ঝরনাটা অপূর্ব লাগছে। স্বচ্ছ টলটলে জল গড়িয়ে পড়ছে অনেকটা ওপর থেকে। একটা মৃদুমন্দ শব্দ। চারপাশে অপূর্ব প্রকৃতি ঝাপির সব লোভনীয় সৌন্দর্য নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছে। অদ্ভূতরকম কোলাহলহীন ,মনোরম এলাকাটা। নিঃসঙ্গ একা বসে আছি। অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা মাথায় ঢু মারছে।
১৫১২ সাল। ফ্লোরেন্স প্রজাতন্ত্রের বিদায় ঘন্টা বাজলো। চাকরিচূত্য হলেন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা নিকোলো ম্যাকিয়াভেলী। ঠিকই ধরেছেন, আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনকের কথাই বলা হচ্ছে। অতঃপর তিনি চলে গেলেন গ্রামের বিশাল খামারবাড়ীতে। আধুনিক ঝলমলে পৃথিবী ছেড়ে বহু দূরে, নির্জন উচ্ছ্বাসহীন নিবিড় খামারবাড়ীতে বসে লিখলেন 'ডিসকোর্স'। অতঃপর লিখলেন 'দি প্রিন্স'। চতুর নিকোলো বইটা উৎসর্গ করলেন নতুন শাসক লোরেন্ঞ্জো ডি মেডিসিকে। যদিও লোরেন্ঞ্জোর সুদৃষ্টি লাভে ব্যর্থ হলেন তিনি। অথচ কি আশ্চর্য, এই বইটিই পরবর্তীতে তাকে নিয়ে গেছে অমরত্বের শিখরে। ওপারে বসে আজ ম্যাকিয়াভেলী নিশ্চয়ই লোরেন্ঞ্জোর দৃষ্টি আকর্ষনে ব্যর্থতা নিয়ে আক্ষেপ করছেন না। আক্ষেপ করছেন না বিচ্ছিন্ন খামারবাড়ীতে একাকী কাটানো দিনগুলো নিয়ে। সেদিনের সেই অপার নিঃসঙ্গতাই যে তাকে করেছে বিখ্যাত সব তত্ত্বের স্রষ্টা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পথিকৃৎ।
এটা বোধহয় ধ্রুব, নিঃসঙ্গতা হলো সৃজনশীলতার উৎস। আত্মজৈবনিক লেখাগুলো আমাকে খুব টানে। আমি গোগ্রাসে ওগুলো পড়ে ফেলি। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের যত আত্মজীবনী পড়েছি, তাতে পেয়েছি অপার নিঃসঙ্গতা। তারা নিঃসঙ্গতাকে মহান করেছেন, সৃষ্টিশীল করেছেন। রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় লিখেছেন," জন্মকাল থেকে আমাকে একখানা নির্জন নিঃসঙ্গতার ভেলার মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।"অতঃপর কি ঘটেছে আমরা সকলেই জানি। সেই সোনার ভেলায় ভেসে তিনি সৃষ্টি করেছেন অভূতপূর্ব সব সাহিত্যকর্ম।
ভ্যান গঘ। 'সান ফ্লাওয়ার' 'পটেটো ইটারস' এর মতো বহু বিখ্যাত চিত্রকর্মের স্রষ্টা ভ্যান গঘ। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, জটিল এবং দূর্বোধ্য প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। কারো সঙ্গে তাই সহজে বন্ধুত্ব হতো না। হলেও বেশিদিন টিকতো না। সঙ্গীহীন একাকী কাটিয়েছেন পুরো জীবন। তবে তার স্বপ্ন ছিল বিশাল। চিত্রকলা নিয়েই ছিল সব স্বপ্ন। তিনি সফল হয়েছিলেন স্বপ্ন পূরণে। অপূর্ব সৃজনী ক্ষমতার সম্মিলন ঘটেছে তার প্রতিটি চিত্রকর্মে। হয়তো প্রতুল নিঃসঙ্গতাই তাকে সাহায্য করেছে অপার সৃজনশীলতার ভূবনে ডুবে যেতে।
জুল ভার্ন। পৃথিবী কাপিয়ে দেয়া এক সাহিত্যিকের নাম। ছেলেবেলায় জুল ভার্ন পড়ে নি সাহিত্যের এমন পাঠক কমই খুজে পাওয়া যাবে। অদ্যবধি অকল্পনীয় জনপ্রিয় এই ফিকশন লেখক দীর্ঘ জীবনের প্রায় পুরো সময়টাই কাটিয়েছেন গৃহকোণে। শেষ ৪০ বছর কাটান একটি চিলেকোঠায়। পারতপক্ষে ঘরের বাইরে বেরুতেন না। অসংখ্য বই লিখেছেন, সৃষ্টি করেছেন অপার বিস্ময়। তাকে বলা হয় সর্বকালের সেরা কল্পনাশক্তির অধিকারী। তিনি বিমানের কথা লিখেছেন, সাবমেরিনের কথা লিখেছেন, "আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমন" বই লিখেছেন। অথচ এসব তখন বিজ্ঞানীদের মাথায়ও আসে নি। পরবর্তীতে তার ধারনা থেকেই বিমান-সাবমেরিনের মতো অসংখ্য জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে। অথচ এই বিস্ময়কর লেখক পুরোটা জীবনই নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন নিঃসঙ্গ চিলেকোঠায়।
নিঃসঙ্গতা আর সৃষ্টিশীলতা যেন একে অপরের পরিপূরক, মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:০৭