বৃষ্টি বারবার ভয় দেখাচ্ছিল। রেমাক্রি খাল ধরে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে একটা ছোট পাহাড় টপকে একটা ছড়া পার হয়ে নেফিউ ফরেস্টে ঢুকে গেলাম। ট্রেইলটা খুব বেশি টাফ না হলেও অসম্ভব সুন্দর। ফরেস্টটার প্রেমে পড়ে যাই। রোদ না থাকায় বেশ আরামেই ট্রেক করা যাচ্ছে। হালকা পাতলা বৃষ্টি এই ট্রেইলে কোন সমস্যা নয়, কিন্তু যাদের জোঁকভীতি বেশি তাদের বেলায় গল্পটা অন্যরকম হতে পারে। আমি খেয়াল করছি র্যাম্বো মাঝে মাঝেই এগিয়ে গিয়ে পথ দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা যতদূর এগুচ্ছে ততই অবাক হচ্ছি। ১২টা নাগাদ নেফিউ পাড়ায় পৌছে যাই। চমৎকার একটা মাচায় বসে পাড়া থেকে যোগাড় করা কলা, আনারস, পেঁপে এসব সাবাড় করছি আর ভাবছি আর মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দেশের সবচেয়ে উঁচু স্থানে গিয়ে দাড়াব। এতোই সহজ?! টীমমেট রাজীব সিদ্ধান্ত নেয় ও সামিটে যাবে না, এখানেই থাকবে। ওর অবস্থা এতটাই খারাপ যে ও এতদূর এসেও এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়; হাটতেই পারছিলনা একেবারে। সিদ্ধান্তটা খুবই ভালো ছিল ওর জন্য, টীমের জন্য।
আধাঘন্টা পেরুতেই সবাইকে সামিট পুশের জন্য রেডি হবার তাড়া দিলাম। রওনা দেয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই শুরু হল তুমুল বর্ষন- এ কি কান্ড! জুম না হওয়াতে ট্রেইলের পুরোটাই জঙ্গলে ঢাকা। এমন ঘোর বর্ষায় এখানে আসার সিদ্ধান্তটা কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল সেটা ভাবতে ভাবতে জঙ্গলা ঘাসের মধ্য দিয়ে এগুচ্ছি আর হাত, পা, ঘাড়, কোমর থেকে টাইগার জোঁক সরাচ্ছি চাকু দিয়ে। “হাতে পায়ে যত খুশি রক্ত খা, খাইয়া পইড়া যা; কিন্তু ঘাড়, কোমরে ক্যান উঠস রে বাবা”- তখন তো আর না সরিয়ে পারি না। এতো প্রোটেকশান, তার পরেও ওরা কিভাবে জানি ঘাড় আর কোমরে উঠে জিরিয়ে জিরিয়ে আরামসে রক্ত খাচ্ছে। আমাদের পেয়ে যেনো ওদের মহোৎসব শুরু হয়ে গেছে। ধবধবে সাদা রঙের জোঁক এবারই প্রথম দেখলাম বান্দরবানে। চার থেকে পাঁচ রকমের জোঁক হবে যেগুলো আমাদের দেখে আনন্দে আত্নহারা হয়ে পড়েছে। অবিরাম বর্ষনে মাটি আলগা হয়ে যাওয়াতে বড় বড় গাছগুলো পড়ে আছে পাথুরে ট্রেইলের উপর। কিছু কিছু খাড়া, পাথুরে জায়গায় র্যাম্বোকে আমাদের সাহায্য নিতে বাধ্য হতে হয়। পাহাড়ের চুড়াটা বেশ ঘন ঝোপ-ঝাড়ে ভরা। বড় বড় বোল্ডার গুলো শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। চুড়ার কাছাকাছি পৌছানোর পর বৃষ্টি থেমে যায়, ঘন মেঘে ছেয়ে যায় চারিদিক। ঘন বাশের ঝোপ-ঝাড় পার হয়ে পৌছে যাই শার্প রিজটার কাছে। এতো পিচ্ছিল জায়গা এর আগে আমি কমই দেখেছি। প্রচড বেগ পেতে হয় এটা বেয়ে উঠতে। সময় নিয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে র্যাম্বো সহ সবাইকে নিয়ে চুড়ায় পৌছে যাই। চারিদিক ঘন মেঘে ঢাকা, মেঘ এতটাই ঘন যে দুই মিটার দুরত্বেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। স্বপ্নচূড়ায় দাঁড়িয়ে পুরো বান্দরবানটাকে দেখা হল না এবার। জানি সাকা-হাফং বা মৌদক তং থেকে দুমলোং, থিংদলতে, কেওক্রাডং, ক্যাপিটাল, তাজিংডং থেকে শুরু করে যোগী, মৌদক মুয়াল, টোটাল নাক্ষিয়্যাং বেসিন কে আলাদা ভাবে চেনা যায় দেখা যায় আলীকদমের কির্সতং, ডিম পাহাড়ও। কিন্তু হায়! আফসোস! সে যাই হোক ফটোসেশন তো আর থেমে থাকেনি, যোগ দিয়েছে র্যাম্বোও। আফটার অল হি ইজ আওয়ার টীমমেম্বার।
এরই মধ্যে সৈকত তার আন্ডারওয়্যারের ভেতর একেবারে সেন্সিটিভ জায়গায় আবিষ্কার করে বিশাল সাইজের এক টাইগার জোঁক। নাহিদ আর আরিফ বিজি গারবার সিরিজের নাইফটা দিয়ে সূচারু হাতে জোঁকটাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে আনে; ধীরগতির উদ্ধারকার্য্য সবাই প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে উত্তেজনার সাথে উপভোগ করি। সৈকত অবশেষে হাফ ছেড়ে বাঁচে। বিষয়টা গা শিউরে ওঠার মত। মামুনের জিপিএসে চোখ রাখছিলাম বহুক্ষন ধরে একটা এভারেজ রিডিং পাবার আশায়। এভারেজ অল্টিচিউড পাওয়া গেল ৩৬৬০ ফিট। এই জিপিএস যত রিডিং দেয় আমি তার থেকে ২০০ ফিট বাদ দিয়ে হিসাব করি। ট্রেইলের বিভিন্ন চুড়াগুলোয় বারবার রিডিং নিয়ে একটা ধারনা পেয়ে গিয়েছিলাম ডিভাইসটা সম্পর্কে।
খেয়াল করলাম র্যাম্বো কেমন যেন করছে, ও কিছু একটা বোঝাতে চাইছে কিন্তু হায় আমরা তো বুঝতে অক্ষম! আবার বৃষ্টি পড়া শুরু করেছে। কুয়াশায় ঢাকা, প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন নির্জন এক জঙ্গলা পাহাড় চুড়ায় যদি তুমুল বর্ষন শুরু হয় তাহলে তো বিশাল সমস্যা। আতংকিত না হয়ে উপায় থাকল না। সবাইকে দ্রুত তৈরি হতে বললাম। আপেলকে জিজ্ঞেস করলাম “আপেল, কি মনে হয় তোমার?”। আপেল উত্তরে বলল “ভাব ভালা না, বৃষ্টি জোড়ে আইসতে পারে”। ওকেও আতঙ্কিতই মনে হল। চিন্তার বিষয়। এখানে ঝড় শুরু হইলে আশ্রয় নেয়ার জায়গা পাব কই? তুমুল বৃষ্টি বোধহয় কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হবে, প্রকৃতির ভাবসাব তাই বলছে। এইখানে সারভাইভ করা যাবে না, অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় কোন নিরাপদ জায়গায় অন্তত পৌছাতে হবে। ঘন মেঘের মধ্য দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নামা শুরু করলাম, এটা যে কি অনুভূতি সেটা বলে বোঝানোর মত লেখক আমি নই। প্রথম বিপদজনক জায়গাটা আস্তে আস্তে মাথা ঠান্ডা রেখে নেমে আসলাম। উঠার চেয়ে নামা টা বেশি ঝুঁকির। উঠার চেয়ে নামা টা বেশি ঝুঁকির। বৃষ্টিটাও বেড়ে গেল আবার। প্রকৃতির এই বিরুপ আচরনে র্যাম্বোও কিছুটা টেন্সড। তাই বলে ও এখন সবার আগে আর আমাদের তাড়াতাড়ি নিরাপদে নিয়ে যাওয়ার একটা দায়িত্ব নিজের কাধে সে স্বেচ্ছায় নিয়ে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কি অদ্ভুদ ব্যাপার! একটু দাড়াতেও পারছি না, নামতেই হবে। ঢল নেমে এলে নিশ্চিত মৃত্যু, বিশাল বিশাল বোল্ডারে গিয়ে আছড়ে পড়ব।
