১
হঠাৎ খুব ঠান্ডা লেগে ঘুম ভেঙে গেল। গায়ের উপর হাত দিয়ে দেখলাম, লেপ আছে। তাহলে ঠান্ডা লাগে কেন! চোখ খুলে দেখলাম উপরে ফ্যান ঘুরছে। কাহিনি কি! এই ঠান্ডার মধ্যে ফ্যান দিল কে! সামনে আভাকে দেখেই বুঝলাম আসল কাহিনি। কোমড়ে শাড়ি পেঁচিয়ে রাগান্বিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এর আগেও দুইবার আমাকে ডেকে গিয়েছে।
শীতের সকালে লেপের মধ্যে ঘুমানোর মজাই আলাদা। কেউ যদি জোড় করে আমায় উঠিয়ে দেয়। তবুও আমি উঠতে রাজি নয়। বিয়ের আগে বারবার মা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠানোর চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়েছে। কিন্তু বউ এর কৌশলগুলো ভিন্ন। বাধ্য হয়ে লেপের নিচ থেকে উঠে ফ্যান বন্ধ করে দিলাম।
-এই কোথায় যাও?
আভাকে পিছন থেকে হাত টান দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। ঘুম থেকে জাগানোর শাস্তি না দিলেই নয়। কাছে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুমু খেলাম। আভা কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলল
-সকাল সকাল দুষ্টুমি না করলে হয়না!
হাত ছেড়ে দিতেই চলে গেল। যাওয়ার আগে বলল
-তাড়াতাড়ি গোসল করে নাও।
সকালবেলা গোসল করায় বিরক্ত লাগে। কতবার গোসল না করে অফিসে গিয়েছি। যাওয়ার আগে গায়ে ভাল করে বডিসস্প্রে মারতাম। যাতে গন্ধ না বের হয়। বিয়ের পরে সে উপায় নেই। শীতকালে বউ গোসল করিয়েই ছাঁড়ে। নাহলে আভার রাগারাগির শেষ নেই।
-এস মাথাটা মুছে দেই।
কাছে এসে আভা ভাল করে মাথা মুছে দিল। গোসল করানোর সময় রাগ দেখায়। তারপরে আদর দেখায়। কাঁপতে কাঁপতে বললাম
-আজকে অফ ডে। তাহলে এত সকালে গোসল করতে হবে কেন!
সে কোমড়ে হাত রেখে বলল
-আব্বুর ওখানে যেতে হবে। ভুলে গেছ!
কাল রাতে আভার আব্বু ফোন দিয়েছিল। তিনি আমাদের যেতে বলেছে। অনেকদিন হল সেখানে যাওয়া হয়না। আমি কিছু বলার আগেই, আভা রাজি হয়ে গিয়েছে।
-খেতে বস।
খাবার টেবিলে খেতে বসলাম। সামনে মা বসে আছে। আমার পাশে আভা সেজেগুজে রেডি হয়ে আছে। বোরখা পড়ে যাবে। তারপরেও এত সাজুগুজু করার কি আছে! সেটাই বুঝিনা। তবুও সে আমার সামনে এসে বলে
-কেমন লাগছে?
আমি প্রশংসা না করা পর্যন্ত সাজতে থাকে। একদিন বলেছিলাম
-কি দরকার এত সাজার! তোমাকে এমনিতেই বেশি সুন্দর লাগে।
মুখ ভেংচি দিয়ে বলে
-একটু না সাজলে চলে!
মা খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-ওর সাথে দুই তিনদিন থেকে আসবি। তোর অফ ডে আছে। তাছাড়া আসার জন্য জোড় করবি না।
-আমি থাকতে পারব না। চলে আসব।
পাশ থেকে আভা রেগে বলল
-মা, তোমার ছেলেকে যেতে হবে না। আমি একাই যেতে পারব। উনার কত কাজ আছে!
