ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম। কান্নার শব্দ শুনে হয়ত ঘুমটা ভেঙে গেল। কান্নার শব্দ খুব জোড়ে নয়। তবে বুঝা যায় পাশেই কেউ কান্না করছে। বিছানা ছেড়ে উঠে লাইট জালিয়ে দিলাম। পাশেই আরিশা কাঁদছে। এত রাতে কান্না করছে কেন!
আরিশার পাশে বসে কাধে হাত রাখলাম। কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছে। রাতে তো আমার বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়েছিল। কখন থেকে এমন কাঁদছে! মেয়েটার কান্না দেখে আমার'ও খারাপ লাগছে।
-কি হয়েছে? কান্না করছ কেন?
আরিশা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। কান্না যেন থামেই না। আমি আবার'ও বললাম
-কান্না থামাও। কি হইছে বল।
আরিশা কাঁদতে কাঁদতে বলল
-আমাকে ছেড়ে যাবেনা তো?
-না রে পাগলি।
-সত্যি?
-হ্যা।
আরিশার এবারে কিছুটা কান্না থামল। আমি বিছানায় শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আরিশা বাচ্চাদের মত গুটিগুটি মেরে আমার আরো কাছে চলে এল। মেয়েটার কান্না আমি একদম সহ্য করতে পারিনা।
-আরাফকে স্বপ্নে দেখলাম।
এতক্ষণে ওর কান্নার কারন খুঁজে পেলাম। মাঝেমাঝে এইরকম দুঃস্বপ্ন দেখে কেঁদে ওঠে। আরাফকে আজো ভুলতে পারেনি। বাইক এক্সিডেন্টে মারা গেলেও ওর মন থেকে মরেনি। আমি চাইনা ও আরাফকে ভুলুক। আরাফ যেমন ওর মনে ছিল তেমন থাকবে।
আরাফের সাথে আরিশার অনেকদিনের রিলেশন ছিল। তাদের প্রেমের কোন কমতি ছিল না। কিন্তু হঠাৎ একদিন বাইক এক্সিডেন্ট করে আরাফ মারা যায়। আরাফের জন্য আরিশাকে অনেক কাঁদতে দেখেছি। কিন্তু আমি বাস্তবতা মেনে নিতে শিখিয়েছি। কেননা, এছাড়া কোন উপায় নেই। মৃত্যুর উপর তো আর কোন মানুষের হাত নেই!
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আরিশার দিকে তাকিয়ে আছি। বাচ্চাদের মত করে ঘুমাচ্ছে। দেখতে বেশ দারুন লাগছে। আমি ওর ঘুম না ভাঙিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলাম।
দোকান থেকে ফিরে দেখলাম, আরিশা উঠে পরেছে। সকালবেলা আইস্ক্রিম কেনার জন্য দোকানে গিয়েছিলাম। দোকানদার মাঝেমাঝে অবাক হয়ে বলে
-ভাই প্রতিদিন সকালবেলা আইস্ক্রিম খায় আপনার বাচ্চা?
আমি হেসে বলি
-আরে নাহ। আমার বাসায় একটা ছোট্ট পাগলি আছে। ওর নিয়মিত আইসক্রিম লাগে। লোকটা আমার কথায় কিছু বলেনা।
-এই নাও।
আরিশা আমার হাতে আইসক্রিম দেখেই খুশি। হাত একটা আইসক্রিম নিয়ে খেতে শুরু করল। খেতে খেতে আমার গালে একটা চুমু খেয়ে বলল
-তুমি এত্তগুলা ভাল।
আমার মুখে একটু আইসক্রিম লেগে গিয়েছে। আমি মুচকি হাসলাম। মেয়েটা কি এমন'ই থাকবে! বাচ্চাসুলভ আচরন সবসময় থাকবে! তবে ওর বাচ্চাসুলভ আচরনটা আরো বেশি মন কাড়ে।
-ওই অফিসে যাবিনা?
আমি টেবিলের সামনে বসে পা দুলাচ্ছি। আরিশার কথা শুনে উঠে দাঁড়ালাম। আরিশার হাত ধরে বললাম
-নারে। যেতে ইচ্ছা করছে না। শরীর ভাল লাগছে না।
আরিশা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কপালে হাত রাখল।
-কই! কোন অসুখ নাই। অফিসে যাও।
আরিশার কথা শুনে আরো কাছে গিয়ে বললাম
-এই অসুখটা বুঝলি না রে।
ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
-এখন কোন দুষ্টামি না। তুই যদি অফিস থেকে আসার সময় দশটা আইসক্রিম আনিস। তাহলে....
