের কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা চলছে। তবে এসব বিষয় নিয়ে সরকার এতটুকু হুঁশিয়ার নয়। জাতীয় সংসদের নির্বাচনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিয়ে চরম কারচুপির ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে কোনো প্রয়াস লক্ষ করা যায় না। এ জন্য সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই।
অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব যাদের হাতে, সেই নির্বাচন কমিশন সরকারি দলের প্রার্থীদের তাণ্ডব চোখ বুজে সইছে। এবার স্থানীয় সরকারসহ অন্যান্য নির্বাচনে যে ব্যাপক কারচুপি, দখলবাজি, সহিংসতা ও অনিয়ম হয়েছে তা সীমার বাইরে অথচ নির্বাচন কমিশন এসব নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলেছে। সরকারি দলের যে অনিয়ম তার রেকর্ড অতীতে নেই। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, এসব কথা শোনার কেউ নেই। নির্বাচন এখন সবার কাছে হাস্যকর। প্রহসনে পরিণত গোটা নির্বাচনীয় প্রক্রিয়া। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নির্বাচন নিয়ে আস্থাহীনতা সরবে উচ্চারিত। অথচ সরকারের কিছুতেই নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু না হওয়ার বিষয়টি আমল দিচ্ছে না। দেশের মানুষ মনে করে নির্বাচন এখন পেশিশক্তির দখলে চলে গেছে। শুধু এখনই নয়, এর আগে বহু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অনিয়ম করেছে। তাদের লোকনিন্দার কোনো বালাই নেই। তারা সবসময় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের সুবিধামতো কাজ করে। এ জন্য ভোটার, ভোটব্যবস্থা কারো দিকেই তাদের নজর ছিল না। নির্বাচনের ন্যূনতম যে অবস্থার দরকার তাকে আওয়ামী লীগ কর্মীরা কোনো তোয়াক্কাই করেনি। নির্বাচন কমিশন এসব অনিয়মকে নজরে আনেনি। বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ অনিয়ম করেছে। তৎকালীন সরকারি দল আওয়ামী লীগ সব নিয়মনীতির দিকে তাকায়নি।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে গণতন্ত্রের জন্য আওয়ামী লীগ মায়াকান্না করলেও যখনই তারা ক্ষমতায় গেছে, তখনই তাদের গণতন্ত্রবিরোধী আচরণ দেশের মানুষকে হতাশ করেছে। আওয়ামী লীগের এসব কর্মকাণ্ডকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ একসময় ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হয়। দীর্ঘকাল ক্ষমতার বাইরে থেকে যখন আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে, সে সময়ই গণতন্ত্রের ভিতগুলো এরা ভেঙে তছনছ করেছে। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান; অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান তাদের দায়িত্ব। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে দলীয় সংগঠনে পরিণত করে। এবার যে নির্বাচন হয়েছে, সংসদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের, তার একটিও দেশে কি বিদেশে কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আন্তর্জাতিক মহল থেকে বারবার বলা হচ্ছে নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু করার জন্য। এসব ডাকে কানে তোলেনি ক্ষমতাসীনেরা।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন এতটা খারাপ হয়েছে যে, তাতে দেশবাসী দারুণ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন যাপন করছে। খুন খারাবি, শিশু হত্যা, ধর্ষণ ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যার ঘটনা এখন অহরহ চলছে। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রতিদিন চলছে এসব অপকর্ম। সরকার এ জন্য এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর প্রতিবিধান করতে পারেনি। সরকার পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়েই ভাবতে হচ্ছে সারাক্ষণ। বিরোধী দলগুলো বারবার বলছে বিভিন্ন বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করেছে। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের অপরাধের ব্যাপারে পুলিশ বাহিনী চোখ বন্ধ করে রেখেছে। তাদের কোনো অনিয়ম অপরাধে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ফলে সরকারি দলের লোকেরা অবাধে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোনো স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে না। কোথাও কোনো আশার বাণী নেই।
দেশের প্রধান ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আরো অনেক ব্যাংকের এখন জালিয়াতে ডুবে আছে। তহবিল তসরুফ নিয়ে হইচই হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এই জালিয়াতির ব্যাপারে ব্যাংকের সাবেক গভর্নরের ব্যর্থতায় গোটা ব্যাংকটি এখন অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছে; এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সেটা পাহারা দিতে পারেনি। তদন্তে এখন বেরিয়ে আসছে, ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার চরম গাফিলতির পরিচয় দেয়ায় এই বিপুল পরিমাণের টাকা দেশের বাইরে চলে গেছে। এ বিষয়টি প্রথমে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এই জালিয়াতি যখন ধরা পড়ে সে সময়ও অর্থমন্ত্রী বা সরকারকে জানানো হয়নি। অর্থমন্ত্রী মনে করেন, ব্যাংকের কিছু লোক এতে মদদ দিয়েছে। তারা চিহ্নিত হলেও এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব জালিয়াতির পাশাপাশি আরো কিছু ব্যাংক দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছে। এসব জালিয়াতির জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকার আর কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারুক-না-পারুক, একটা ব্যাপারে কিন্তু সরকারের সাফল্য রয়েছে। সেটা হলো, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে এতটুকু দুর্বলতা সরকারের নেই। হামলা-মামলার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার ব্যাপারে সবটুকু সাফল্য তারা দেখাতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে আইন-আদালত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তারা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে পেরেছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের সাহায্য-সহযোগিতায় সরকার বেশ ভালোভাবেই নিচ্ছে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে অসংখ্য মামলায় জাড়িয়ে দিয়েছে। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকার বলতে ক্ষমতাসীনদের সাথে বিরোধী দলকে বোঝায়। বিরোধী দলের ছায়ামন্ত্রিসভাও থাকে। এসব বিষয় নিয়ে সরকারের নজর নেই। ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠন ঠিক একই কায়দায় প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনগুলোকে শিক্ষাঙ্গন ছাড়া করেছে। ছাত্রসংগঠন ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলো এখন শিক্ষাঙ্গনের বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে লিপ্ত। স্বার্থ ও ক্ষমতার মোহ তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে ফলাও করে প্রচার চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা সাফল্য তাদের রয়েছে। কিন্তু এই উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক টাকা-পয়সা ব্যয় হচ্ছে, এর সুবিধা নিচ্ছেন সরকরি দলের নেতাকর্মীরা। নানা ফাঁকফোকর নিয়ে তারা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের মানুষ এখন অথৈ সমস্যার মধ্যে রয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল তা তারা করছেন না। জনগণের জীবনযাত্রার মান এখন ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। মানুষ দ্রব্যমূল্য নিয়ে চরম সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। এসব বিষয়ের প্রতি সরকারের দৃষ্টি নেই। -
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৬ সকাল ৯:২১