মা পাশ থেকে মুচকি হেসে বলল
-তুমি রাগ করোনা। আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি।
-চল। যাই।
আভা ব্যাগ গুছিয়ে হাজির। সাথে আমাকে যেতে হবে। মা যাওয়ার আগে ডাক দিয়ে বলল
-পাগলিটার সাথে রাগারাগি করিস না। গিয়ে ফোন দিস।
ওর পাশে বসলাম। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বলতে চায়। আমি কাধের উপর হাত দিয়ে বললাম
-এদিকে সরে এস। ঠান্ডা লাগছে।
মুচকি হেসে আভার আমার দিকে সরে আসল। এখন ঠান্ডা না লাগলেও, তার শরীরের উষ্ণতা পেতে ইচ্ছা করছে।
২
-এখন আমি কি করব?
আভার ভিত চোখের দিকে তাকালাম। এমন কিছু হয়নি সেটা ভাবেনি। নিজের বোকামির কারনে হয়ত তার মনে এমন রাগ হচ্ছে। চোখের মাঝে রাগ ফেটে পরছে। একটু আগে আমাকে ফোন দিয়ে ডেকে এনেছে। ভেবেছিলাম কোন খুশির খবর শুনব। কিন্তু এসে এমন খবর শুনতে হবে সেটা ভাবিনি।
আমার ফোন দিয়ে সবুজকে ফোন দিলাম। এখনো ফোন বন্ধ। ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। এখন আভাকে নিয়ে কোথায় যাব! আমাকেও বাসায় যেতে হবে। এভাবে একটা মেয়েকে রেখে যাওয়া ঠিক হবেনা। ওর মাথার চিন্তা আমার মাথায়'ও কিছুটা ঘুরপাক খাচ্ছে।
-বাসায় ফিরে যাও।
আভা এবারে দুঃখিত চোখে তাকাল। রাগী মেয়েরা বেশি রাগ করলে অথবা একটু দুঃখ পেলে চোখে পানি চলে আসে। মর্মাহত চোখে কিছু একটা করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়না। সে কিছুটা শান্ত গলায় বলল
-সেইরকম কোন ব্যাবস্থা নেই। আসার আগে চিঠি লিখে এসেছি। বাড়িতে গেলে আমাকে বের করে দিবে।
-এমন করেছ কেন!
-এছাড়া উপায় ছিল না।
-আসার আগে আমাকে একবার জানাতে পারতে না!
আভা সবুজের গার্লফ্রেন্ড। একদিন আমাকে সবুজ পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। সবুজের সাথে ওকে প্রেম করতে দেখে মনে মনে আফছোস হত,এত সুন্দর একটা মেয়ে এমন একটা ছেলের সাথে রিলেশন করেছে! সবুজের আরো কয়েকটা গার্লফ্রেন্ড আছে। কিছুদিন প্রেম করার পরে শারীরিক সম্পর্ক করে ব্রেকাপ করা সবুজের কাজ। কিন্তু এমন একটা মেয়ে ফাদে পা দিল!
সবুজ এর আগে কয়েকবার আভার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে চেয়েছে। আভা কখনো রাজি হয়নি। সবুজ আমাকে বলেছিল বুঝানোর জন্য। আমি সবুজের সামনে বুঝালেও আড়ালে গিয়ে নিষেধ করছি। এমন একটা ভাল মেয়ের এত বড় ক্ষতি হতে দেওয়া যাবেনা।
আভা আজ ব্যাগ গুছিয়ে চলে এসেছে। সবুজকে বিয়ে করবে বলেই এসেছে। তার বাসায় বিয়ের কথা চলছে। বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবে না বলেই চলে এসেছে। কিন্তু সবুজ তাকে বিয়ে করতে রাজি না। সে শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত। তারপরে আর আগাতে রাজি না।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গিয়েছে। এখনো দুজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। সবুজের ফোন বন্ধ। অন্য একটা নাম্বার জানা আছে। সেটায় ফোন দিয়ে কোন লাভ নেই। কেউ ভাত না খেলে, তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে খাওয়ানো যায়। কিন্তু বিয়ে করানো যায়না। বিয়ের পরে কি হবে!