-দশটা। ওকে দেখা যাবে।
একটা মুচকি হাসি দিয়ে অফিসের জন্য বের হলাম।
★★
আরিশা আমার বউ হলেও, এক সময়ের খুব কাছের বান্ধবী। আমরা ক্লাস ফ্রেন্ড না। আমি ওর সিনিয়র হলেও আমরা খুব ভাল বন্ধু। তবে প্যারা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সুন্দরি মেয়েদের বন্ধু হলে, একটু প্যারা সহ্য করতেই হবে।
বাসায় বসে পা দুলাচ্ছি। বাইরের দিকে তাকিয়ে রাস্তা দেখছি। হঠাৎ করে আরিশার ফোন পেয়ে একটু অবাক হলাম। টানা দুইদিন পরে আমাকে ফোন করেছে। দুইদিন আমাকে কোন জালাতন সহ্য করতে হয়নি।
-তুই কোথায় রে?
ফোন ধরেই এমন কথা শুনে অবাক হওয়ার কথা। দুইদিন পরে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবে কেমন আছি। তা না করে এমন প্রশ্ন।
-আমি আফ্রিকার কাঠমুন্ডুতে।
আমার কথা শুনে আরিশা রেগে বলল
-মজা লস হারামি? তুই তাড়াতাড়ি আমাদের বাসায় আয়।
-কেন রে? কোন বিশেষ কিছু!
-আসার আগে পাঞ্জাবী পরে আসবি।
আমি পাঞ্জাবী পড়ে নিলাম। কেন ডেকেছে সেটা জানিনা। জানার প্রয়োজন নেই।
রিক্সায় করে আরিশার বাসার সামনে আসলাম। ওর বাসা চিনলেও কত তলায় থাকে, সেটা জানা নেই। ফোন বের করে ফোন দিতে যাব, এমন সময় মেসেজ দেখলাম। মেসেজে সবকিছু লিখে দিয়েছে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার কলিংবেল বাজালাম। আরিশা দরজা খুলে দিল। ওকে দেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। হাত ধরে টান দিয়ে বলল
-ভেতরে এস।
ওর মুখে তুমি শুনে অবাক হলাম। কাহিনি কি! আজ হঠাৎ এত কদর কেন!
ভেতরে ঢুকে দেখলাম একজন লোক বসে আছে। উনি আরিশার বাবা হবেন হয়ত। ওর ভাল বন্ধু হলেও ওর বাবা মায়ের সাথে কখনো দেখা হয়নি। আমি সালাম দিলাম। লোকটা গম্ভীরভাবে সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলল। আমি সোফায় বসলাম।
-নাম কি তোমার?
আরিশার বাবার কথা শুনে আস্তে করে বললাম
-জুবায়ের হাসান।
-তোমার বাবার নাম্বার দাও।
এবারে আমার খটকা লাগল। বাবার ফোন নাম্বার চায় কেন! আমি আবার কি করেছি! আমার জানামতে কোন অন্যায় করেছি! আরিশার মুখের দিকে তাকালাম। ইশারা করে নাম্বার দিতে বলল। আমি ভাল ছেলের মত নাম্বার দিয়ে দিলাম।
-তুমি বস। আমি আসছি।
আরিশার বাবা ফোন নাম্বার নিয়ে চলে গেল। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসে আছি। ও আমার পাশে বসে বসল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল
-ঘাবরাস না। কথা বলবে শুধু।
-কিন্তু ফোন নাম্বার নিল কেন?
-গত দুইদিন ধরে বিয়ের কথা বলছে। আমি রাজি হইনি। পরে বেশি জোর করায় বলেছি, তোর সাথে আমার রিলেশন আছে। আমি অন্য কোন ছেলেকে বিয়ে করতে পারব না।
-কিন্তু এসব বলতে গেলি কেন!
