somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিঠে ভূত

০৫ ই নভেম্বর, ২০০৭ সকাল ১০:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি হলেম পৃথিবীতে বাস করা পৃথিবীর বাইরের মানুষ। চোখের সামনে বসে থাকলেও আমি যে আসলে কোথায় থাকি, তল পাওয়া ভার। ক্লাসে বসে হিট ট্রান্সফারের খাতায় কবিতা লিখি। জানালা দিয়ে কাঁঠাল চাপা গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকি। আর কোকিল ডেকে উঠলে ক্লাস তো আমার মাথায় ওঠে। বসন্ত কালে যত কোকিল ডাকে সবই আমার পোষা কোকিল। ওরা কেবল আমার জন্যই মিষ্টি সুরে ডাকে। আমিও সারা বছর অপেক্ষায় থাকি কবে আমার কোকিল গুলো ডাকবে। ক্লাসমেটরা এই আমাকেই চিনে, একটু অন্যমনস্ক, কখনও খুব কাছের বন্ধু, কখনও চেনা, কখনও বা একেবারেই অচেনা একজন। মাঝে মাঝে ওরা আমাকে হুমকি দেয়, আজকে তোমার কোকিলের যন্ত্রনায় ক্লাসে মনযোগ দিতে পারিনি। আরেকদিন যদি মেশিন ডিজাইন ক্লাসে কোকিল ডাকে তাহলে তোমাকেই শ্যুট করবো। তোমার না পোষা কোকিল! আমিও বলি, ডাকবে, পুরো টার্ম জুড়েই এভাবে ডাকাডাকি করবে। ক্লাসের গুল্লি মারি। দেখি, তোমরা কি করতে পার! সেই আমাকে কিনা প্রায়ই সারারাত জেগে থাকতে হয়। পড়ালেখার চাপের জন্য যতটা তারচেয়ে বেশী অসময়ে ঘুমের কারণে। সেশনাল শেষ করে যখন রুমে ফিরি, তখন ঘুম আমাকে ডাকে, আয় আয় আয়! সারাদিনের ক্লান্তিতে দুচোখ আমার বন্ধ হয়ে আসে। কি আর করা! অতঃপর রাত্রি জাগরণ। গতবছর রোজার মাসে এমনি কোন এক নির্ঘুম রাতের শেষে ধূমায়িত কফির মগ হাতে নিয়ে তিনতলার দুটো ব্লকের লিংকিং করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এই জায়গাটা শেষ রাতের দিকে আমার বেশ ভালো লাগে। দারুন সুন্দর বাতাস আমাকে ছুঁয়ে যায়। হলের এই জায়গাটা থেকেই পুরো হলটাকে সবচেয়ে সুন্দর ভাবে দেখা যায়। আমার রুমের বারান্দা থেকে চাঁদ দেখা যায় না। চাঁদ দেখেতে আমাকে এখানে এসেই দাড়াতে হয়। একটু পরেই সেহরী খাওয়ার জন্য হলের ডাইনিং এ যেতে হবে। কফিটা শেষ করেই নিচে নামবো। হঠাৎ দেখি, লনের মাঝখান দিয়ে শোভা ডাইনিং এর দিকে যাচ্ছে। আমি উপর থেকেই একবার ওকে ডাকলাম। শোভা...! ও চমকে থমকে দাড়ালো! জায়গায় দাঁড়িয়ে একবার পুরো হলের দিকে তাকাল। ৩৬০ ডিগ্রী কোণে নিজের এক্সিসে ঘুরলো! আমিতো পুরো হতবাক। কি ব্যাপার, ভয় পেয়ে গেল নাকি? আমিও বেশ মজা পেয়ে গেছি। লনের গার্ডেন লাইটগুলো সব বন্ধ, আকাশেও সেদিন চাঁদ নেই। এমন পরিবেশে শোভা কি আমাকে অশরীরী ভাবলো নাকি! আরেকটু মজা করা যাক তাহলে। ও যখন চারপাশে কাউকে না দেখে, শোনার ভুল ভেবে আবারো হাঁটতে শুরু করেছে, লনের ঠিক মাঝখানে চলে এসেছে, তখন আরেকবার আরেকটু বেশী সুর করে ডাকলাম, শো...ভা...! শোভা এখন আমার স্পষ্ট দৃষ্টিসীমানার মধ্যে। নিজের চোখে দেখেই বুঝলাম ও ভয় পেয়েছে। স্তব্ধ হয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে! ভয়ে ভয়ে পুরো হলের দিকে তাকাচ্ছে! আমি কোনদিন কাউকে এভাবে ভয় পেতে দেখিনি। বেশ মজা লাগছে আমার, হাসি পাচ্ছে। এতোক্ষন অনেক কষ্ট করে হাসি চেপে রেখেছিলাম, আর পারলাম না। খিলখিল করে হেসে উঠলাম। আমার হাসির শব্দ শুনে শোভা উপরের দিকে তাকালো। আমার পরনে সাদা পোষাক, খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছি অন্ধকারে, হাসছি। বেশ কাঁপা কাঁপা গলায় মেয়েটা আমায় প্রশ্ন করল, তুমি কি শাতিল? হাসি আরেকটু বেড়ে গেল। জবাব না দিয়ে হাসতেই থাকলাম। শোভা তাকিয়েই আছে। এবার বেশ রহস্যময় গলাতেই বললাম, কি মনে হয় তোমার, কে আমি? শোভা নিরুত্তর। ওর ভীত চকিত অসহায় ভঙ্গি দেখে এবার একটু মায়া হল আমার। বললাম, হ্যাঁ, আমি শাতিল। হঠাৎ কি হল কে জানে, প্রায় দৌড়ে শোভা লন থেকে চলে গেল। আমারও এডভেঞ্চার শেষ হয়ে গেল এদফা।