-আমার সাথে এস।
আভার ব্যাগ নিয়ে হাটতে থাকলাম। সে অসহায় পায়ে আমার সাথে হাটছে। ওকে বাসায় নিয়ে যাব ভাবছি। কোনরকমে ছোটবোনকে ম্যানেজ করে আজকের রাতটা পার করতে পারলেই হবে। কালকের টা কালকে ভাবব।
বাসার নিচে এসে ছোটবোন ইন্নাকে ফোন দিলাম। ওকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে বললাম। কলিংবেল বাজানোর বদলে ফোন দেওয়ার পরে ইন্না দরজা খুলে দিল। আভাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
-উনি কে!
-আমার ফ্রেন্ড।
-কিন্তু..
-কোন কিন্তু না। তুই ওকে তোর রুমে নিয়ে যা। বাকিটা পরে বলব। আব্বা কি বাড়িতে এসেছে?
-না।
-তবে নিয়ে যা।
রুমে এসে জামাকাপড় পাল্টে ইন্নার রুমে আসলাম। আভা চুপচাপ বিছানায় বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে খেতে দিতে বললাম। সে খাবে না। চিন্তায় কারো গলা গিয়ে খাবার নামে না। ইন্না বারবার আমাকে প্রশ্ন করতে চাইলেও থামিয়ে দিচ্ছি। ভাগ্যিস মা ঘুমিয়ে পড়ায় কিছুটা ঝামেলা থেকে বাঁচলাম। বাবা আসলে কি হবে সেটাই ভাবছি।
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ শুনে ইন্নাকে ভালমতো বুঝিয়ে এসে দরজা খুলে দিলাম। বাবা ভেতরে ঢুকে বলল
-আজ অফিসে যাওনি?
-গিয়েছিলাম। পরে ছুটি নিয়ে চলে এসেছি।
-কেন?
-এমনি একটা কাজ ছিল।
-ওকে তুমি রুমে যাও।
রুমে শুয়ে ভাবছি কালকে কি হবে! বাবা দশটায় বাইরে যায়। তারপরেই ওকে নিয়ে বাইরে চলে গেলেই হবে। তারপরে কালকে নাহয় সবুজকে ফোন দিব। কোনরকমে বাবাকে লুকিয়ে নিতে পারলেই হবে।
সকালবেলা ছোটবোন ইন্নার ডাকে ঘুম ভাঙল। রাতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি বুঝতে পারিনি। চোখ মেলে তাকাতেই ইন্না বলল
-বাবা ডাকছে।
ইন্নার কথার মধ্যে অন্যরকম একটা ভাব। কিছু একটা হয়েছে।
চোখ মুখ ধুয়ে ড্রয়িংরুমে এলাম। বাবা সোফায় বসে আছে। তার অপরপাশে আভা দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বুকের মধ্যে চমকে উঠল। যেন কেউ হাতুরি দিয়ে বুকে আঘাত করেছে। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়।
-মেয়েটি কে?
বাবার কথায় গলা শুকিয়ে গিয়েছে। বাবাকে আমি খুব ভয় পাই। পুলিশের সাবেক দারোগা তিনি। বাসায় তার কর্তৃত্ব বহাল রয়েছে। উনার সামনে দাঁড়ালেই নিজেকে আসামী লাগে। এমন ভাবে কথা বলছেন, যেন আমি কোন খুন করেছি।
-কি হল! কথা বলছ না কেন!
বাবার কথায় এবারে আরো ভয় পেয়ে গেলাম। হুংকার ছেড়ে কথা বলছে। ভয়ে ভয়ে আস্তে করে বললাম
-আমার বন্ধু।
-মিথ্যা বলছ কেন! বিয়ে করেছ ঠিক আছে। কিন্তু সেটা লুকাও কেন!
