১৯৭১
২৭ এপ্রিল বিকেল ৫টা। ছোট এবং সমৃদ্ধ শহরের দক্ষিন দিক থেকে হঠাৎ দ্রুম দ্রুম শব্দ। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণের আশংকায় ২৫ মার্চের পরেই শহরের পশ্চিম পারের গ্রামের বাড়িতে বসবাস আমাদের। ক্লাস ফোর এ পড়ি। প্রস্তুতি নেয়াই ছিল। সারা গ্রামের লোকজন ধীরে ধীরে বাড়ী ছেড়ে বেড় হচ্ছে। আমাদের বাড়ীর সবাই বেড় হতে হতে সন্ধ্যা প্রায়। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী আগুন লাগিয়ে দিয়েছে শহরটিতে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে আগুন স্পষ্ট হচ্ছে। শুরু হলো আমাদের অনির্দিষ্ট যাত্রা । শহর থেকে দূরে পালাতে হবে। ছোট নদীটার পশ্চিম পার দিয়ে , উত্তর দিকে হাটা শুরু। যতই সামনে যাচ্ছি , আগুন পিছু ছাড়ছে না। দিশেহারা জনতা বাড়ছে ধীরে ধীরে। শতশত , এরপর হাজার হাজার। হেড়িকেন , টর্চ লাইটের আলোতে চলছি সবাই। বিশাল কাফেলা , এক লাইনে হাটছি। বড় দুই ভাই শহরে ছিল। আগেই আব্বার কাছ থেকে অনুমতি নেয়া ছিল যুদ্ধে যাবার। শহরে পাকিস্থানি - হানাদার বাহিনী আসলে কি করতে হবে- প্লান করা ছিল আগেই। ছোট বোন একমাস বয়েসি। মাঝে মাঝে কেদে উঠছে। ৭১ এ জন্ম , মুক্তি নাম রেখেছে বড় ভাইয়েরা।
সারারাত হেটে পেয়ারা বাগানের মাঝ থেকে তেরআনা গ্রামে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয়। এরপর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু স্থান পরিবর্তন। অনাহারে অর্ধাহারে থেকেছি দিনের পর দিন। আতংকে রাতে ঘুমাতে পারেননি আব্বা আম্মা। আগষ্টে আব্বাকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্থানী - হানাদার বাহিনী , রাজাকারদের সহযোগীতায়। বরিশাল ক্যাম্পে চলে বিরামহীন অত্যাচার আব্বার উপর। বরিশাল বদ্যভুমিতে নিয়ে যায়। কলেমা পড়তে বলে অন্য সবার সাথে। সাথের ২১ জনকে মেরে ফেলে ওরা। সাথের সবাই পরে গিয়েছে , দাড়িয়ে শুধু একা আব্বা । কি মনে করে ছেড়ে দেয়া আব্বাকে ওরা। নির্যাতনে মেরুদন্ডে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছিলেন তিনি। আব্বা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে যন্ত্রনায় ভুগেছেন।
আব্বা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসায়- আমরা পুনরায় বাড়ী চলে আসি। বাড়িতে এসে শুনি, শহরে কিছুই নেই আমাদের । ২ টা বাড়ী রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজন ভেঙ্গে নিয়ে গিয়েছে। আট ভাগ করে -তারা আট টি বাড়ী বানিয়েছে। ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান আগুনে পুড়ে গিয়েছে। কিছুই নেই আমাদের। আমার চেয়ে একটু বয়সে বড়- এক ভাইয়ের সাথে খেয়া পাড়ি দিয়ে শহরে এসে শুন্য ভিটা দেখে হু হু করে কেঁদেছি অনেকক্ষণ আমি। ওইটুকু বয়সে যে কষ্ট যন্ত্রনা সহ্য করেছি ২৭ এপ্রিল থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত - তা কখনোই ভুলতে পারবো না আমি।
ইচ্ছে আছে ,ওই বয়সে দেখা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়কে নিয়ে কিছু লেখার। হয়ত লেখা হবে , হয়ত না।
১৯৭৫
১৫ আগস্ট ভোরে রেডিওতে শুনি বঙ্গবন্ধু নিহত। কেউই বিশ্বাস করতে পারিনি। বাসার সবাই আতঙ্ক গ্রস্থ । মেঝভাই ঢাকাতে। অনুষ্ঠান ছিল মরহুম আব্দুর রব সেরনিয়াবাদ এর বাসায়। খুব চিন্তিত বাসার সবাই। অনুষ্ঠান থেকে কি ফিরেছিল আমার ভাই ? নাকি অন্য সবার মত মৃত ? ফোন এ যোগাযোগ নেই। ৫ দিন পরে খবর পাই- মেঝ ভাই , অনুষ্ঠানে না গিয়ে ১৪ আগষ্ট বিকেলে শশুর বাড়ী জয়দেবপুর চলে গিয়েছিলেন। বেঁচে আছেন তাই।
রাজনৈতিক হয়রানী শুরু আবার আমাদের পরিবারের উপর। আত্মগোপন করেন বড় আরো তিন ভাই। এই তিন ভাই জাসদ ছাত্রলীগ করতেন , তারপরেও। আমি অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র। এই অবস্থায় বাসার পাশের গলিতে পাওয়া যায় ১ টা পিস্তল। আব্বাকে জিজ্ঞাসাবাদ আবার। শহর ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা । একদিন দুপুরে হঠাৎ খবর- আমাকে গ্রেফতার করা হবে। আমি আম্মা ছোট ভাইবোন - এক পুরুষ আত্মীয়কে নিয়ে , বাগেরহাটের দিকে রওয়ানা দিলাম। খান জাহান আলী (রা ) এর মাজারে ছিলাম ৩ দিন। এরপর খুলনা এক দুর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় । প্রায় মাসখানেক ছিলাম। আব্বা টাকা দিয়ে সব কিছু ম্যানেজ করার পর ফিরে আসি আবার প্রিয় শহরে।
২০০১
বিএনপি ক্ষমতায় আসলো। আমির হোসেন আমু ভাই এর শ্নেহ ভাজন হবার কারনে- প্রথমিক ভাবে ১৮ টি নির্মান কাজের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়। ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্লাক লিষ্ট করা হয়। অনেক প্রিয় রিভলবারটির লাইসেন্সও বাতিল করে - থানায় ওটা জমা দিতে বাধ্য করা হয়। সরকারের কাছে পাওনা বিল সব বন্ধ করে দেয়া হয়। বিশাল ব্যংক ঋণের বোঝা কাধে আমার। ২০০৩ পর্যন্ত এভাবেই চলেছে। কত টকা ব্যাংকে ইন্টারেস্ট দিয়েছি- তা বলে লাভ কি ?
এরপর ? ২০০৩ এর পর ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছে । বিল পেতে শুরু করেছি...... তবে
২০০৭ এর পর কিঞ্চিত সমস্যা হয়েছিল , কিন্তু শিখে গিয়েছি সবকিছু । এখন আর সমস্যা হবে না আশাকরি