এরপর কিছু দিন ও আমাকে দেখলেই সামনে থেকে সরে যেত, ওর চোখে ভয়ের ছায়া দেখতে পেতাম। মাস খানেক পর মনে হয় ওর ভয় কেটেছিল। একদিন বিকেল বেলা একা লনে বসেছিলাম। আকাশ দেখছিলাম। আকাশে মেঘের দৌড়াদৌড়ি দেখতে বেশ ভালো লাগে আমার। শোভা পাশে এসে দাড়াল, বসল। দুজনে বেশ কথা বললাম সেদিন। কিছু কিছু মানুষ আমার কথা বলার ভংগীতে মুগ্ধ হয়ে যায়, কেন হয় যে হয়, এটা এখনও আমার কাছে রহস্য! বেশ কয়েকজন আমাকে একথা বলেছে, সেদিন শোভাও বলল। শোভার জন্য যে আরো ডোজ বাকি ছিল, তা তো আর শোভা জানেনা। আমি ওর সাথে কথা বলছি, আর ওর চোখে মুখে মুগ্ধতা দেখছি। এই মেয়েটাকে আমার ভালোই লাগে, খুব বেশী একা, ওর ডিপার্টমেন্টের তেমন কারোর সাথেই ওর সখ্যতা নেই। পড়ালেখার বাইরে কারোর সাথেই মিশে না, কিন্তু খুব বেশী নিষ্পাপ। পঙ্কিল পৃথিবীটা আসলে ওর জন্য না। একটা সময় ওর দিকে তাকিয়ে মনে হল, ওর খুব মানসিক সমস্যা যাচ্ছে, খুব বেশী অস্থির হয়ে আছে। আমি প্রশ্ন করলাম,
--তুমি কি খুব সমস্যায় আছ? শোভা চমকে গেল।
--তুমি কি করে বুঝলে!
আমিও বুঝলাম, ও আসলেই সমস্যায় আছে, শুধু তাই না, এই মুহুর্তে আমি নিজেও যে ওর একটা সমস্যা সেটা ও জানে না। ও আমাকে এক্সট্রা অর্ডিনারী মানুষ ভাবছে! ভাবছে, আমি আমি অনেক কিছু বুঝি! প্রমাণ পেলাম খানিক বাদেই, ও ওর সমস্যার কথা আমাকে বলল। এরপরই বলল,
--শাতিল, তোমার সাথে খুব কম কথা হয়, কিন্তু তুমি কত সহজে আমাকে বুঝে ফেললে! কিভাবে বুঝলে?

