ভোর সাড়ে পাচঁটা। সূর্য্য এখনো ওঠেনি, কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়তো উঠবে। সকালের আজকের সকালটা হবে একটু অন্যরকম। একটু নয় অনেক বেশি অন্যরকম। সে আজ থেকে নিজেকে নতুন করে চিনবে। ব্যাপারটা তাঁর কাছে অনেক বেশি বেখাপ্পা লাগছে। সে বাস্তবে দেখতে যেমন আসলে তাঁর তেমনটা হওয়ার কথা ছিল না। তাঁর হওয়া উচিত ছিল অন্যরকম। সকাল বিচক্ষন ছেলে। সে মাথা খাটিয়ে যুক্তি ব্যবহার করে চিন্তা করতে চাইছে। কিন্তু হুটকরেই সে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না; ধকল সামলানোটা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ছে তাঁর জন্য। সকাল একবার একবার ভাবছে তাঁর এই সমস্যাটা পুরোপুরি মানসিক। আবার সে নিজের সাথে দ্বিমত পোষন করছে। কারন সে কলম দিয়ে দাগ কেটে বলে দিতে পারছে যে এর পরের অংশটুকু তাঁর নয়, অন্য কারো। যদি ব্যাপারটা পুরোপুরি মানসিক হত তাহলে সকাল কখনোই নিশ্চিতভাবে রেখা টেনে বলে দিতে পারত না যে এর পরের অংশটুকু সে শুধুশুধুই বয়ে বেড়চ্ছে। তাহলে কি ব্যাপারটা মনোদৈহিক? নাকি পুরোটাই দৈহিক?
বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আবারো স্থির হতে চাইছে সে। অদ্ভুদ এক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে নতুন একটি সকালকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছে সে। বাসার কেউ এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। সে নিজেকে আরো ভালোভাবে বুঝতে চাইছে। আরো সময় নিতে চাইছে সে। সে কখনোই চায় না কেউ তাঁকে মানসিক বিকারগ্রস্থ ভাবুক। সব চেয়ে বড় কথা কেউ তাঁর সমস্যাটা বুঝবে না। এটা এমনি এক অনুভূতি যা কখনো কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়, এটা সকাল ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছে। তাই সে তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্য আট দশটা সকালের মতই হবে আজকের সকালটা, আজকের দিনটা- এমনকি সামনের দিনগুলি। আপাতত সে আর কিছু ভাবতে চাইছে না।
তীব্র একটা মানসিক অশান্তিকে সঙ্গী করে সকাল তাঁর সময়গুলো পার করে দিচ্ছে। তবে তাঁর জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে বেশ কিছু। সে এখন আগের মত কারো সাথেই মেশে না, বাসার বাইরে যায় না খুব জরুরী কাজ ছাড়া। বন্ধুবান্ধব আত্নীয়-স্বজন কারো সাথেই মিশতে চায় না সে। কেমন যেনো একটা অস্বস্তি বোধ হয় তাঁর। তবে তাঁর এই অস্বাভাবিক আচরন যাতে কেউ খুব সহজেই বুঝতে না পারে সে ব্যাপারেও সকাল সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখে। সকাল দুর্বল চিত্তের ছেলে নয়, যথেষ্ট কঠিন মনমানসিকতার ছেলে সে। প্রতিরাতে সে বারান্দায় বসে বসে নিজের এই রহস্যজনক নিয়তির কারন অনুসন্ধান করে, কিন্তু কোন উত্তর খুজেঁ পায় না। কখনো কখনো বারান্দায় হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে- চাঁদের দিকে প্রশ্ন বান ছুড়ে দিতে দিতে। কখনো ঘুমুবার আগে এমনটা ভাবে- যদি এমন হয় ঘুম ভেঙ্গে দেখি সব আগের মত ঠিকঠাক। এমনটা সে কতবার ভেবেছে তা সে নিজেও জানেনা।
কেটে যাচ্ছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। সকাল তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালিয়ে যাচ্ছে নিজের সাথে নিজে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে। সে যে এখনো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেনি এটা ভেবে সে নিজেই হতবাক হয়। তবে তার মধ্যে ইদানিং একটু বেশি আক্রমনাত্নক ভাব চলে এসেছে এটা সে বুঝতে পারছে। বাড়তি যে অঙ্গটা সে বয়ে বেড়াচ্ছে সেটার প্রতি তাঁর বিন্দু মাত্র মায়া নেই; বরঞ্চ রয়েছে আক্রমনাত্নক মনোভাব। সে পারলে নিজেই কেটে সেটাকে আলাদা করে ফেলে দেয় বারান্দার গ্রীলের মাঝখান দিয়ে। কলম দিয়ে খুচিয়ে, ধারালো জিনিস দিয়ে আঘাত করাটা এখন তাঁর কাছে নিত্তনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলাটা এখন তাঁর সময়ের ব্যাপার মাত্র, বুঝতে পারছে সে। কিছু একটা করাটা খুব বেশি জরুরী।
সকাল সিদ্ধান্ত নেয় তাঁর ডক্টর আঙ্কেলকে ব্যাপারটা খুলে বলবে এই শর্তে যে সে কারো সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করবে না, ব্যাপারটা তাদের দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ডক্টর নেয়ামত আলী সকালদের পারিবারিক ডাক্তার। সকালের বাবার সাথে বেশ ভালোই ওঠাবসা তাঁর। প্রায়ই তিনি আসেন সকালদের বাসায়। সকাল ঠিক করে সে কালই যাবে ডক্টর আঙ্কেলের চেম্বারে। প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে সে।
চলবে...