ধানমন্ডি থেকে প্রতিদিন সকালে অফিসে আসার সময় আমাকে খামারবাড়ি অতিক্রম করে আসতে হয়, এতদিন হইচই আর জ্যামে ঠাসা ঠাসি জায়াগাটা পার হবার সময় বেশিরবাগ দিনই হয়ত আধঘুমে থাকতাম বিরক্তি নিয়ে কিন্তু আজকাল জায়গাটা যেন প্রানকাড়া মোহনীয় রূপ ধারন করেছে। জায়গাটায় পৌঁছালে অন্যরকম ভাল লাগা আর প্রশান্তিতে ভরে যায়। খামার বাড়ি থেকে ফার্মগেটের বড় সড়ক পর্যন্ত পুরোটা রাস্তা জুড়ে শুধু ফুল আর ফুল, হরেক রকমের হরেক রঙয়ের গোলাপ, গ্ল্যাডিওলাস নাম না জানা অর্কিড, রজনিগন্ধ্যা ইত্যাদি ফুল যেন নেশা ধরিয়ে দেয়।
তবে ঢাকাবাসিদের কাছে ফুলের কদর বরাবরই অনেক বেশী, মোগল আমলের নবাব থেকে শুরু করে জমিদার অভিজাত শ্রেণীর কাছে ফুলের সমাদর প্রায় কিংবদন্তীতুল্য। সমগ্র ঢাকা শহর জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য ফুল বাগিচা। এইসব ফুল বাগিচাগুলি এখন আর টিকে না থাকলে বাগিচাগুলোর নাম বুকে ধারন করে কালের সাক্ষী হয়ে আজো বেঁচে আছে ফুল বাগিচা গুলোকে ঘিরে গড়ে উঠা অসংখ্য এলাকা/মহল্লা। যেমন : শাহবাগ, লালবাগ, দিলকুশা- সেই বিখ্যাত দিলকুশা গার্ডেন, হাজারীবাগ, মোমিনবাগ, বাগে হসেনুদ্দিন, শান্তিবাগ, নবাব বাগিচা, বাগে মুসা, চামেলীবাগ, পরীবাগ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এইসব বাগান পরিচর্যা করার জন্য সরকার, আমির উমরারা গড়ে তুলেছিল বিশাল মালী সমাজ। এখানে বলে রাখা ভালো যে ঢাকা শহরের ঐতিহ্য অনুসারে কোন এলাকার নাম অই এলাকা যে জন্য বিখ্যাত সেই অনুসারে হয়ে থাকে যেটা আমরা ফুলবাগিচার নামানুসারে এলাকার নামকরনে দেখেছি। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কোন একটি এলাকা গড়ে উঠা কিংবা নাম নির্ধারণ করা হত ওই এলাকায় বসবাসকারী অধিবাসীদের পেশা অনুযায়ী। ঢাকা শহরের বিখ্যাতসব ফুল বাগিচাগুলোর পরিচর্যায় নিয়োজিত বিশাল মালী সমাজের বসবাসের জন্য গড়ে উঠেছিল মগবাজার সংলগ্ন মালিটোলা এবং অদুরেই মালিবাগ। ফুলবাগিচার এত ছড়াছড়ি ছিল যে মালিদের পাশাপাশি "মালাকার" নামে আরেকটি পেশাজীবী সমাজ গড়ে উঠেছিল , তাদের নামে মালাকার টোলা নামে একটা এলাকা ও গড়ে উঠেছিল। সেইসব মালাকারদের কাজ ছিল ফুলের মালা, গহনা, সেহরা প্রভৃতি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করত। সেই সময় থেকেই ঢাকাবাসীরা বিয়ে কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফুল ব্যবহার করত আর হিন্দু সম্প্রদায় তাদের পুজো পার্বণে এইসব মালাকারদের কাছ থেকে তাজা ফুল, ফুলের মালা সংগ্রহ করত। এইসব ফুল বাজারের মধ্যে বিখ্যাত ছিল ফুলবাড়িয়া, আরেকটি ফুলের বাজার এখনো ধুকে ধুকে টিকে আছে বাবুবাজার ফাঁড়ির কাছে যা কুমোরটুলির অভিযাত্রী বাবুদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল।
সেইসব ফুল বাগিচাগুলো ও নাই, নাই ফুলের বাজার গুলো শুধু শাহবাগটাই টিকে আছে ফুলের বাজার হিসেবে যদিও বাগিচাটা আর নেই। তবে গত বেশ কয়েক বছর ধরেই ঢাকা শহরে আবার ফুলের জয় জয়কার, বড় বড় রাস্তার পাশে জমকালো ফুলের দোকান। বিভিন্ন অনুষ্ঠান গুলোতে ফুলের ব্যবহার ও বেড়েছে। সেই বড় বড় বাগিচাগুলো আর ফিরে পাওয়া না গেলেও হরেক রকম আর হরেক রঙের ফুলে ছেয়ে যাবে প্রতিটা অলিগলি আর রাজপথ, সৌন্দর্য আর সুগন্ধে নাড়া দিবে প্রতিটা ইট পাথরের প্রাণ, প্রত্যাশা রইলো।