আছাড় খেতে খেতে অবশেষে নেফিউ পাড়ার কাছাকাছি ঝিরিটায় এসে নামি। সবাই প্রায় নগ্ন হয়ে নিজেদের শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে চাকু দিয়ে জোঁক সরাতে শুরু করি। হালকা ফ্রেশ হয়ে নেফিউ পাড়ায় গিয়ে পৌছাই সন্ধ্যার ঠিক আগেই। বাঁশের মাচায় বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে জীবনের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটি নেয়া রাজীব মজুমদার। রাজীব গেলে কি যে হত সেটা ভাবতে চাই না। মাচায় গিয়ে বসলাম, সবাই পুরোপুরি বিধ্বস্ত। রাজীব জিজ্ঞেস করে সব ঠিকঠাক তো? আমি বললাম হ্যাঁ সব ঠিকঠাক। আসলেই তো তাই! কেউ কেউ প্রস্তুতি নিচ্ছে নেফিউ পাড়ার ছোট্ট পুকুরটায় গিয়ে গোসল করার জন্য। এমন সময় সুমন দেখতে পায় র্যাম্বোর অন্ডকোষের সাথে জাপটে লেগে থাকা প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা কোলবালিশের মত এক জোঁক। আপেল খুব দ্রুত জোকটা সরানোর চেষ্টা করে। র্যাম্বোর সারা শরীরে ঘন লোম থাকায় জোকটা সুবিধা করতে না পেরে ওখানেই এটে বসে রক্ত খাচ্ছে। কি ভয়ংকর! নেফিউ পাড়ার ছোট্ট পুকুরটায় গোসল সেরে আমরা কারবারির ঘরে গয়ে উঠলাম। শীতে কাঁপতে কাঁপতে ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে এই মুহূর্তে চুলার ধারে বসে আগুন গরম চা-এর কাপে চুমুক দিতে দিতে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি আর ভাবছি লাইফ ইজ গুড।
নেফিউ পাড়ার মানুষদের প্রথম থেকেই আমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছিল। একটু বেশি রকমের সহজ সরল আর ওদের মধ্যে আদিম ভাবটা কিছুটা বেশি। বেশ ইন্টারেস্টিং কিছু রিচ্যুয়ালস ও দেখলাম। আপেল যখন মুরগী জবাই করছিল একটা ছোট বাচ্চা এসে প্লেট ধরে জবাই হতে থাকা মুরগীর ঠিক নিচে। বুঝি নাই প্রথমে ঐ রক্ত সংগ্রহ করে ওরা কি করবে। পরে দেখলাম চুমুক দিয়ে খাচ্ছে। অবাক হইনি খুব একটা কারন এটা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়। ওরা জানে এটা ওদের জন্য উপকারী। প্রকৃতিকে বোঝার ক্ষেত্রে এসব আদিবাসীরা আমাদের দেয়ে অনেক বেশি দক্ষ, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। যাই হোক, পরের দিনের সকাল। রিটার্ন ট্রেইলে হাটা শুরু। পাড়া থেকে পুকুরটা পার হয়ে খাড়া জায়গাটায় উঠে আসলাম এখন শুধু নামা আর নামা। শুরু হল ভয় দেখানোর মত বৃষ্টি। তুমুল বর্ষন কাকে আর বলে! সবাই থেমে গেলাম। আমি কনফিউজড, কি করব তবে মনে মনে চ্যালেঞ্জটা নেয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। আপেলকে