নবান্ন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব।কিন্তু তা আজ পিঁয়াজের ঝাচে ম্লান হয়ে গেছে। বাংলাদেশের কোথাও কি নবান্ন খুঁজে পাবেন ??
পাওয়া যাবে টেলিভিশনে, আজকে সকালে বিভিন্ন টি ভি অনুষ্ঠানে ১লা অগ্রহায়ণের বিভিন্ন অনুষ্ঠান । বাস্তবে কোথায় কী আছে ??
বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম।"নবান্ন" শব্দের অর্থ "নতুন অন্ন"।নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
একদা অত্যন্ত সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব উদযাপন হত, সকল মানুষের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে নবান্ন উৎসব সমাদৃত ছিলো।কালের বিবর্তনে গ্রাম বাংলায়,ঐতিহ্যবাহী এই নবান্ন উৎসব বিলুপ্তপ্রায়। তবে টিভিতে কিছু কিছু নবান্নের ছোঁয়া দেখা মেলে।
আজ নবান্নের তাড়নায় মনে পড়ছে কবিগুরুর সভ্যতার প্রতি -লেখা কবিতার লাইন দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর! রবী ঠাকুরের এই কবিতার সাথে সবাই ই কম বেশি পরিচিত। পুরো কবিতা যদি আমরা কেউ কেউ নাও জেনে থাকি তবুও মাধ্যমিকে পড়েছেন আর কবিতার প্রথম লাইনটি দেখেননি বা ঐ লাইনটি নিয়ে কিছু লিখেননি এমন কেউই নেই। কত আগে লেখা কবিতা অতচ আজকের জন্য কত বাস্তবিক এই লাইন।
গত ক’দিন আগে নেটে উপরের কবিতাটি খুজতে গিয়ে নিম্নোক্ত গবেষণা রিপোর্টটি দেখতে পাই।
"এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক মানুষের মস্তিষ্কের ওপর শহুরে যান্ত্রিক পরিবেশ ও গ্রামীণ নৈসর্গিক দৃশ্যাবলির তুলনামূলক প্রভাব বিশ্লেষণ করে দেখতে পান, গ্রামীণ নিসর্গ মানুষের মনে প্রশান্তি জাগায়। অন্যদিকে শহুরে কৃত্রিম পরিবেশ মনে বিভিন্ন জটিলতা ও চাপ তৈরির জন্য দায়ী। আর সেই চাপ মানুষের আচরণেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যার পরিণাম ভোগ করে আজন্ম শহরবাসী। এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল ডেপলেডজ বলেন, শহরে বসবাসকারী ব্যক্তির মানসিক অবস্থার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় খাঁচায় সদ্য বন্দী পশুপাখির অনুভূতির তুলনা চলে।"
দেখতে পাবেন এখানে… http://politicalnews24.com/2013/12/13/9782
আমার কথা এখানেই শেষ করতে পারতাম, যেহেতু নবান্ন নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম তাই নবান্ন নিয়েই শেষ করতে হবে, কিন্তু শহরে তো আর নবান্ন হয় না, হবে কি করে শহরে কি আর নতুন আমন ধান কাটা হয়?? আমন ধানের ঘ্রাণ নিতে হলে গ্রামে যেতে হবে। গারমের কথাই যখন আসে তখন আর একটু পিছনে ফিরে যাই।
গত ইদের পর বেশ কিছুদিন অনলাইনের নিউজফিড জুড়ে একশ্রেণীর গ্রাম প্রেমিকের যে সাহিত্যভরা বক্তব্য দেখতে পেয়েছিলাম তা এককথায় ছিল বিস্ময়কর। রবী বাবু কিংবা প্রখ্যাত গ্রামীণ কবি বন্দে আলী মিয়াও যদি এই লিখাগুলো দেখতেন তবে নিশ্চিত তারাও বিস্মিত হতেন, এমনকি তাদের প্রকৃতি প্রেমও তুলনামূলক বিচারে কিনারে গিয়ে ঠেকতো!
