somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ ইঁদুর দৌড়

২৭ শে এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ১১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



-আরে, জাকির না?
হেডফোনটা মাত্র কান থেকে সরিয়েছি, শুনতে পেলাম কেউ নাম ধরে ডাকছে। তাকিয়ে দেখি রাশিক, ছোটবেলার বন্ধু।
-আরে, রাশিক মামা নাকি?
-কি খবর দোস্ত? রাশিক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল।
-আলহামদুলিল্লাহ, ভাল আছি। তোর কি খবর?
-এইতো, চলে যাচ্ছে। দেশে এসছিস কবে?
-এইতো, একুশ তারিখে।
-পাঁচদিন হয়ে গেল, কোন খবর দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলি না?
-আসলে দোস্ত, প্ল্যানড ছুটি না। আব্বা হঠাত অসুস্থা হয়ে পড়ল, হসপিটালাইজ করা লাগল, আম্মা প্রতিদিন ফোনে কান্নাকাটি করে, না এসে আর পারলাম না।
-আংকেল হাসপাতালে? বলিস কি? জানি না তো।
-অথচ এই তুই একসময় প্রতিদিন আমাদের বাসায় আসতি।
-খোঁচা দিয়ে লাভ কি বল? এখন সবাই নিজের জীবন নিয়েই ব্যস্ত। তোর ভাইটাও অসামাজিক। বিপদ আপদে আমাদের মনে করলে আমারাও কিছু করতে পারি।
-সাকি একটু অন্যরকম। ছোটকাল থেকেইতো দেখছিস।
-তা দেখছি। সাকিকে আর দোষ দিয়ে কি হবে বল? গত দশ বছরে ফেসবুকে লাইক দেয়া ছাড়া তুই নিজে কোন সামাজিকতা পালন করেছিস?
-বাব্বা, সাকিকে ছেড়ে এখন আমার আমলনামা নিয়ে পড়েছিস? আমি আবার খোঁচাই।
-বাদ দে। ভাবীর খবর কি?দেশে নিয়ে আসছিস? রাশিক জানতে চায়।
-ওর অফিস থেকে ছুটি পাওয়া গেল না। তাছাড়া বাচ্চাদের স্কুলও খোলা।
-ওহ।
হঠাত দুজনেই চুপ হয়ে যাই। নীরবে পাশাপাশি হাটতে থাকি।
-জাকির।
-বল।
-চল, ওখানে একটু বসি।
-কোথায়?
-ওখানে। রাশিক আঙুল উঁচিয়ে দেখায়।
আমি তাকাই। একটা মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিং এর কন্সট্রাকশন চলছে।নীচে থরে থরে ইট সাজিয়ে রাখা আছে।
-ওখানে বসবি?
-হ্যা।
-আরে হাটতে থাক। সকালের এই ফ্রেশ আবহাওয়া হাটতে ভালই লাগে।
-ভাই, আমি হাটতে হাটতে টায়ার্ড। এবার একটু বসা দরকার।
-আমিতো বসতেই পারি। কিন্তু কার না কার কন্সট্রাকশান সাইট, ঢুকতে দেবে।
-দেবে না মানে, আমার কন্সট্রাকশান সাইট। আমি ঢুকব, বের হব, বসে থাকব, শুয়ে থাকব, যা ইচ্ছা করব। কোন বাপের ব্যাটা থামাবে আমাকে?
-বাব্বা, তোর কনফিডেন্স লেভেল দেখি অনেক বেড়েছে।
গেট পেরিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকে যাই, সাজানো ইটের ওপর পা ছড়িয়ে বসে পড়ি।
রাশিক কোনরকমে বসে পরে দুটো ইটের ওপর, হাপাতে থাকে বিশ্রীভাবে।
আমি এই প্রথম ভালভাবে রাশিকের দিকে তাকাই। অহংকার করছি না, তবে আমি নিশ্চিত অপরিচিত কেউ এখন আমাদের দুজনকে দেখলে ব্যাচমেট বলে বিশ্বাস করবে না। রাশিকের গালের চামড়া ঝুলে গেছে, জুলফির দুপাশে পাক ধরেছে। চশমাও দেখি লাগিয়েছে একটা। তবে সবচেয়ে বাজেভাবে বেড়িয়ে আছে ভূড়িটা, লাল রঙের স্কীন টাইট টিশার্টে বিশ্রী লাগছে। এমন কাপড় পড়ে মর্নিং ওয়াক করার রুচি হয় কি করে?
-কি দেখিস? রাশিক হাপাতে হাপাতে প্রশ্ন করে।
-তোকে।
-আমাকে দেখার কি আছে? চিড়িয়াখানারর বাদর নাকি আমি?
-বাদরেরতো ভুড়ি থাকে না।
-ওহ, এটা। রাশিক নিজের ভুড়িতে হাত বুলিয়ে নেয়।
-জ্বি, জনাব ওটা।
-সবাই কি আর তোর মত স্পোর্টসম্যান? আমরা কি আর খেলার জন্য টাকা পাই?
-কিসের মধ্যে কি টানছিস? আমি পেশাদারী খেলাধুলা ছেড়েছি দশ বছর আগে। তবুও এখনো নিজের ফিটনেস ধরে রেখেছি।
-ভাই, আমি থাকি বাংলাদেশে। আমাকে কাজ করে কামাই করতে হয়। আর তুই থাকিস আমেরিকায়।
-তো? আমেরিকায় কি আমাকে ফ্রী খাওয়ায়? আমিও কাজ করেই খাই।
-ওখানেতো গলির মোড়ে মোড়ে জিম।
-তাই নাকি? দেখলাম না তো।
