পোশাক শিল্পে খুব ঘনিষ্ট ভাবে কাজ করার কারনে আমাদের নারী কর্মিদের ব্যাপারে অনেক সমস্যা এবং জটিল বিষয়ের সম্মুখীন হতে হয়। কমপ্লায়েন্স মানা যে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্ব কালীন ছুটি এবং ভাতাদি দিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানে একটা শর্ত থাকে “ সন্তান একটি হলে ভাল হয়, দুটোর অধিক মোটেও নয়” । এভাবে চলছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু একটি সন্তানে ত কোন দম্পতি খুশি থাকে না তাই তারা একের অধিক সন্তান নেন, তাতে কোন সমস্যাও না, যার যার চাহিদা অনুযায়ী খোদার ফজলে সন্তান নেবেন, তাতে আল্লাহ বরাকাহ দেবেন, সন্দেহ নেই। আমার আলোচ্য বিষয় অন্য দিকে , অন্য কিছু ফোকাস করার চেষ্টা করছি, দেখি কতটুকু সামনে আনা যায়।
পোশাক সেক্টরে মাতৃত্ব কালীন ছুটি তিন মাস এবং তিন মাসের বেতন ভাতা দিয়ে দেওয়া হয় যা নিয়ম অনুযায়ী ৬০ থেকে ৭০ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে নারী কর্মিদের ক্ষেত্রে। এই উল্লেখিত পরিমান অর্থ বিশাল একটা ব্যাপার একজন পোশাক কর্মির ব্যাপারে। এই অর্থ পেতে হলে গর্ভকালীন সময় থেকে কতৃপক্ষের এম বি বি এস ডাক্তার এবং প্রশিক্ষিত নার্স এর তত্ত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা এবং নিয়মিত রুটিন ফোলয়াফ থাকে। সর্ব শেষ কোন হাসপাতালে নিরাপদ প্রসব পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের মেড়িকেল টিম এবং অফিস টিম খুব যত্নের সাথে তদারকি করেন এবং নিয়মিত খোঁজ খবর রাখেন ।
মাতৃত্ব কালীন যেই ভাতা এবং বেতনের কথা বলা হয়েছে তা দুই কিস্তিতে দেওয়া হয়, যখন কোন কর্মি মাতৃত্ব কালীন ছুটিতে যাবেন তখন তাকে হিসেব অনুযায়ী অর্ধেক টাকা দিয়ে দেওয়া হয় এবং সন্তান প্রসবের পর প্রয়োজনীয় উপযুক্ত ডকুমেন্ট সাবমিট করে বাকি টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু দেখা যায় অনেক দুষ্ট কর্মী সন্তান প্রসবের পর আর কাজে যোগ দেয় না, প্রথম কিস্তির টাকা নিয়েই উধাও হয়ে যান। আর এক ক্যাটাগরীর কর্মি আছে যারা যথাযত নিয়ম মেনে স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে হাসপাতালে গিয়ে সন্তান প্রসব করান না এবং দ্বিতীয় কিস্তির মাতৃত্ব কালীন টাকা নিতে আসলে কোন ডকুমেন্ট সাবমিট করতে পারে না যা টাকা প্রদান করতে অনেক সমস্যা হয়। এই সমস্যা হওয়ার পেছনের কারন অনুসন্ধান করে যেটা পাওয়া গেছে টা হল স্বামীর অসেচতনতা বা লোভ, স্বামী হয়ত বেকার বা ঘুরে ঘুরে স্ত্রীর ইনকাম থেকে খায়, সেই ক্ষেত্রে স্ত্রী বাঁচল কি মরল তার কোন গুরুত্ব তার কাছে থাকে না তার প্রধান উদ্যেশ্য থাকে মাতৃত্ব কালীন যেই ভাতা হাতিয়ে নিয়ে কিছুদিন আরাম আয়াশে চলা।