এবারে আমি পুরো বেকুব হয়ে গেলাম। বলে কি! বিয়ে করলাম কখন! মা পাশ থেকে কাঁচুমাচু করে তাকাচ্ছে। ঝামেলাটা মা বাধিয়েছে। সে নিশ্চয় ভেবেছে, এটা আমার বউ। যার কারনে এমন হয়েছে।
-বিয়ের কাগজপত্র বের কর।
বাবা আইনের লোক। সবসময় আইন মেনে চলেন তিনি। তাই তাকে বিয়ের কাগজ পত্র দেখাতে হবে। বিয়ে না করলে সেসব পাব কোথায়! বাবা এবারে আমার মুখের দিকে তাকালা। আরেকবার আভার দিকে তাকিয়ে বলল
-তোমার বাবার নাম্বার দাও।
আভা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে ফোন নাম্বার দিল।
ঘন্টাখানেক পরে আবার বাবা এল। এতক্ষণে কত গ্লাস পানি খেয়েছি তার হিসেব নেই। চিন্তায় বারবার গলা শুকিয়ে গিয়েছে। আভা চুপচাপ শুধুই দাঁড়িয়ে ছিল। ভেবেছিলাম ওর বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিব। কিন্তু তিনি আসার পরে নতুন বিপত্তি বাধল। হঠাৎ কাজি ডেকে নিয়ে আসল। আমাকে আর আভার বিয়ে দিবে বলে ঠিক করেছে। কি মুশকিল!
আভাকে একদিন মজার ছলে বলেছিলাম
-সবুজের সাথে ব্রেকাপ হলেও আমি আছি। আমাকে বিয়ে করে নিও।
সেটা মজার ছলে বললেও আমি মন থেকে চেয়েছিলাম। মনে মনে আভাকে চাইতাম। সেই চাওয়া এমন ভাবে পাওয়া হয়ে যাবে। সেটা কখনো ভাবিনি।
৩
আভার বাসায় এসে দুজন গাড়ি থেকে নামলাম। একটা ব্যাগ আমি নিলাম। আভা আমার পাশাপাশি হেটে উপরে বাসায় ঢুকল। বাসায় ঢুকে দেখলাম, আভার বাবা মানে আমার শ্বশুড় বসে আছে। উনাকেও আমার একটু ভয় লাগে। সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর। উনার মেজাজ কম না।
রাত হয়ে গিয়েছে। আভার বাবা আমাকে খাওয়ার জন্য ডাক দিল। বিয়ের পরে উনি আমার সাথে কথা বলেনি। উনার মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছি। তাই রাগটা মনে মনে পুষে রেখেছেন। আজ হঠাৎ ডাক দিল!
টেবিলে সবাই খেতে বসেছি। আমার শ্বশুড় আব্বা বেশ হাসিখুশিভাবে কথা বলছে। এতদিনে মনেহয় আমার উপর তার রাগ নেই। ব্যাপারটা ভেবে বেশ ভাল লাগল। অবশেষে উনার মনটা জয় করে গেল!
রাতে আভার সাথে লেপের নিচে শুয়ে পড়লাম। ঠান্ডায় আমি একটু কাঁপছিলাম। আভা আমার কাছে জড়িয়ে ধরল। কানে কানে বলল
-এখনো ঠান্ডা লাগছে!
এখন ঠান্ডা লাগছে না। তার শরীরের উষ্ণতায় ঠান্ডা দুর হয়ে গিয়েছে। হুট করে আভার ঠোটের সাথে আমার ঠোট ছুঁইয়ে দিলাম। বউ থাকলে শীতের মাঝে শুধু গোসল করতেই হয়না। বউ এর কাছ থেকে রাতে উষ্ণতা আর আদর দুইটাই পাওয়া যায়।