-এত বছর পর দেখলাম তোকে। তুই কি এখন আমার সাথে ঝগড়া করবি?
-ঝগড়া নারে ভাই, তোকে নিয়ে আমি কনসার্নড।
-কেন?
-তোর কি ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে? কিংবা হার্ট প্রবলেম?
-তুই আমার বন্ধু না শত্রু? আমাকে শুধু রোগবালাই দিতে চাস।
-ভাই, তুই কখনোই ভোরের পাখি ছিলি না। এই ভুড়িটাও প্রমান করে তোর স্বাস্থ্যসচেতনতা কতটুকু।তাহলে তুই মর্নিং ওয়াকে বের হলি কেন?
-ডায়াবেটিস।গতবছর ধরা পড়েছে। রাশিক আস্তে করে জবাব দেয়।
-তারপর থেকেই সকালে হাটাহাটি ধরেছিস?
-হু।
-রাশিক।
-বল।
-আমাদের চল্লিশ পেরলো কবে বলতো।
-তোরটা জানিনা, আমার গত বছর পার হল।
-তোর কি মনে আছে স্কুলে থাকতে আমরা প্ল্যান করেছিলাম অন্তত তিন শতাব্দী বেচে থাকব?
-হ্যা। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে দ্বাবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ।রাশিক হাসতে হাসতে জবাব দেয়।কি যে বেকুব ছিলাম আমরা।
-কেন?
-এই ফিটনেস হবে বলে মনে হয়ে তোর?
-তবে?
-এজন্যই জানপ্রান দিয়ে খাটি। মরার আগে ছেলেপেলের জন্য কিছু রেখে যাওয়া দরকার।
আমি চুপ করে শুনতে থাকি।
-এটা ছাড়াও আরো তিনটা সাইটে আমার কোম্পানি কাজ করছে। ফ্ল্যাটগুলো সব বিক্রি হয়ে গেলে পায়ের নিচে শক্ত মাটি পেয়ে যাব।
-তারপর?
-তারপর আর কি? তখন আরো বড় লোন প্ল্যান আছে। ব্যবসাটা বাড়াতে হবে না?একটু ধর।রাশিক হাত বাড়িয়ে দেয়।
-কি হল? আমি জানতে চাই।
-অনেক বেলা হয়েছে।
আমি ঘড়ির দিকে তাকাই। সাড়ে সাতটা মাত্র।
-আরে ভাই, এখন বাসায় গিয়ে গোসল করব, তারপর নাশতা। আর এই শহরের জ্যাম পেরিয়ে অফিসে পৌছাতে লাগবে অন্তত ঘন্টাখানিক। আল্টিমেটলি নয়টা পেরিয়েই যায়।
-বলিস কি? পনের মিনিটের রাস্তা এক ঘন্টা লাগে?
-এখন সাথে স্কুল টাইম আর অফিস টাইম।জ্যাম না গুনলে হবে?
-চল তাহলে।
আমি হাত বাড়িয়ে দেই, রাশিক উঠে পড়ে।আমরা দুজন হাটতে শুরু করি।
তখনই হঠাত মনে পড়ে যায় আমার। রাশিক।
-বল।
-যেখানে এতক্ষন আমরা বসেছিলাম ওখানেই ছোটবেলায় নিয়মিত খেলতাম আমরা। তাই না?
-হ্যা।
-বাবর চাচার জমি না? কেমন আছেন চাচা?
-গতবছর মারা গেছেন।চাচার ছেলেটা বাইরে থাকে, বাবার মৃত্যুর সময় দেশে এসেছিল। তখনই ডিলটা ফাইনাল করি।
-বাবর চাচা থাকলে তুই জীবনেও জমিটা পেতি না।
-তা ঠিক। চাচার ওই এক কথা, এই মাঠটা না থাকলে বাচ্চারা খেলবে কোথায়?
-রাশিক।
-বল।
-একটু আগে পাশ দিয়ে যে গাড়িটা গেল ওটা তোর ছিল না?
-হ্যা, ড্রাইভারের পাশে বসা বাচ্চাটাই আমার ছেলে। স্কুল টাইম।
-পুরাই তোর মত।
-পজেটিভলি বললি না নেগেটিভলি?
-মানে?
- মানে আমার মত মোটা?না আমার মত কিউট?
-তার মানে তুই বাচ্চার স্বাস্থ্য নিয়ে কনসার্নড?
-হব না? এত করে বলি, বাইরে যা, একটু খেলাধুলা কর। তা না, সারাক্ষণ খালি মোবাইলের স্ক্রীন আর কম্পিটারের মনিটরে তাকিয়ে থাকবে।এই বয়সে একটু না খেললে হয়?
-খেলবে কোথায়? ওদের খেলার মাঠটাতো তুই দখল করে নিয়েছিস।
আমার জবাব শুনে রাশিক হঠাত চুপ হয়ে যায়। দুজন নীরবে হাটতে থাকি।ইঁদুর দৌড়ে থাকা আরো একজন হর্ন বাজিয়ে ছুটে যায় আমাদের পাশ দিয়ে।



___________________
আমার লেখা আরও কিছু গল্পঃ
==================

গল্পঃ যে কারণে ভালবাসি বলা হয় না
গল্পঃ ভালবাসার বৃষ্টি
গল্পঃ কুয়াশায় ঢাকা গল্প যত
গল্পঃ প্রিয়তমা, তোমার জন্য... ...
গল্পঃ তোমার বসন্ত দিনে ... ...
গল্পঃ তামাশা
গল্পঃ অতিথি

আমার লেখা সব ভৌতিক গল্প পড়ার জন্য ক্লিকান এখানে

কাহলিল জিবরানের গল্প পড়ার জন্য ক্লিকান এখানে

মার্কিন সাহিত্যের সেরা সব গল্প পড়ার জন্য ক্লিকান এখানে
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৭ রাত ১:৩৮
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×