জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা-– ইউনেসকো। ৩১ অক্টোবর এই স্বীকৃতি দেওয়ার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এতদিন যে ভাষণ ছিল বাঙালির জাগরণ ও আত্মপ্রত্যয়ের অবিনাশী বাণী, এখন তা পরিণত হল বিশ্বসম্পদে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই বজ্রনির্ঘোষ কন্ঠধ্বনি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় মূর্ত রূপ দিয়েছিল। যুদ্ধজয়ে প্রাণিত করেছিল। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ভাষণের কথা আমরা জানি। কিন্তু সেসব ভাষণ ছিল লিখিত। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল অলিখিত। এই ভাষণের পর আন্তর্জাতিক মিডিয়া তাঁকে ‘পোয়েট অফ পলিটিক্স’ বা রাজনীতির কবি হিসেবে অভিহিত করেছিল।
বক্তৃতামঞ্চে উঠেই বঙ্গবন্ধু সমবেত লাখো জনতাকে আপন করে নিয়েছিলেন ‘ভায়েরা আমার’ বলে সম্বোধন করে। তিনি কোনো ভণিতা না করে সরাসরি জনতার কাছে তাঁর উপস্থিতির কারণ তুলে ধরে বলছিলেন,
“আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি– আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে।”
এই তিনটি মাত্র লাইনেই তখনকার অবস্থা বর্ণনা শেষ করে তিনি চলে যান তাঁর পরবর্তী প্রসঙ্গে। বলেন,
“আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়– তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়।”
সংক্ষিপ্ত বয়ান কিন্তু মানুষের বুঝতে কষ্ট হয় না। পেছনের ঘটনা তুলে ধরতেও বেশি শব্দ ব্যবহার করেন না। বলেন,
“নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে।”
এবার বাঙালির অধিকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতা তুলে ধরেন মাত্র কয়েকটি বাক্যে। অথচ কারও বুঝতে সমস্যা হয়নি। কারণ উপস্থিত জনতার অধিকাংশই ছিলেন এই ইতিহাসের সাক্ষী। বঙ্গবন্ধু ইতিহাস বর্ণনা করেন এইভাবে:
“কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।
এভাবেই চলে ১৮ মিনিটের ভাষন, চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়ার আগে তিনি পাকিস্তানিদের শেষ সতর্কবার্তা দেন এইভাবে:
“শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই ভাই হিসেবে বাস করার সম্ভাবনা আছে, তা না হলে নেই। বাড়াবাড়ি করবেন না, মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”
জনগণের উদ্দেশে বলেন,
“প্রস্তুত থাকবেন, ঠাণ্ডা হলে চলবে না। আন্দোলন ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন। আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। শৃঙ্খলা ছাড়া কোনো জাতি সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে না।
আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।”
একেবারে শেষে এসে তিনি উচ্চারণ করেন সেই চূড়ান্ত বাক্যটি:
“এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
এই বজ্রকণ্ঠ ঘোষণাই ছিল আসলে আমাদের, বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ঘোষণা। তাঁর এই ভাষণ বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের কালজয়ী অনন্য দলিল, এখন তা, মফিদুল হকের ভাষায়– বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক।
শেষ করছি কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে:
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২০ সকাল ১০:০৩