somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাই খেতে বিষ, নাই মরে যেতে মোহনা, তবে হ্যাঁ, আমার কাছে তুমি এখনও সেই্ বোকাসোকা মেয়ে হয়েই আছো..."

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১...

আজকে আমার মনটা খুবই ভালো, অনেক ভালো লাগছে, আসলে নিজের জন্মদিনে কার না ভালো লাগে? এতো এতো উপহার পেয়েছি, আর আমার অনেক দিনের শখ ছিল লেখালেখি করার জন্যে একটা ভালো খাতার, কারণ নিপুটা আজকাল এত পাজি হয়েছে, আমি যেটাতেই লিখবো ঠিকই ওটা ছিঁড়ে ফেলবে! ভাবখানা যেন সে এখনও কচি খুকি! হুহ!

তবু ভালো আজকে বড়দা আমাকে ডায়েরি উপহার দিয়েছে, কী যে সুন্দর না! নীল কভার দেওয়া মোটা একটা ডায়েরি, দেখলেই মনে হয়- বাহ, এর মাঝে নির্ঘাত উচ্চমানের সাহিত্য দিয়ে ঠাসা! এটা যদি নিপু ধরে তাহলে বড়দা ওকে ছেঁচেই ফেলবে!

এটা আমি আমার তোষকের তলায় লুকিয়ে রাখবো।



২...

ওহ, আজকে আবার সজীবদার সাথে দেখা হয়ে গেলো! আমার বুকের ভেতরটা এখনও কেমন ধক ধক করছে, উনি কিছু বুঝে ফেললেন নাকি? জানি না, উনাকে দেখলেই কেন যেন লজ্জা লাগে, মনে হয় সব রক্ত মুখে উঠে আসে, ধ্যাত, উনি আমাদের বাড়ি না আসলেই পারে, ধুর।

আমার বড়দার সবচেয়ে ভালো বন্ধু সজীবদা, আমি আর দাদা তো পিঠাপিঠি, উনিও তাই। প্রায়ই আমাদের বাসায় আসেন। থাকেনও কাছেই, সারাদিনই দেখা হচ্ছে। তবু আজকাল আমার একদমই সামনে যেতে ইচ্ছা করে না। উনিও বোধহয় আমাকে পছন্দ করেন না, পছন্দ করবেনই বা কেন? আমি তো কালো একটা মেয়ে, চেহারার কোনও ছিরি ছাঁদ নাই, আর উনার পিছে তো পাড়ার সব সুন্দরীরা ঝাঁক বেঁধে ঘুরছে। জেসির মতো ফর্সা সুন্দরী মেয়ে ছেড়ে কেউ কি আমার পিছে সময় বরবাদ করবে? হাহ! কখনওই না!



আমি এসব বুঝি ঠিকই, মা আমাকে বকা দেয়, বলে আমি গাধা তবুও আমি এসব জানি ভালো মতোই, তাই আমার উচিত না উনাকে নিয়ে কিছু ভাবা। কিন্তু আমি নিজেকে সামলাতেও পারিনা, ধুরও আমি আসলে একটা খারাপ মেয়ে, কীসব যে ভাবছি যা তা!

এখন পড়তে বসতে হবে, যাই। সামনে পরীক্ষা, কিছুই তো পারিনা।



৩...

সজীবদা যে আজ কেন অমন করলো? আমার কষ্টে বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে,

আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা! একটা মানুষ আমাকে না বলে শহরে চলে গেলেই কি এভাবে খারাপ লাগতে হবে?

...............

আমি আপনাকে ভালোবাসি সজীবদা, অনেক বেশি ভালোবাসি! এতদিন বুঝিনাই...



৪...

আমাদের দেশের অবস্থা খুব খারাপ, বাবা প্রায়ই কপাল কুঁচকে রেডিও শোনেন, প্রায়ই ঘোষণা আসে যুদ্ধ লাগতে পারে। আমরা হিন্দু বলে আমাদের আরও বেশি চিন্তা, কারণ পশ্চিম পাকিস্তানিরা তো এদেশের মুসলমানদেরই দেখতে পারেনা! আমার খুব ভয় হচ্ছে, জানিনা কার কুদৃষ্টি লেগেছে...

সজীবদা আজ বাসায় এসেছিলো, অনেক দিন পরে, আমি তো লজ্জায় সামনেই যেতে পারিনা, মা আজকাল খুব সন্দেহ করছেন,জানি না কেন? আমার মুখে কি সব লেখা থাকে নাকি? জানিনা বাবা।



৫...

২৫ শে মার্চ রাতে নাকি ঢাকাতে হামলা হয়েছে!

অনেক অনেক মানুষ মারা গেছে, অনেক মানুষ নিখোঁজ, অনেকে জানের ভয়ে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসছে!

যেই ভয়ে ছিলাম সেটাই হয়েছে, যুদ্ধের ঘোষণা চলে এসেছে।

বাবা বলেছেন, তিনি আমাদের বাড়ি ছেড়ে এক পাও নড়বেন না, মা অনেক বুঝাচ্ছেন কিন্তু কাজ হচ্ছে না, আমাদের আশেপাশের সকল বাড়ির মানুষ আরও ভেতরের দিকে চলে যাচ্ছে,

এই গ্রামে এখন আমাদের সাথে আর মাত্র কয়েকটা পরিবার আছে, আর আছে রাজাকারের দল... ওদের কোনও ভয় নাই, কারণ ওদের কেউ ক্ষতি করবে না, তাই ওরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় আর জনমানববর্জিত বাড়িগুলোয় লুটপাট করে।



বড়দার সিদ্ধান্ত, যুদ্ধে যাবে সে। মা বাবা জানেন না কিছুই, আমাকে অনেক ভরসা করে কথাটা বলেছে দাদা, আমি তাই কাউকে কিছু বলতেও পারছিনা। তবে আমি মনে করি দেশের এই দুঃসময়ে ওর এগিয়ে যাওয়াটাই যৌক্তিক, তাই আমি ওকে সমর্থন করছি... তবে বুকটা কেমন খালি খালি লাগছে, সজীবদাও যাচ্ছে সাথে...



