আড্ডা দিচ্ছিলাম বুয়েট শহীদ মিনারের ঘাষের উপর বসে, আমরা চারজন। আড্ডাটা আসলে আরো বিশাল হওয়ার কথা ছিল... দুর্ভাগ্যবশত Rangs ভবনে সেদিন সকাল থেকেই চলেছে হাতুড়ির আঘাত। সেই আঘাত সইতে না পেরে ক্ষোভে অভিমানে গ্রামীনফোনের নেটওয়ার্ক সকাল থেকে বন্ধ! তাই বাংলালিঙ্ক, একটেল এর সম্মানিত চারগ্রাহক বাকিদের সাথে যোগাযোগ না করতে করতে পেরে বসিয়ে ছিল ছোট্ট একটা সান্ধ্য আড্ডা। এইখানে বলে রাখি, আমাকে আমার ব্যাচমেটদের সাথে আড্ডা দিতে দেখা যায় কদাচিৎ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাদের সাথে দেখা যায় তারা আমার চেয়ে বয়সে বড়ো... কাজের সুবাদে তাহাদের সাথে আমার পরিচয়, অতঃপর সখ্যতা। বয়সে কিবা আসে যায়, যা কিছু আসে যায় তা কেবলই মানসিকতায়। এইবেলা চারজনের পরিচয়খানি দিয়ে ফেলি... রাকিবা আপু, আশীষদা, সুকান্তিদা এবং আমি, উহাদের মধ্যে কনিষ্ঠতম সরল(!) বালিকা। চারটা ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের, চার ব্যাচের চারজন ভিন্ন স্বভাবের মানুষ। মিল শুধু একটা জায়গায়... আমরা বাঁধন কর্মী। ভ্যাম্পায়ারদের(বাঁধন কর্মীদের) কথা শুনে ভয় পাবেন না... আমাদের আড্ডার বিষয় কেবল মাত্র ভ্যাম্পায়ারিজম নয়। স্বর্গ থেকে মর্ত্য পর্যন্ত হালকা এবং কঠিন রসে পরিপূর্ণ সব কিছুই আমাদের আড্ডায় ঠাঁই পায়!
এ কথা সেকথায় একসময় আশীষদা বললেন, তিনি যেখানে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকেন, সেই বাসার আন্টির কথা। আন্টি এতো ভালো যে বাসার সবাই না খেলে তিনি না খেয়ে বসে থাকেন। আশীষদা দেরী করে ঘরে ফিরলে হয়ত আন্টি না খেয়ে বসে থাকবেন। শুনেই চট করে বলে ফেললাম, আমার এই রকম শাশুড়ী চাই, যে আমাকে খুব আদর করবে! বাকি তিনজনের কেউই হয়ত আমার চেয়ে চালাক নয়... তাই এই কথা নিয়ে কেউই আমাকে মধুর খোঁচা শোনায় নি। এই সুযোগে আমি একটু ভাবার সময় পেয়ে গেলাম... আমার আসলে কেমন শাশুড়ী চাই! ভেবে দেখলাম, শুধু এইটুকুতেই আমার সাধ মিটবে না। আমার মামণি এখনো আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। আমার আসলে আমার মায়ের মত শাশুড়ী দরকার, যিনি পুত্রবধূর মুখে তুলে খাইয়ে দিতেও সানন্দে রাজি থাকবেন, আমাকে আমার মায়ের অভাব বুঝতে দেবেন না! আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চট করে সুকান্তি দা বলে ফেললেন, আমার মায়ের মত শাশুড়ীতে চলবে না, মায়ের মত বউ চাই! সাথে সাথে মুহূর্তটা সুকান্তিদা বাদে বাকি তিনজনের বিস্ময়ধ্বনি আর অট্টহাসিতে মুখর হয়ে গেল... এরপর শুরু হল সুকান্তিদার প্রতি তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ! ... হুমম বউমা কি মায়ের মত স্বভাবের? মানে, আমরা আর ডিটেইলসে না যায়! আমি ফিচেল মার্কা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করি, বৌদির স্বভাবগুলো একটু বলেন দেখি... কি কি করেন? সোজা কথা, সুকান্তিদার রোমান্টিক লাইফের ফালুদা বানিয়ে ছেড়ে দিলাম! সুকান্তিদা আমাদের চেয়েও এক কাঠি উপরে... নিজের বিয়ের প্ল্যান নিজ মুখে বলে গেলেন... মানে এই আরকি... কবে বিয়ে করবেন, সিনিয়ররা যেন তার আগেই বিয়ে করে নেয়... ইঙ্গিতে সেই হুশিয়ারি উচ্চারণ করলেন... আরো অজস্র কথায় সেদিনের আড্ডা শেষ হল। কিন্তু মায়ের মত বউ কথাটার রেশ আমার মাথায় রয়ে গেল... পরে মনে মনে বলেছি, শাবাশ সুকান্তিদা!
যারা রবীন্দ্রনাথের দুইবোন উপন্যাসটা পড়েছেন তারা বুঝবেন, মেয়েদের আসলে দুটো জাত। একটা মায়ের জাত, আরেকটা প্রেমিকার জাত। একজন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, আরেকজন হেলেন অফ ট্রয়! পৃথিবীতে যা কিছু কল্যানকর, তার অর্ধেক(আমার মতে অর্ধেক নয়, তারচেয়েও বেশী) যদি সত্যিই গড়ে থাকে নারী, তবে সেই অর্ধেক গড়েছে শুধু এই মায়ের জাতটাই। অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে ওরা সব মহৎ কাজের পিছনে মহত্বর প্রেরণা হয়ে থেকেছে। এই পৃথিবীতে ভালোবেসে চোখের জলও ফেলে কেবল এই জাতটাই। আজো বাঙ্গালী মেয়েরা প্রিয়তমের জন্য নিজের হাতে রান্না করে, সামনে বসে খাইয়ে আনন্দ পায়। প্রগাঢ় ভালোবাসায় সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিয়ে আনন্দে তাদের চোখের কোণে জল আসে। ঘুমন্ত প্রিয়জনদের নিষ্পাপ মুখের দিকে গভীর মায়ায়, মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকে, বোধের অজান্তেই তাদের হাত প্রিয়মানুষদের চুলে বিলি কেটে যায়, ভালোবাসা দিয়ে তাদের পৃথিবীর সব অমঙ্গল থেকে আগলে রাখতে চায়। একজন মেয়ে হয়েও বলতে দ্বিধা নেই, ওইখানে প্রেমিকার জাতের কোন অধিকার নেই। হেলেন অফ ট্রয়রা অথবা রবীন্দ্রনাথের উর্মিলারা ছলনার জালে জড়াতে পারে, ভাঙতে পারে, তছনছ করতে পারে, কিন্তু গড়তে পারে না। ওরা পৃথিবীতে পেতে এসেছে, কাউকে কিছু দিতে আসেনি! তবু মাঝে মাঝে নির্বোধ কিছু মানুষের কারনে মায়ের জাতটাকে কষ্টের নদীতে স্নান করতে হয়। সুকান্তিদা অন্তত সেই নির্বোধের দলে নয়।
মায়ের মত নারীদের শ্রদ্ধা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। আমার ভান্ডারে যত শব্দ আছে তার একটা শব্দও তাদেরকে শ্রদ্ধা জানানোর উপযুক্ত নয়। মা, তুমি আমাকে ক্ষমা কর, ক্ষমা কর, ক্ষমা কর!