ডাকলাম, কিছুক্ষন চিন্তা করে ও বললো “পারব”। আমি বললাম ঠিক আছে চল। নেফিউ ফরেস্টের শেষভাগে আসার পর বৃষ্টি কমে গেল। এরপর রেমাক্রি খালে নেমে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে নয়াচরন হয়ে সন্ধ্যার আগেই খাড়া পাহাড়টা বেয়ে শিমপ্লম্পির কাছে চলে আসলে একটু সমতল পাওয়া যায়। এখানটায় ওঠার ঠিক ২ মিনিটের মধ্যে শুরু হয় অদেখা বর্ষন। ভাল বাঁচা বেঁচে গেছি। এই সময় যদি খাড়া পাহাড়টার ঢালে থাকতাম তাহলে যেকোন কিছু হতে পারত। বৃষ্টির এই তীব্রতা খুব কম দেখা যায়, অন্তত আমি দেখিনি। দৌড়ে কোনমতে একটা চমৎকার কাঠের পাটাতনের ঘরে গিয়ে উঠি। এটাও নাকি কারবারির ঘর। ভিজা কাপড় ছেড়ে শুকনা কাপড় পরে কম্বলের ভেতর ঢুকি; আহ কি আরাম! লাইটার দিয়ে সাদা রক্তশূন্য পা দুটি গরম করার চেষ্টা করি। সাথে থাকা ম্যাগী ন্যুডুলস ভেঙ্গে এমনি খাওয়া শুরু করলাম। ১ মিনিটেই সাবাড় ২ প্যাকেট সেদ্ধ না করা ন্যুডুলস। এটা অবশ্য আপেলের আইডিয়া। রাতে আপেলের রান্না করা খাবার খেয়ে কারবারি দাদার সাথে জম্পেশ আড্ডা দিয়ে শুতে গেলাম। টিনের চালে বৃষ্টির গর্জন কানে তব্দা লেগে যাওয়ার অবস্থা। থামার নামগন্ধ নেই। কাল সকালে কি হবে কে জানে!
ওহ আমরা তো আবার অফিসিয়ালি দেশের সর্বোচ্চ চূড়া হয়ে যাব ভুলেই গিয়েছিলাম। যদিও তাজিংডং দেশের শীর্ষ ২০ চূড়ার লিস্টে নেই তারপরেও এটা এখনো স্বীকৃত সর্বোচ্চ চূড়া হিসেবে। চমৎকার একটা রাতের পর দেখলাম সুন্দর একটা সকাল। তাজিংডং দেখে শেরখর পাড়া হয়ে বিকেল নাগাদ বোর্ডিং পাড়ায় গিয়ে পৌছাই। থেকে যাব এখানেই আজ। ঝিরিতে নেমে মনভরে গোসল করে নিলাম সবাই। গ্রামটা পড়ন্ত বিকেলে অদ্ভুদ সুন্দর দেখায়। রাতের বেলা বাশকোড়ল আর আরিফিনের হাতের অমৃতসম খিচুড়ি খেয়ে রাত একটার দিকেই শুয়ে পড়লাম সবাই। পরদিন পদ্মঝিরি হয়ে থানচির উদ্দেশ্যে হাটা দেই। র্যাম্বোকে সুমন কোলে নিয়েই পার হয় উন্মত্ত পদ্মঝিরি, কারন সুমন বুঝে গিয়েছিল র্যাম্বো এটা পার হতে পারবে না। আরামসে খালি পেটে ট্রেক করতে করতে থানচি পৌছে গেলাম আড়াই ঘন্টার মধ্যেই। সিঙ্গারা আর কোক পেয়ে সবাই আনন্দে আত্নহারা। ভরপেট সিঙ্গারা খেয়ে বান্দরবানের বাসে চড়ে বসি। সিট না পাওয়ায় দুজন বাদে সবাইকে ইঞ্জিনের উপরের সিটে বসতে হল। কথা হচ্ছে আপেল র্যাম্বোকে নিয়ে বান্দরবান তারপর সেখান থেকে রুমা নিয়ে যাবে। অতঃপর তাকে তার ঠিকানায় পৌছে দেবার ব্যাবস্থা করবে। সুমন র্যাম্বোকে তার সিটের পাশে বসিয়ে নিল। কিছুক্ষন পর ড্রাইভার জানাল কুকুর নিয়া যাওয়া যাবে না; আমার বাসে এসব চলব না। সুমন র্যাম্বোকে তার কোলে নিয়ে বসল এবার। বাস চলা শুরু করল। র্যাম্বোও চুপচাপ বসে আছে সুমনের কোলে। কয়েক কিলো যাওয়ার পর ড্রাইভার আর হেলপার বলল এখল লোকাল যাত্রী উঠবে। বাসে কুকুর দেখলে প্যাসেঞ্জার নাকি উঠবে না। র্যাম্বোকে বাসের