ওকে বোঝতে চেষ্টা করলাম, তোমাকে দেখলেই যে কারোর বোঝার কথা, তাছাড়া আমি, চারপাশে মানুষদের একটু মনযোগ দিয়েই লক্ষ্য করি, আমার চিন্তার খোরাক জোগাড় করি। এটা এমন কোন ব্যাপার না। আমার ধারনা, ও ওই মুহুর্তে আমার কথা বিশ্বাস করেনি। আরো অনেকক্ষণ ও আমার সাথে বসে ছিল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো, কিন্তু ওর কথা ফুরালো না। যখন আমরা উঠলাম, তখনও মনে হল, ও ওর সমস্যার জন্য সাধারন মানুষের মানসিকতার চেয়ে ভিন্ন স্তরে তো ছিলই, এই মুহুর্তে আমার প্রতি মুগ্ধতায় কিছুটা ঘোরের মধ্যে আছে। আমি সেদিন খুব বেশী চেষ্টাও করিনি ওর ঘোর ভাঙ্গাতে। আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা, এই ভুল ধারনাটা যদি তখন ভাঙ্গিয়ে দিতাম, তাহলে হয়ত, অন্তত একজন মানুষ ওকে বুঝতে পেরেছে, একজন সহপাঠী বোঝার চেষ্টা করেছে, এই তৃপ্তিটুকু ওর মাঝ থেকে হারিয়ে যেত! এতোটা নিষ্ঠুর হতে ইচ্ছা হয়নি তখন।

শোভার কাছে আমি খুব ভাল একটা মেয়ে, মিষ্টি ভাষিনী, প্রিয়ভাষিনী। মাঝে মাঝে খুব মজাও লাগে। আমিই ওকে ভয় দেখানো সেই ভূত! শোভার মিঠে ভূত!

এখানেই কাহিনী শেষ নয়। আমার রুমমেটও মাঝে মাঝে আমার ভূত দেখে। একদিন ও রাত ১২টার দিকে নামায ঘর থেকে রুমে ফেরার সময় ওয়াশ রুমে আমাকে হাত মুখ ধূতে দেখেছে, আয়নায় নাকি আমার স্পষ্ট চেহারাও দেখেছে। কিন্তু রুমে ঢুকে দেখে, আমি মশারি খাঁটিয়ে ঘুমাচ্ছি! ভয় পেয়ে ও আমার ঘুম ভাঙ্গাল, দেখল, আমি আসলেই এখানে আছি কিনা! তাহলে ওয়াশ রুমে ও কাকে দেখল! কানে কানে বলে রাখি, নিজের ভূতের কথা শুনে সেদিন আমিও ভয় পেয়েছিলাম। রাতে আর রুম থেকে বের হয়নি। এই মেয়ের কাছেও আমি মিঠে ভূত। হলে আমার ভূত দেখলেও সে যে মানুষ শাতিলকে খুব পছন্দ করে!

মিঠে ভূতের আনাগোনা ইদানিং কমেছে। প্রায় সাত-আট মাস হতে চলল, কেউ মিঠে ভূতটাকে দেখেনি। আমার ভূতটাকে একবার নিজের চোখে দেখার খুব ইচ্ছা। এ যে ভূতের ইতিহাসে আমাকেও ঢুকিয়ে দিয়েছে। সুযোগ পেলে আমার সুইট ভূতটাকে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিতে ভুলব না। কিন্তু মিঠে ভূত কি আমাকে দেখা দেবে? যদি আমাকে দেখা না দেয়, তাহলে, কে হবে মিঠে ভূতের পরবর্তী শিকার! কে হবে মিঠে ভূতের মিঠে কথার শিকার! আর কে হবে ভূত নামের ভুলটার শিকার!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০০৭ সকাল ১০:২৪
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সত্যি বলছি, চাইবো না

লিখেছেন নওরিন হোসেন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০৮



সত্যি বলছি, এভাবে আর চাইবো না।
ধূসর মরুর বুকের তপ্ত বালির শপথ ,
বালির গভীরে অবহেলায় লুকানো মৃত পথিকের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কি 'কিংস পার্টি' গঠনের চেষ্টা করছেন ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০


শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামক সংগঠন টি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছেই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্থান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্থান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×