আমি এখানে সেইসব বক্তব্যের কিছু নমুনা খন্ডিত আকারে না দিয়ে একসাথেই দিয়ে দিলাম…
“অনেকদিন পর গ্রামে গেলাম। আহ কি দারুন পরিবেশ! যানজট-ঝামেলাহীন এমন নির্মল পরিবেশ স্বর্গেই মানায়! সবুজের সমারোহ, পাখির কিচিরমিচির, বিশাল খেলার মাঠ, ধুলো মাখা মেঠো পথ, বড় বড় পুকুর, রাতের জোনাকি, প্রতিবেশির আতিয়েতা… ওহ, শহরে ফিরতে মনই চাচ্ছিল না! আর ক’টা দিন যদি এমন পরিবেশে থাকতে পারতাম?”
অনুগ্রহ করে ধৈর্য্য হারাবেন না, আমার এসব ফালতু লেকচারের মূল কারন কিন্তু আমার গ্রামীণপ্রীতি দেখানো নয়, বরং সংবাদপত্রের এই শিরোনামটি সামনে আনা।“ঢাকায় চিকিৎসক উপচে পড়ছে, গ্রামে পদ শূন্য : দৈনিক প্রথম আলো।
রিপোর্টটি থেকে জানা যায়,
“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ শয্যার স্ত্রীরোগ বিভাগে চিকিৎসক আছেন ২৮৪ জন। আর ঢাকার বাইরে ভোলা জেলায় চিকিৎসকদের ৭০ শতাংশ পদ খালি। ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে চিকিৎসকের পদ আছে ৩০টি, এর মধ্যে ২৫টিই শূন্য অথচ ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ ২১টি। কোনো পদ শূন্য নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সারা দেশে ৪৮১টি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের পদ আছে নয় হাজার ১৫০টি। ১ জানুয়ারির হিসাবে দুই হাজার ২৯৪টি পদে চিকিৎসক নেই। অর্থাৎ উপজেলা পর্যায়ে ২৫ শতাংশ পদ শূন্য।
এটা গড় হিসাব। কিন্তু রাজধানী থেকে উপজেলার অবস্থান যত দূরে, সেখানে শূন্য পদের সংখ্যা তত বেশি।
দেখতে পাবেন … Click This Link
এই হল আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের অবস্থা আর আমাদের প্রকৃত প্রকৃতি প্রেম! যে লোকটি ভ্রমণের জন্য গ্রামকেই বেছে নিতে বেশি পছন্দ করে সেই গ্রামে দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানায়! শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ নয়, প্রতিটি বিভাগেই যে কর্মকর্তা ছুটি নিয়ে মাসের পর মাস গ্রামে কাটিয়ে আসতে পারেন সেই কর্মকর্তা সরকারী দায়িত্ব নিয়ে দুদিনও গ্রামে অবস্থান করতে পারেন না! গ্রাম থেকে শহরে বদলি হতে কেউ কেউ বড় অংকের ঘুষ পর্যন্ত ব্যায় করে থাকেন।
আসলে আমরা সবাই ই ঐ রকম। দায়িত্ব পালনে আমরা সবাই একধাপ পিছিয়ে। ব্লগ ফেসবুকে কুতুব আলীর ইয়া লম্বা প্রেমময় লুতুপুতু ইশটাটাশ খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তে আমরা যতটুকু আগ্রহী, পাঠ্য বইয়ের দুটি লাইন পড়তে ঠিক ততটুকু বিরক্তিবোধ করি। আমরা এমন, এমনই আমরা! এবার বলুন কিভাবে নবান্ন টিকে থাকবে ?? তবুও টিকে থাক নবান্ন আমাদের বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব হিসেবে। আর শস্যে ভরপুর থাকা আমাদের বাংলাদেশ এবং পিঁয়াজের দাম কমুক।!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:০২