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু দুষ্ট কর্মী দুই সন্তানের অধিক সন্তান নেন এবং তথ্য গোপন করেন। পোশাক সেক্টরে চাকরী বদল করার একটা সুযোগ রয়েছে , ইচ্ছে হলেই চাকুরী থেকে ইস্তপা দিয়ে অথবা আন অথরাইজ এবসেণ্ট করে নতুন কোন কারখানাতে যোগ দেন, যেহেতু আমাদের দেশে সবসময় দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা প্রচুর, তারা চাকুরী পেয়ে যান। কিন্তু বাস্তবতা হলো তারা এর আগে অন্য কারখানাতে দুইটা সন্তান নিয়ে ফেলেছে এবং সমস্ত সুবিধা ভোগ করেছে এবং নতুন প্রতিষ্ঠানে ৬ মাস একবছর কাজ করে আবার গর্ভবতী হন। এটা ন্যায় পরিপন্তি এবং সম্পুর্ন চৌর্যভিত্তি । এই ক্ষেত্রে যদি ধরা পড়ে তবে তিনি সন্তান নিতে পারবেন এবং ছুটি ও পাবেন কিন্তু ভাতা পাবেন না। অতচ দুষ্ট শ্রমিক একং তার স্বামীর গোপন অভিপ্রায় ছিল আগের তথ্য গোপন করে তৃতীয় সন্তানের বেলায় ও প্রতিষ্ঠান কতৃপক্ষের কাছ থেকে মাতৃত্ব কালীন সুবিধা ভোগ করা। যখন আগের ঘটনা ফাঁস হওয়ার কারণে ভাতা পাবেনা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় তখন তাদের তদবির শুরু হয় সন্তান নষ্ট করার এবং তখন তারা গোপনে এবরসন করিয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে। এই ব্যাপারে অনেক কাউন্সিলিং এবং ট্রেনিং করেও কর্মিদের সচেতন করা যায় না।
পোশাক শিল্পে আর একটা বিষয় হয় যেটা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত প্রেম, যার কারনে ঝুকিপুর্ন মেলামেশার কারনে অনেকেই অনিয়ন্ত্রিত গর্ভপাত বা এবরসন করানোর মাধ্যমে অল্প বয়সেই মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে। এই বিষয়ে কতৃপক্ষের কিছুই করার থাকে না, যখন আন অথরাইজ অনুপস্থিত থাকে কেউ, তখন তদন্ত করার সময় এই সমস্ত অনাখংখিত বিষয় সামনে চলে আসে এবং তখন সমাধান করার কিচ্ছুই থাকে না। এই সব অযাচিত বিষয় থেকে দূরে থাকার জন্য ডাক্তার নার্স নিয়মিত কাউন্সিলিং করে থাকেন, এই সমস্ত কাউন্সিলিং এ অনেক সময় আমি নিযেও উপস্থিত থেকে অনেক কিছুই জানার সুযোগ হয়। আমি খেয়াল করলাম এই প্রান্তিক শ্রমিক শ্রেনীর মানুষদের আর অনেক বেশী সচেতন করা এখন সময়ের দাবি। অতচ সেই রকম কিছুই সরকারি বা বেসরকারি ভাবে দেখা যাচ্ছে না। এই ব্যাপারে সেটেলাইট মাধ্যম বা প্রিন্ট মিড়িয়া খুব বড় ভুমিকা রাখতে পারে।
যখন শুধুমাত্র বিটিভি ছিল তখন খুব মার্জিত বিজ্ঞাপন হোতো কনডম বা পিল এর । দেখলেও সবসময় বুঝতাম না কিসের বিজ্ঞাপন দেখানো হল । প্রশ্ন করতাম বড়দেরকে । তারা লামছাম একটা বুঝায় দিতেন । আমরাও তাতেই সন্তুষ্ট থাকতাম ।
ছোট্ট কিন্তু তার মাঝেই ম্যাসেজ থাকতো পরিবার ছোটো রাখার ।
আমাদের পাশের দেশ ইন্ডিয়া । তাদের জনসচেতনতামূলক কিছু বিজ্ঞাপন আছে । STD (যৌনবাহিত রোগ ),বা পুরুষ বন্ধ্যাত্বকরণ ,নারীদের যৌন সমস্যায় লজ্জা না করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া , 'এবরসন হইতে ইমারজেন্সি পিল উত্তম' এর এড ।
এই বিজ্ঞাপনগুলো শুধুমাত্র তাদের সরকারি চ্যানেল এ নয় সব চ্যানেলেই প্রচারিত হয় । না হলে আমরা নিসচইয় দেখতে পেতাম না ।
আর আগেও আমাদের দেশে এমন জনসচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন সরকারি চ্যানেল 'বিটিভি'তে প্রচার হোতো এখনো তাই ।
আচ্ছা বিটিভি এখন কতজন দেখে ?
