ছেলেটিকে আজকে আবার দেখলাম । ভার্সিটির জীববিজ্ঞান স্কুলের বিল্ডিঙয়ের চিপায় । এই কয়দিন ঘন ঘন চোখে বাঁধছে বিষয়টা । হ্যাঁ, গাজা টানছিল । একা না, সাথে আরও কয়েকজন ছিল । দেখে শিহরিত হয়ে যাই । লজ্জায় সেখান থেকে চলে আসি ।
অনেকের মাঝে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে যে আমি ঐখানে কি করছিলাম ? আসলে যেই চায়ের দোকানটাতে প্রায় নিয়মিত বসে ক্লাসের বিরতিতে, ক্লাস শেষের আড্ডায় কিংবা বন্ধুদের মজাতে মশগুল থাকি, সেই চায়ের দোকানটা থেকে ভালভাবেই দেখা যায় বিল্ডিঙয়ের ঐ পাশটা । খালি ঐ ছেলেটাকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে আমি ঐখানে গিয়েছিলাম ।
এটা তো সবারই জানা যে ক্যাম্পাসে সবাই কাছের লোক হয়না । আবার কেউ ভাববেন না, কাছের লোক বলতে শুধুই বন্ধুরা । কাছের লোক হয় সিনিয়র ভাই, জুনিয়র আর বন্ধুরা তো আছেই । এই ছেলেটি আমার খুব কাছের একজন জুনিয়র ছোট ভাই । কয়েকদিন পরেই সেকেন্ড ইয়ারে উঠবে । বছরের দিক থেকে হোক কিংবা ব্যাচের দিক থেকেই হোক, ছেলেটি আমার দুই বছরের ছোট । ছেলেটি অবশ্য আমার ডিপার্টমেন্টের নয় । প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক তাহলে কেনইবা এই ছেলেটিকে নিয়ে স্ট্যাটাসটি লিখছি । আসলে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অতীতের কিছুকথা ।
ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ২৬ তম (একটু মিথ্যা) হয়েছিল । খুব গরীব মা-বাবার সন্তান । প্রথম যখন ওর কথা শুনলাম তখন সেই চায়ের দোকানটিতেই বসে ছিলাম । দুইটি ছেলে এসে সবার কাছ থেকে টাকা তুলছিল । কিছু না জেনেই অনেকেই টাকা দিয়ে দেয় কিন্তু কি মনে করে আমি এই টাকা তোলার কারণ জানতে যাই ঐ ছেলেদুটির কাছে ।তারা তখন বিস্তারিত আমাকে খুলে বলে । এই ছেলেটি অনেক গরীব । বাসাও খুলনাতে নয় । বাবা কৃষক তাও বয়স অনেক হয়ে যাওয়াতে এখন আর তেমন কর্ম করতে পারে না । মা গৃহিণী । একটিই বড়ভাই শহরে চাকরি করতে গিয়ে শহরের একটি মেয়েকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়েছে । বাসায় আসেও না, টাকাও পাঠায় না । আর ছোট দুইটি বোন । এখন সবাই সাহায্য না করলে ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না । শুনে খুব কষ্ট লেগেছিল, আর যতটুকু সামর্থ্য ছিল সেই টাকা দিয়ে দিলাম ।
এরপর ছেলেটি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করে, তখন নিজ উদ্যোগে খোঁজ নিয়ে ছেলেটির সাথে পরিচিত হই । কেমন জানি, মায়া পড়ে গিয়েছিল ওর কাহিনী শুনে । এরপর অনেকদিন ছেলেটির সাথে ক্যাম্পাসে দেখা হয়, খোঁজখবর নিই । তারপর পরীক্ষার জন্য ক্যাম্পাস থেকে কিছুদিনের জন্য আলাদা হয়ে যাই । এই সময়টাতে কারও খবর আমি রাখিনি । পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ওর কথা জানতে পারি । একটি প্রেমের ব্যর্থতার কারণে নাকি দুইটি পরীক্ষা ছাড়া আর কোন পরীক্ষা দেয়নি ও । আর কিছু গুণধর বড় ভাই ও বন্ধুদের কল্যাণে ঢুকে পড়ে নেশার জগতে ।
এরপর আর কোনদিন ওর সাথে কথা বলতে যায়নি । দুই একবার হয়তো সামনাসামনি দেখা হয়েছে কিন্তু ছেলেটাই লজ্জায় মুখ নিচের দিকে নামিয়ে ফেলেছে । কেন জানি অনেক কষ্ট পেয়েছি চোখের সামনে এরকম একটি মেধাবী আর ভালো ছেলের অধঃপতনে ।
আজকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হয়তো ভবিষ্যৎ জীবনের একটি রিহার্সাল মাত্র কিন্তু ভবিষ্যৎ জীবনের একজন যাত্রী নষ্ট হওয়ার পিছনে জাতির এই উদাসিনতা কেন জানি খুব করে কাঁদায় । এখনও মনে মনে ভাবি, এরকম গল্পের চূড়ান্ত শেষ কবে ?
(সংকলিত)