বাইরের দিকে যে বক্সের মত থাকে ওটার ভিতর ঢুকিয়ে দিতে বলল তারা; আমরা কিছুতেই র্যাম্বোকে ছাড়ব না। অনেকক্ষণ তর্ক করেও কোন লাভ হল না। আমরা র্যাম্বোকে ঐ বক্সের মধ্যে রেখে আসতে বাধ্য হলাম। র্যাম্বোকে ঢুকিয়ে বক্সটা আটকে দেয়া হয় ভালোভাবে। ভেতর দিয়েও ওর বের হবার কোন জায়গা নেই। ও ঠিকমত শ্বাস নিতে পারবে কিনা, ওর কতটা কষ্ট হবে এসব ভাবছিলাম। সবাই বেশ মনমরা হয়ে গেল। সুমন ব্যাপারটা এখনো মানতে পারছে না। বাস চলছে। সবাই চিন্তিত ওকে নিয়ে। লম্বা এক জার্নির শেষে সন্ধ্যার পর আমরা বান্দরবান সদরে এসে পৌছলাম।
বাস থামা মাত্র নেমে হেলপারকে সেই বক্সটা খুলে র্যাম্বোকে বের করে আনতে বলল সুমন। হেলপার গিয়ে বক্স খুলছে আমরা সবাই র্যাম্বোর জন্য অপেক্ষা করছি, ও সুস্থ আছে তো?! শঙ্কা মনের ভেতর। হেলপার বক্স খুলল, কোথায় র্যাম্বো? র্যাম্বো নেই। বক্স পুরো ফাঁকা। আমরা আকাশ থেকে পড়ি। ভেতরে ভালো করে চেক করেও র্যাম্বোকে পেলাম না। ড্রাইভারকে ধমকের সুরে সুমন আর আপেল বলল “আমার কুকুর কই? কি করসস তুই বল। রাস্তায় কই ছাইড়া দিসস?” হেলপারও অবাক, ও কি বলবে বুঝতে পারছে না, কসম কাটা শুরু করে সে নাকি ঐ বক্স যেটা থানচিতে আটকানো হয়েছে সেটার কাছেও যায় নাই। খুলে দেবার প্রশ্নই আসে না। হেলপারও খুলেনি, ভেতর দিয়ে বের হবারও কোন রাস্তা নেই- এটা কিভাবে সম্ভব? অবাক বিস্ময়! সুমন আর আপেল হেলপারের সাথে ঝগড়া করে কোন ফল পেল না। হেলপার কথা দেয় সে র্যাম্বোর খোঁজ করবে। হেলপারের আর ড্রাইভারের ফোন নাম্বার নিয়ে নেয়া হল। শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাস স্ট্যান্ডে এসে টিকিট কেটে বসে আছি, আপেলকে বিদায় দেবার আগে বারবার বলেছি ব্যাপারটা লালা বমকে জানানোর জন্য।
অবিশ্বাস্য এই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি বাসে বসে। সবার মুখে একই কথা। কেউ কেউ বলছে র্যাম্বো আসলেই কুকুর ছিল তো নাকি অন্য কোন সুপার ন্যাচারাল কিছু। কেউ কেউ এটাও বলছে যে র্যাম্বো নিজের জীবন দিয়ে আমাদের সবাইকে সুস্থভাবে বাসায় ফেরত যাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিল। অযৌক্তিক হলেও অইসময় কথাগুলি কেন যেন বিশ্বাসযোগ্যই মনে হচ্ছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই ক্লান্ত শরীর ঘুম এর সাগরে ডুব দিল। বাসায় ফিরে এসে আমরা অজস্রবার আপেলকে ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছি র্যাম্বোর কোন খোঁজ মিলেছে কিনা। ড্রাইভার আর হেলপারকেও থ্রেট এর উপর রাখা হয়েছে। তিনদিন পর সকাল সাতটায় আপেলের ফোন; ঘুম ভেঙ্গে ফোন রিসিভ করে শুনতে পেলাম র্যাম্বোকে আলীকদমে পাওয়া গেছে। আর্মিরা ওকে তাদের হেফাজতে রেখেছে। ওকে দ্রুত কেওক্রাডং ফিরিয়ে দিয়ে আসার দায়িত্বও নাকি আর্মিদের। পৃথিবী আসলেই সুন্দর এবং রহস্যময়। র্যাম্বো ভালো থাকিস তুই।