খুবই কম । বাধ্য না হলে কেউ বিটিভি দেখে না ।
আর আমাদের দেশে যেসব বিজ্ঞাপন হয় জন্মবিরতিকরন সামগ্রীর সেগুলোতে যত না পরিবার ছোটো রাখার ম্যাসেজ দেওয়া হয় তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় যেন 'কোনটি বেশি তৃপ্তিদায়ক' তার ওপরে ।
মানলাম এটারও দরকার আছে । কিন্তু এগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য যে জন্মসংখার হার কমানো সেটা কোথাও বোঝানো হয়না ।
একটা ট্রাক ড্রাইভার বা রিক্সাচালক তাদের 'তৃপ্তি' প্রয়োজনীয় নাকি 'পরিবার ছোটো' রাখার পরামর্শ ?
জনসচেতনতার নাটিকাগুলো কোনও বেসরকারি চ্যানেলে দেখানো হয় না । তাদের ব্যবসার ক্ষতি হবে বলে । যে কয় মিনিট ওই নাটিকা দেখানো হবে সেটা পুরাই লস প্রজেক্ট । তার চাইতে টেলিকম বা যেকোনো বিজ্ঞাপনে মুনাফা বেশি !!!
হায়রে । দেশের জন্য এইটুকু দায়বদ্ধতাও কারো নেই ।
এবার আসা যাক জন্মবিরতিকরন পিল এর ব্যপারে ।
এই জিনিসটি যে শুধু একটি কাজই করে তা কিন্তু নয় । মেয়েদের 'নিয়মিতভাবে অনিয়মিত পিরিয়ড' সমস্যার সমাধান এই জন্মবিরতিকরন পিল । অনেক মেয়েরই পিরিয়ডে নানারকম সমস্যা থাকে ;অনিয়মিত,সাইকেল ছোটো বা বেশি দীর্ঘ, ঘন ঘন পিরিয়ড। সাধারণত সাইকেল হয় ২৮-৩২ দিনের । সবার এমনটা নাও হতে পারে । যাদের সমস্যা হয় ডাক্তার তাদেরকে পিরিয়ড নিয়মিত করার জন্য পিল খাবার পরামর্শ দিয়ে থাকে । সেটা মেয়েটি বিবাহিত বা অবিবাহিত তার ওপরে নির্ভর করেনা । তারসাথে রক্তাল্পতার সমস্যা সমাধানের জন্যও পিল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন অনেক ডাক্তার ।
এখন কোনও অবিবাহিত মেয়ের কাছে পিল আছে মানেই সে যার তার সাথে 'শুয়ে বেড়ানো' নিরাপদ রাখতেই পিল খায় তা নয় । নিজের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক রাখতেই ডাক্তারের পরামর্শে পিল খেতে হচ্ছে । যেটা কখনোই আদিম রসাত্মক কোনও ঘটনা নয় ।
বয়ঃসন্ধিতে নানা সমস্যার কথা মেয়েরা কারো কাছে শেয়ার করতে পারে না ,তারাই পরবর্তী জীবনে বেশি ভোগে নানা মানসিক এবং শারীরিক সমস্যায় ।
এসব দেখারও কেউ নেই । কথা বলাও বারণ ।
সামাজিক দায়বদ্ধতা কি শুধুমাত্র সরকারের একার ? ইলেক্ট্রনিক বা প্রিন্ট মিডিয়া এসব নিয়ে কথাই বলে না । কয়েক মিনিটের জন্য সাজুগুজু করা ডাক্তারকে এনে দু-চারটা কথা বলিয়ে হাজারটা বিজ্ঞাপন দেখিয়েই তারা খালাস । আর প্রিন্ট মিডিয়া 'নারী পাতা' নামে একটা পাতা ছেপে তারাও খালাস ।
সবাই আছে যার যার ধান্দায় । অথচ একটুখানি এগিয়ে আসাই কমাতে পারে অনেক সমস্যা ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১:৫২