হিমুর খপ্পরে আমি ... (পর্ব - ০১ থেকে পর্ব ৭)
বেড়াতে এসেছি । চিরচেনা সেই ঢাকা শহরের যান্ত্রিক জীবনের বাইরে এসেছি । না, খুলনা না । এসেছি কক্সবাজার । সমুদ্রের ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছি প্রতিটি ঢেউয়ের গর্জন শুনতে । আমি কবি মানুষ । আমার কাজই তো হবে প্রকৃতির সাথে সখ্যতা, প্রেম । কিন্তু সেই আমি বেড়াতে আসতে পারি না । অবশ্য এটাও এক ধরনের অজুহাত । আসলে আমি তো বাধাহীন, পিছুটানহীন একজন মানুষ । আমার আবার বাধা কোথায় ? কিন্তু তাও সময় করে উঠতে পারি না । কবি হয়ে যতই কল্পনার রাজ্যে থাকতে চাই না কেন, আসলে বাস্তবতার সাথেও সখ্যতা রাখতে হয় । এই কারণেই তো বাস্তবতাই আমাকে কল্পনার রাজ্যে হারাতে দেয় না । আমি সমুদ্র আগে কখনও দেখিনি । এই প্রথম । অবশ্য এসেছি এই প্রথমবার । পাহাড়ও দেখা হয়ে উঠেনি । অথচ কল্পনার রাজ্যে এই দুটি জায়গায় আমার অবাধ বিচরণ । পাহাড় আর সমুদ্রের সৌন্দর্য দুটি দুইরকম । কেউ পছন্দ করে পাহাড় আবার কেউবা সমুদ্র । পাহাড় আর সমুদ্র, আমার দুটোই ভালো লাগে । অনেক আপন আপন মনে হয় । কিন্তু কোনটা বেশি ভালো লাগে ? বলতে পারব না । এই তো কয়েকদিন আগেই একটি কবিতা লিখলামঃ সৌন্দর্য আর আমার ইচ্ছের প্রতিফলন । সেখানে দুইটি প্যারায় আমি বুঝানোর চেষ্ঠা করেছি যে পাহাড় আর সমুদ্র পরস্পর সম্পর্কিত ।
আমাকে আবার বলা হল তুমি সমুদ্র দেখেছো?
রাশি রাশি ঢেউয়ের ফেনা কখনও গায়ে লাগিয়েছ?
অনেকদূর চোখ যেয়ে সূর্যের গায়ে লাগে সেই রূপ
হেরেছ কি সখা মনেরও মাধুরীর কিঙ্কর ধ্বনি লয়ে?
এবার আমি চুপ করে থাকি, তাদেরকে বুঝতে দেইনা
তারা যে অবুঝের মত একেকবার প্রশ্নের মালা গাঁথছে
তারা নিজেরাও জানেনা পর্বত আর সমুদ্র পরস্পরের আত্মীয়
তাদের নিজেদের মধ্যে ভাবের যে বিনিময় তা কখনই আমরা বুঝিনা ।
না, যা ভাবছেন তা নয় । হ্যাঁ, আমি এখানে একাই এসেছি । অবশ্য ডাক্তারের পরামর্শেই । অহেতুক শরীরের উপর অনিয়ম দেখে ডাক্তার বলেছে হাওয়া বদল করতে । তাই চলে আসলাম । অবশ্য একবার হিমুও বলেছিল আমার সাথে আসবে কিন্তু রূপা হারিয়ে যাওয়ার পর বেচারা কয়েকদিন ঘরকুনো অবস্থায় থাকার পর আবার দুনিয়াজয়ে বেরিয়েছে ।
ও, আপনাদের তো রূপার হারিয়ে যাওয়ার কাহিনী বলাই হয়নি । তাহলে বলি । আসলে রূপা আমাদের কাছে একটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিল । ও আসলে এতিম নয় । মানে তার বাবা এখনও জীবিত আছে । তবে এটি ঠিক যে সে অনেক সচ্ছল পরিবারের একটি মেয়ে এবং পরিবারের সাথে তার ঝগড়ার ব্যাপারটাও সত্যি । আমরা সকলেই এতকিছু জানতে পারলাম যখন তার বাবা তাকে নিতে এতিমখানায় এসেছিল । সাথে মেয়েটির মাও এসেছিল । পরে এও জানতে পারলাম মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়েছিল কারণ তার স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য নয় । বরং তার বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহ । তার বাবার মদ, জুয়া এগুলোর নেশা অনেক । এই নেশা করেই এতদিন রূপার মায়ের গায়ে হাত দিত রূপার বাবা । একদিন রূপা এসব সহ্য করতে না পেরেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় । তার এই পলায়ন তার বাবার মধ্যে আনে আমূল পরিবর্তন । ভদ্রলোক এখন হুজুর হয়ে গেছে । দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন এবং নেশার যাবতীয় কাজকামও ছেড়ে দিয়েছেন । তার এই আমূল পরিবর্তনের পিছনে যে তার এই মেয়ে কিন্তু তিনি এই মেয়েকেই খুজে পাচ্ছিলেন না এতদিন । অবশেষে অনেক কষ্টে খুজে পেয়েছেন । এখন মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছেন । এত অনুতপ্ত হবার পর কেউ আর রাগ করে থাকতে পারেনা । রূপাও পারেনি । বাবার কথা শুনা মাত্রই সে তার বাবাকে মাফ করে দেয় । অবশেষে বাবার সাথে ফিরে যায় বাবার ছোট মেয়ে । অবশ্য একবার রূপা যেতে চাচ্ছিল না । কারণ এতিমখানার এতিমদের সাথে, এলাকার মাস্তানগুলোর সাথে আর হিমুর সাথে তার ভালোই সখ্যতা হয়েছিল । পরে যেতে রাজী হয় হিমুর কথাতেই । হিমু অবশ্য মেয়েটিকে কোনদিন তার ভাললাগার কথা বলতে পারেনি । কে জানে, হয়তো চিরদিনের মত হারানোর ভয়তে । মেয়েটির চলে যাওয়ার সময় আমিও ঐখানেই ছিলাম । মেয়েটির চোখে আমি অশ্রুজল দেখেছি । কেন জানি আমার মনে হয়, মেয়েটিও হিমুকে পছন্দ করতো । কিন্তু কেউ কাউকে না বলার কারণে ব্যাপারটি অতীত হয়ে যায় । মেয়েটি বাড়িতে চলে যাওয়ার পর হিমু আবার পরিবর্তন হয়ে যায় । পুরোপুরি আগের মত হয়ে যায় । আবারও সেই ময়লা হলুদ পাঞ্জাবী আর খালি পায়ে ঢাকা শহর ঘুরা আর নতুন নতুন মানুষের সাথে জীবনের সম্পর্ক তৈরি করা । এই তো, ব্যাস । তবে মেয়েটি কিন্তু অনেকবারই এতিমখানার দিকে এসেছিল । কিন্তু হিমুর দেখা আর পায়নি । হিমু এখন ঐদিকটাতে আর যায় না । মেয়েটি কিভাবে কিভাবে যেন খোঁজ নিয়ে আমার মেসেও এসেছিল । কিন্তু আমিও তাকে হিমুর খবর দিতে পারেনি কারণ এর আগে আমারও প্রায় এক সপ্তাহের মত হিমুর সাথে কোনরকম যোগাযোগ ছিল না । এভাবেই হিমুর জীবন থেকে রূপা অধ্যায় শেষ হয় । আমি অবশ্য এরপর হিমুকে মন খারাপ করতে দেখিনি ।
এবার আসি, আমার এই ভ্রমণ বিষয়ক কথাতে । এখানে এসেছি তিনদিনের মত হয়েছে । উঠেছি একটি ছোটখাট হোটেলে । এখন অফ সিজন, তাই খরচ কম । খালি গরমটা একটু বেশি, এই যা । যেদিন ঢাকা ছাড়লাম, তার আগেরদিন হিমু আমার মেসে এসেছিল । আমি তখন ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম । আমাকে এই কাজ করতে দেখে হিমু জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাচ্ছেন কবি সাহেব ?
- আমি বললাম, কক্সবাজার ।
- হঠাৎ, কেন ?
- না এমনিতে, অনেকদিন কোথায় যাওয়া হয়না তো তাই ডাক্তার যখন বলল বাইরে থেকে বেরিয়ে আসতে তখন ভাবলাম, যাই, ঘুরেই আসি ।
- একা যাচ্ছেন ? নাকি আপনার সেই হুজুর বন্ধু হাশিম মিয়াও যাচ্ছে ? নাকি কোন নারী ?
- না, না, একা যাওয়ার ইচ্ছা । তবে তুমি আমার সাথে যেতে পারো । তোমার সঙ্গ কোনদিন খারাপ লাগে না ।
- কিন্তু এখন তো ঢাকা শহর ছেড়ে যেতে পারব না ।
- কেন ?
- আপনাকে একটি ছেলের কথা বলেছিলাম, মনে আছে ? ঐ যে এক্সিডেন্ট করেছিল মারাত্মক । ভেবেছিলাম, বাচবে না । কিন্তু অলৌকিকভাবে ছেলেটি বেচে গেছে । হাসপাতাল থেকে ছেলেটিকে ছাড়বে আর এক সপ্তাহ পর । ছেলেটি আমাকে খুব করে ধরেছে তার রিলিজের দিন যেন আমি তার পাশে থাকি । গ্রাম থেকে ওর মা আসবে । সে তার মায়ের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেবে । আমি ছেলেটির এই আবদার ফেলতে পারলাম না । তাই তো ঢাকার বাইরে যাওয়ার কোন উপায় নেই । আপনি যান । আমি যদি সুযোগ পাই, তাহলে চেষ্ঠা করবো যাওয়ার । তবে কথা দিতে পারছি না ।
এতক্ষণ চেয়ারে বসে বসে কথাগুলো বলেই হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো হিমু । আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার, চলে যাবে নাকি ?
- সে উত্তরে বলল, যাই, এই দুপুরের রোদ আমার গায়ে মাখাতে অনেক ভালো লাগে । আপনি তাহলে ঘুরে আসুন । বেচে থাকলে অবশ্যই আবার দেখা হবে ।
এই হল হিমুর সাথে কক্সবাজার আসার আগে আমার শেষ কথা । হিমু না বললেও আমি জানি হাসপাতালে থাকা ঐ ছেলেটার চিকিৎসার সকল খরচ দিয়েছে এই হিমুই ।
সময়তা এখন ভালোই কাটছে । কেন জানি, মনে হচ্ছে বাকিটা জীবন এখানে কোনমতে কাটিয়ে দিলে মন্দ হতনা ।