৬...

আজকে বড়দা চলে যাবে, রাতের আঁধারে, ওর জন্যে সব কিছু ঠিকঠাক করে দিচ্ছি, মনটা খুব খারাপ...

বিকেলের দিকে সজীবদা এসে হাজির, মা তখন নিপুকে ঘুম পাড়াতে ব্যস, বাসা খালি, বাবা বাজারে আর দাদা ঘুমাচ্ছে...

আমি মিন মিন করে বললাম, "দাদা তো ঘুমাচ্ছে।" শুনে তিনি একটু মুচকি হেসে চুপ হয়ে গেলেন, আমি দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে এই অসম্ভব রূপবান মানুষটার দিকে চেয়ে থাকলাম...

ওর সাথে আমাকে একটুও মানায় না... কেন যে কালো হলাম!

অনেকক্ষণ পর তিনি আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, "মোহনা, শোনো, আমি যদি যুদ্ধ থেকে না ফিরি তাহলে কি তোমার মন খারাপ হবে?"

আমি হতবাক হয়ে গেলাম, আরে ছাগলটা বলে কী শোনো... আমি তো উনাকে চালাক চতুরই ভাবতাম!

মুখে বললাম, "নাহ, কেন মন খারাপ হবে? তবে দাদা যদি না ফিরে, তাহলে মন খারাপ হবে..."

উনার মুখটা একটু লাল হয়ে গেলো...

একটুও না দাঁড়িয়ে চলে গেলেন, আমাকে কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে...

ওহ, এই মানুষটা এমন কেন?



৭...

আমাদের এলাকায় একই সাথে পাকিস্তানিদের আর মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেলো, কয়েকদিন পর পরই উভয়পক্ষের মাঝে সংঘর্ষ হতে থাকলো, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা ওদের কাবু করতে পারছিল না...

এর মাঝেই একদিন রাতে বড়দার কাছ থেকে খবর আসলো, ওদের সাহায্য দরকার, ওদের দলের একজনের অবস্থা খুবই খারাপ... আমি কি সেবাযত্ন করতে পারবো?





বুকের ভেতর হাতুড়ির বাড়ি পড়ছিল, কিন্তু দেশের কথা ভেবে রাজি হয়ে গেলাম, আজকে আমার দাদা যদি এভাবে আহত থাকতো?

মানুষটার জন্যে আমি কিছু পথ্যের ব্যবস্থা করে বাড়ি ছাড়লাম...কয়েকদিন থাকলামও ওখানে...কিন্তু কেবল দাদার সাথেই দেখা হল, সজীবদার কোনও খোঁজ পেলাম না, উনি নাকি অন্য জায়গায়...



৮...

আজকে জানতে পারলাম আমি যে মাঝে কদিন বাড়িতে ছিলাম না, সেটা ফাঁস হয়ে গেছে!

মা আমার উপর খুব রাগ করে আছেন, যে কোনও ভাবেই হোক আমাদের আজই পালাতে হবে... কিন্তু কোথায়?

ভালো লাগেনা... আমার জন্যে আমার পরিবারের ক্ষতি হবে? মাকে বললাম, তোমরা মাসির বাড়িতে যাও...

কিন্তু আমার কী হবে? ওরা যে মেয়েদের ছাড়ে না!

আমি মাকে জোর করে পাঠিয়ে দিলাম দুলাল কাকার সাথে...









১৬ ডিসেম্বর ১৯৮১



সজীব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে,

এখান থেকে অনেক খানি দেখা যায় স্কুলটার, মাঠ জুড়ে ঘাসের ছড়াছড়ি, বাচ্চারা খেলছে...

সেই দুঃসহ দিনগুলোকে এখন আর তেমন মনে পড়ে না, কেবল মনে পড়ে একটা খুব সাধারণ মেয়ের কথা, সাদামাটা মেয়ে, আজও বুঝি দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,

এইতো কয়েকটা কথা বলতে গিয়েই কীভাবে কেঁপে উঠলো!

এখনও চোখের সামনে ভাসে...

ওর লেখা কিছু ছেঁড়া পাতা আজও আছে ওর কাছে...

ম্লান একটা নীল কভার দেওয়া মোটা ডায়েরি, আলগা হয়ে যাওয়া কিছু পাতা!

যেখানে লেখা ছিল নতুন কিছু অনুভূতি, একটা কচি মেয়ের মনের কথাগুলো, মহাকালের শেষসীমাতেও বুঝি সেই অনুভূতিগুলো পুরানো হবে না!



"নাই খেতে বিষ, নাই মরে যেতে মোহনা, তবে হ্যাঁ, আমার কাছে তুমি এখনও সেই্ বোকাসোকা মেয়ে হয়েই আছো..."







১৯ আগস্ট ২০০৯



সজীব সাহেবের শেষ ইচ্ছা ছিল, তাঁর কাছে রাখা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো তাঁর সাথেই চিতায় দিয়ে দেওয়া হোক, জ্বলে যাক ওসব! কারণ যে দেশের উত্তরসূরিরা তাদের গৌরবের ইতিহাসকে আজও পুরোপুরিভাবে জানতে পারেনি, তাদের কাছে তিনি তাঁর এতো অমূল্য সম্পদ দিয়ে যেতে শঙ্কিত...
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×