-এছাড়া উপায় ছিল না। তুই আমাকে এইবারের মত বাঁচা। প্লিজ।
আরিশার করুন মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বুঝতে পারছি আমার মতই সেও ফেসে গিয়েছে। এখন নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নাই।
-তোমার বাবাকে ফোন করে কথা বলেছি। উনারা আসছে। আর তুই ওকে কিছু নাস্তা পানি খেতে দে।
ওর বাবা ড্রয়িংরুমে এসে আবার চলে গেল।
আমি চুপ করে বসে আছি। বলে কি! এসে কি কোনভাবে ফেসে গেলাম নাকি! আমার বাবাকে ডাকছে কেন!
আমি চুপ করে এখনো বসে আছি। আরিশা নাস্তা এনে বলল
-নে খা।
-ধুর! তুই খা। তুই বললি উপায় ছিল না। কিন্তু আমার বাবাকে ডাকে কেন!
-জানিনা। দুজন চুপ করে দেখে যাই।
কিছুক্ষণ পরে কলিংবেল বেজে উঠল। আরিশা দরজা খুলে দিতে গেল। আমার বাবা এসে সোফায় বসল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার আরিশার দিকে তাকাচ্ছে। ওকে আবার বাবা চিনে। এর আগে কয়েকবার আমার সাথে দেখেছে। আমার বন্ধু বলে কিছু বলেনি।
-তোমার বাবাকে ডেকে নিয়ে এস।
আরিশা ওর বাবাকে ডাকতে গেল। আমার বাবা আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। যেন আমি কোন অপরাধ করে ফেলেছি।ওর বাবা ফোন দিয়ে কি বলেছে কে জানে!
-আপনি এসে গিয়েছেন!
ওর বাবা আমার বাবার সামনে বসে বসল। আমি এক পাশে বসে আছি। আরিশাও পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বাবা কিছুক্ষণ ভেবে বলল
-ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে। আপনার ছেলেকেও আমার পছন্দ হয়েছে। আমি এইমাসেই ওদের বিয়ে দিয়ে দিতে চাই। আপনি কি বলেন?
আমার বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমার কোন আপত্তি নেই। তাছাড়া আপনার মেয়েকেও আমার পছন্দ হয়েছে।
-তবে মিষ্টিমুখ করুন।
আমি উঠে এসে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে আরিশাও দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছুটা চুপ করে থেকে বললাম
-কিরে প্রেমিক সাজাতে নিয়ে আসলি। কিন্তু এখন কি হল!
-কিছুই করার নেই। দুজনে মেনে নিতেই হবে। তোকে তো বলেছিলাম, কাউকে না পেলে তোকেই বিয়ে করব।
-বিয়ে করতেই হবে!
-হুম। এখন থেকে প্রতিদিন তুই আমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসবি।
-আমাকে তোর আইসক্রিম সাপ্লাইউয়ার মনেহয়!
ও হেসে বলল
-হ্যা। এখন থেকে সেটাই। নাহলে তোর খবর আছে।
★★
একটা কেক আর কিছু আইস্ক্রিম নিয়ে রুমে ঢুকলাম। আরিশা আইসক্রিম খুলে খেতে শুরু করল। আমি কেকের প্যাকেট খুললাম। আজকে আমার জন্মদিন না। আবার আরিশার জন্মদিন না। আজ আরাফের জন্মদিন। প্রতিবারের মত এবারেও আরাফের জন্মদিন পালন করব।
দুজন মিলে কেক কাটলাম। আরিশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুই শুধু আমার স্বামী না, আমার সেরা লাইফ পার্টনার।
-নে আইস্ক্রিম খা।
আরেকটা আইস্ক্রিম খুলে খেতে শুরু করল।
এই নিয়ে চারটা আইসক্রিম শেষ। ওর এত আইসক্রিম খাওয়া দেখে বলেছিলাম
-তোর ঠান্ডা লাগেনা! এত আইস্ক্রিম কিভাবে খাস!
সে সুন্দর করে বলেছিল
-ঠান্ডা ব্যাপারটা আমার ভাল লাগে। তাই সে নিয়মিত শাওয়ারের নিচে কমপক্ষে একঘন্টা বসে থাকে। আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। ওর ভাল থাকাই আমার ভাল লাগে। বন্ধু থেকে কবে যে ওর প্রেমে পরেছি বুঝতেই পারিনি। আমি ওর কাছে সবচেয়ে সেরা স্বামী। আমার মত করে ওকে কেউ বুঝে না।