ত্রিদিতা আমার দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে আছে। আমাকে পর্যবেক্ষন করে দেখছে। মুখভর্তি দাড়ি, চুলগুলো বেশ বড়সড় হয়েছে। শেষ কবে চুল কাটতে সেলুনে গিয়েছিলাম মনে নেই। আমাকে চুল কেটে পরিপাটি হতে হয় না। সাকিবকে চুল দাড়ি কেটে বেশ পরিপাটি থাকতে হয়। তার গার্লফ্রেন্ড বলে দিয়েছে, চুল দাড়ি কেটে সবসময় পরিপাটি হতে হবে।
নাহলে বেশ রাগ করবে।
আমার চুলগুলো দেখে পাগল ভাবার মত কিছু নেই। চুল না কাটলেও, পাগলদের মত জট হয়ে যায় নি। মেয়েটি এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকলে নিজের মাঝে অসস্তি ভর করে। চিড়িয়াখানার প্রানীদের মত লাগে নিজেকে। আমি চুপ করে বসে আছি।
-তুমি কি চুপ করে থাকবে?
এতক্ষণে ত্রিদিতা মুখ খুলল। চোখের নিচে কাজল কিছুটা মুছে গিয়েছে। তবে ঠোটের লিপস্টিক এখনো বেশ গাড় হয়ে আছে। কোন কামুক পুরুষ এই ঠোট দেখলে লিপস্টিক চুষে নিতে চাইবে। আমার তেমন ইচ্ছা জাগছে না। তাই বলে আমি কাপুরুষ নয়।
-কি বলব!
আমার কথায় ত্রিদিতা বেশ মর্মাহত হল। আমার কাছে এমন উত্তর আশা করেনি। তার কথায় আমি হ্যা বলব। একটা রিক্সা ডেকে বলব, চল তোমাকে নিয়ে ঘুরে আসি। মিমির পাশাপাশি হাতটা ধরব। সুযোগ পেলে আরো কাছে টেনে নিব।
কিন্তু আমি সেসব কিছুই করিনি। ত্রিদিতা আমাকে রিক্সায় ঘুরার অফার দিয়েছে। সেটা এক দুই ঘন্টা নয়, পাক্কা তিন ঘন্টা। আমি তাতে সায় দেইনি।আমার কোন কাজ নেই। তবুও কেন সায় দেইনি সেটাই ত্রিদিতা বুঝার চেষ্টা করছে। এর আগেও তিনদিন আমাকে রিক্সায় ঘুরবার প্রস্তাব দিয়েছে। আমি প্রতিবার না করে দিয়েছি।
ত্রিদিতা সাথে আমার হঠাৎ করে দেখা। সেদিন রবীন্দ্রসরবরে গিয়েছিলাম ঘুরতে। এই জায়গায় ঘুরতে খারাপ লাগেনা। নতুন নতুন মানুষ দেখতে বেশ ভাল লাগে। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন চলার ভঙ্গি। একেকজন একেকরকম পোষাক পরে নিজেকে সুন্দর করার চেষ্টা। পোষাক পরার কারনে মানুষকে সুন্দর লাগে। পোষাক নিয়ে একটা গল্প পড়েছিলাম অনেক আগে।
রবীন্দ্রসরবর থেকে বাইরে চলে এসেছি। সামনের একটা দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। গোল্ডলিফ সিগারেট কিনলাম। পকেটে টাকা থাকলে ডার্বি সিগারেট ভাল লাগেনা। গোল্ডলিফ সিগারেট খেলে নিজেকে ধনী ধনী লাগে। দোকান থেকে ম্যাচ নিয়ে সিগারেট ধরালাম।
-আরে শুভ্র না?
