বিখ্যাত শ্রমিক নেতা নাদের খান ওরফে মজলুম খান মারা গেছেন।
জানাযার মাঠ যেন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। মাঠে জায়গা না পেয়ে অনেকেই রাস্তায় কিংবা এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। দাফনের আগে শেষবারের মত একবার তারা নেতাকে দেখতে চায়।
মাঠের চারপাশে চোখ বুলিয়ে অবাক হয়ে গেল সায়েম। বাবার টাকায় পড়তে গিয়ে অনেকগুলো বছর বিদেশে কাটিয়ে এসেছে সে, তাই দেশের মানুষের কাছে নিজের বাবার জনপ্রিয়তা নিয়ে কোন ধারণাই ছিল না তার।
অনেকেই ফুপিয়ে কাঁদছে। আব্বার জন্য অজানা-অচেনা লোকগুলোর চোখে পানি!
-বাবা, ঘোষণাটা দিয়ে দাও। নামায শুরু করতে হবে।
আব্বার কোন এক নাম না জানা সহকর্মী মাইক্রোফোন এগিয়ে দিল সায়েমের দিকে।
-এই লোকটা কে?
চিনতে পারল না সায়েম।
-এই লোকটাও কি কোন শ্রমিক নেতা?
হবে হয়ত।
-আসসালামু আলাইকু্ম ... ... বলতে গিয়েই গলাটা ধরে এল সায়েমের। আমি সায়েম, মরহুম নাদের খানের ছেলে। আব্বার সাথে যদি আপনাদের কোন দেনা-পাওনা বা দাবী-দাওয়া থাকে, দয়া করে আমাকে বলবেন। আমি মিটায় দেওয়ার চেষ্টা করব। কোনরকমে কথা শেষ করে সায়েম।
সায়েমের হাত থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে নিল পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা। নাদের ভাই আমাদের মজলুম নেতা, সারাজীবন উনি আমাদের হকের জন্য লড়াই করছেন। সারাজীবন শুধু আমাদের দিয়ে গেছেন, বিনিময়ে কখনো কিছু চান নাই। উনার উপর আমাদের একটাই দাবী, ভালবাসার দাবী। এর বাইরে আমাদের আর কোন দাবী-দাওয়া নাই। কি বলেন ভাইয়েরা?
-ঠিক। গর্জে উঠল যেন জনসমুদ্র। অন্য কোন দাবী-দাওয়া নাই।
-আসেন, নামায শুরু করি। ইমামের উদ্দেশ্যে বলে উঠল সায়েম।
-ভাইয়েরা, আমরা সবাই কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়াই ... মাইক্রোফোনে বললেন ইমাম সাহেব।
-দাঁড়ান ... আমার দাবী আছে। পেছন থেকে একটা নারী কন্ঠ শোনা গেল।
কাতারবন্দী হতে ব্যস্ত হয়ে পড়া উপস্থিত জনসমুদ্রের মনযোগ সেদিকে ঘুরে গেল এক নিমেষেই।
গেইট পেরিয়ে আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢাকা এক মহিলাকে শান্ত ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকতে দেখা গেল।
উপস্থিত সবার মনে একটাই প্রশ্ন, জানাজার মাঠে মহিলা কেন? কি তার পরিচয়?
একবার সেদিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল সায়েম। অন্তত ত্রিশ বছর পর দেখছে সে এই মহিলাকে। ফুফু!
-কে আপনি? কি চান? কিসের দাবী আপনার? উপস্থিত ভীড় থেকে প্রশ্ন উড়ে এল।
সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত আরও অনেকে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন।
তবে কোন প্রশ্নেরই জবাব না দিয়ে ধীর-স্থির ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে থাকলেন মহিলা, থামলেন খাটিয়ায় রাখা নাদের খানের লাশের সামনে এসে। কাফনের কাপড় সরিয়ে শেষবারের মত তাকালেন ভাইয়ের ঘুমন্ত চেহারায়, আলতো করে চুমু একে দিলেন কপালে।
অবাক হল সায়েম। আব্বার জন্য ফুফুর চোখে পানি!
-দাও। সায়েমের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন ফুফু।
বুঝতে না পেরে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল সায়েম।
-কই, মাইক্রোফোনটা দাও। আবার বললেন তিনি।
আদেশ পালন করল সায়েম।
মাইক্রোফোন হাতে উপস্থিত জনতার দিকে ফিরলেন ফুফু। এখন তিনি সবার মনযোগের কেন্দ্রে।
-একটু আগে আমার ভাইপো জানতে চাইল মরহুমের ওপর কারও কোন দাবী-দাওয়া আছে কি না। বলতে শুরু করলেন ফুপু।
ভীড়ের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়ে গেল। ওহ, এটা তাহলে মুর্দার বোন? মুর্দার বোন জানাযার মাঠে কেন? তারতো এখন ঘরে বসে আহাজারি করার কথা ...
-মরহুম আপনাদের 'হক' আদায়ের জন্য লড়েছেন, তাই ভালবাসার দাবী ছাড়া আপনাদের আর কোন দাবী নাই। শুনে আমার অন্তর ঠান্ডা হয়ে গেছে। একটা বিরতি নিলেন ফুপু।
-কিন্তু আপনারা কি জানেন, আপনাদের এই 'মজলুম' নেতার কারণেই গত ত্রিশ বছর ধরেই আমার অন্তরে আগুন জ্বলছে? কারণ আপনাদের হক আদায় করলেও ভাই হয়ে সে নিজের বোনের 'হক' আদায় করে নাই। আমার বাবা যা রেখে গিয়েছিলেন, তার পুরোটাই সে একা ভোগ করেছে। আমাকে আমার 'হক' দেয় নাই। আপনাদের 'মজলুম' নেতা একজন 'জালিম' ... ...
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