পিছনে ঘুরে তাকালাম। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে বেশ সুন্দর একটা শাড়ি। "আমি আপনাকেই খুজছিলাম" মেয়েটির মুখ দেখে এই টাইপের কিছু বুঝা যাচ্ছে। মুখে সুন্দর হাসির আভা। সুন্দর করে মেয়েটা হাসতে পারে। সে বিষয়ে ভুল নেই। তবে আমাকে কেন এভাবে ডাকল সেটাই বুঝতে পারছি না।
-আপনি শুভ্র।
এবারে নিশ্চিত হলাম, মেয়েরা আমাকে খুঁজছে। কিন্তু কেন খুঁজছে! আমি সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে বললাম
-জ্বি বলুন।
-আমি আপনাকে খুঁজছি। ফেসবুকে আপনার ছবি দেখেছি।
এতক্ষণে আসল কাহিনি বুঝতে পারলাম। মেয়েটা ফেসবুকে আমার ছবি দেখেছে। আমার বন্ধু নাসির, আমার ছবি তুলে বলেছিল ফেসবুকে দিবে। সে নাকি আমার নামে ফেসবুকে একটা পেজ খুলেছে। আমি ফেসবুক চালাই না। এই যুগে থেকেও ফেসবুক চালাই না। ব্যাপারটা হাস্যকর হলেও সত্য।
-আমি আপনার লেখা পড়েছি। আপনি খুব ভাল লিখেন।
মেয়েটি আমার লেখা পড়েছে! নাসিরকে আমি মাঝেমাঝে লিখে দেই। লেখাগুলো সে ফেসবুকে দেয়। আমার নামের পেজটা নাকি বেশ জনপ্রিয়। মেয়েটা হয়ত সেখান থেকেই লেখা পড়েছে।
আমি সিগারেট শেষ করে হাটতে থাকলাম। মেয়েটি আমার পিছু নিয়েছে। আমার সাথে পরিচিত হতে চায়। আমি সেসবে কোন আকর্ষন বোধ করছি না। কারো সাথে পরিচিত হয়ে তাকে জানার আগ্রহ নেই।
মেয়েটি আমার সম্পর্কে জানে। তাই আমার পিছনে হাটতে হাটতে সেসব বলে যাচ্ছিল। আমি এখন দুই একটা কথা বলছি। কেউ খুব আশা করলে তার আশা নষ্ট করতে নেই। তাই কথা বলতে বলতে রাস্তায় হাটতে থাকলাম।
মেয়েটার নাম ত্রিদিতা। অনার্সে পড়ালেখা করে। কথাগুলো নিজে থেকেই বলছিল। নিজের সব কথা বলে যাচ্ছিল। সবশেষে আমার ফোন নাম্বার নিয়ে চলে গেল। আমার ফোন বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। চার্জ ফুরিয়ে গেলে চার্জ দেওয়ার কথা মনে থাকেনা। আমাকে ফোন করে কথা বলার কেউ নাই। "আমার একটা ফোন আছে" কথাটা বুঝানোর জন্য ফোন পকেটে নিয়ে ঘুরি।
মেসে এসে ফোন চার্জ দিলাম। এতক্ষনে ফোনটা চালু হয়েছে। ফোন চালু হতেই অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসল। ধরার সাথে সাথে ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন গলায় বলল
-এতক্ষণে ফোন চালু হল?
বুঝতে পারলাম অপরপাশের জন আমাকে বারংবার ফোনে খুলছিল।
ত্রিদিতা ফোন দিয়ে কথা বলা শুরু করে। এভাবেই ওর সাথে পরিচয়। কারনে অকারনে মেয়েটা ফোন দেয়। তার জন্য ফোন চার্জ দিতে হয়। এটা নিয়ে বেশ ঝামেলার মধ্যে আছি। এখন আমার ফোনে কথা বলতে ভাল লাগে। তবে সেটা ক্ষনিকের জন্য।
ত্রিদিতা প্রায়ই আমার সাথে দেখা করে। নিয়মিত ভাল ভাল খাবার খাওয়ায়। এসব খাবার খেতে বেশ লাগে। খাবার যে কেউ দিলেই খেতে পারি। খাবার সে তো খাবার'ই। নিয়মিত তার সাথে দেখা করতেও হয়।
-তুমি যাবেনা?
এতক্ষণে ত্রিদিতা বেশ রেগে গিয়েছে। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার সামনে কেউ বসে আছে। সে রিক্সায় আমাকে নিয়ে ঘুরতে চায়। তবে শুধু ঘুরতে চায় না। ঘুরার পরে আমাকে কিছু কথা বলতে চায়।
-আমি যাব না।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ত্রিদিতা চুপ করে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি পিছন ফিরে না তাকিয়ে সোজা হাটতে থাকলাম। সে রিক্সায় ঘুরার বাহানায় আমাকে কাছে পেতে চায়। খুব কাছে নিয়ে কিছু কথা বলতে চায়। কি কথা বলবে সেটাও জানি।
আমি হাটছি। পিছনে ত্রিদিতা নামের মেয়েটার চোখ দুটো জলে ভরে গিয়েছে। সে আমার মায়ায় ডুবে গিয়েছে।কিন্তু আমার মত ছেলের কারো মায়ায় জড়াতে নেই। একদম জড়াতে নেই!