এক
দরজায় টোকা পড়ল।
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। সকাল ৯টা বেজে ১৫ মিনিট।এত সকালে কে নক করবে?
-কে? আমি জানতে চাইলাম।
-স্যার, আমি অরিন। বাইরে থেকে জবাব এল। ভেতরে আসব?
-হ্যা, আসুন।আমি বিরক্ত হয়ে জবাব দিলাম।
দরজা ঠেলে অরিন ভেতরে ঢুকল।
-কি ব্যাপার অরিন? এত সকালে?
-স্যার, একটা ব্যাপার ছিল।
আমি অরিনের হাতের দিকে তাকালাম। হাত কচলাচ্ছে। কিছু বলতে চায়, ভয় পাচ্ছে।
-ছুটি লাগবে?
-না স্যার।
-তাহলে? টাকা? অগ্রিম বেতন লাগবে?
-না স্যার।
-তাহলে কি? তুমি জান আমি রুটিন ভাঙতে পছন্দ করি না।
অরিন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কপাল ঘামছে। ধমকে ভয় পেয়েছে।
-আশ্চর্য। চুপ করে থাকলে তো হবে না। কিছু একটা বলার জন্যইতো এসেছ নিশ্চয়ই।
-জ্বি স্যার।অরিন কোনমতে জবাব দিল।
-তাহলে বলে চলে যাও।
-স্যার, আজকে আপনার কোন এপয়েন্টম্যান্ট নেই।
-হোয়াট? অবাক হয়ে গেলাম আমি।বাংলাদেশের সবেচেয়ে উদীয়মান ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের সারাদিনে কোন কাজ নেই-শুনতেইতো কেমন লাগে।
-কেন কোন এপয়েন্টম্যান্ট নেই? তুমি ক্যানসেল করেছ নাকি? আমি রেগে গিয়ে জানতে চাইলাম। ইফ ইউ ক্যানসেলড দেম, দেন ইউ আর অলসো ক্যানসেলড।
-না না, স্যার আমি করিনি।
-তাহলে?
-আসলে স্যার, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ চলছে।পশ্চিমে এখন ক্রিসমাসের ছুটি চলছে। এই মাসে আমাদের আর কোন ক্লায়েন্ট দেশে আসবে না।
-আর আমাদের দেশি বায়ারদের কি অবস্থা?
-একটা লোকাল কোম্পানির ডিরেক্টরের সাথে আপনার মিটিং আছে আগামী পড়শু।আজ আর কাল কিছু নেই।
-হুম।
আমি ভাবতে লাগলাম। অনেকদিন ধরে খুব টাইট শিডিউল যাচ্ছে আমার। সময়ই পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে শুক্রবারেও অফিস করতে হচ্ছে।এর মাঝে হঠাৎ করে দুটো ওয়ার্কিং ডে-তে কোন কাজ না থাকাটা অপ্রত্যাশিত ছুটিই বলা যায়।
-অরিন।
-জ্বি স্যার।
-ফ্যাক্টরিতে জানিয়ে দাও আজ আমি প্ল্যান্ট ভিজিটে যাব, ওরা যেন রেডি থাকে।দুই সপ্তাহ হয়ে গেল ওদিকে যাওয়া হচ্ছে না।
-স্যার, আজই যাবেন?
-আজই মানে? একটু পরই যাব। ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি রাখতে বল।
শুনেই অরিনের মুখ কালো হয়ে গেল।
-আচ্ছা।
অরিন দরজা ঠেলে বেরিয়েই যাচ্ছিল, ওকে আমি ডাকলাম।
-অরিন।
-জ্বি স্যার। অরিন ঘুরে তাকাল।
-কোন সমস্যা?
-না স্যার।
-তাহলে? কিছু কি বলতে চাও?
-স্যার।
-বল।
-যদি সাহস দেন তাহলে একটা কথা বলতে চাই। কথা না, আসলে আপনাকে একটা অনুরোধ করতে চাই।
-নাটকের ডায়লগ দিচ্ছ কেন? যা বলতে চাও, সরাসরি বল।
-স্যার, প্ল্যান্টে বিকালে গেলে হয় না?
আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম অরিন হয়ত ছুটি চাইবে।ওর একটা ছোট ছেলে আছে। ছেলের অসুখ বা স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং- এসব অযুহাতে ও মাঝে মাঝেই আমার কাছে ছুটি চায়।
-কেন?
-আজ আমার ছেলের রেজাল্ট দেবে।
-রেজাল্ট? কিসের রেজাল্ট? আমি অবাক হয়ে গেলাম।
-ওর স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট।
-তো?
-স্যার, আমার ছেলেটা খুব করে চাইছে ওর রেজাল্টের সময় আপনি যেন সেখানে থাকেন।
-তোমার ছেলে চাইছে?
-জ্বি স্যার।
-কেন?
-জানি না স্যার। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও আমাকে বলেনি। শুধু বলল, মামনি, আগামীকাল অবশ্যই তোমার স্যারকে স্কুলে নিয়ে আসবা।
-আর তুমি কি জবাব দিলে? ঠিক আছে, নিয়ে আসব?
-না স্যার, বললাম চেষ্টা করব।তবে ওকে খুব বেশি আশা করতে নিষেধ করলাম।
-তোমার ছেলে কি করল?
-রাগ করে ঘুমাতে চলে গেল।
-হুম্ম।
-স্যার, প্লিজ।
-দেখ অরিন, তুমি খুব ভাল করেই জান আমি আমার এমপ্লয়ীদের পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করি না।তোমাদেরও ব্যাপারটাকে সম্মান করা উচিত।
অরিন মাথা নিচু করে ফেলল। জ্বি স্যার।
-ক্যান্টিনে খোঁজ নাও আমার ব্রেকফাস্ট রেডি কিনা। খেয়েই বেরিয়ে পরতে হবে।
-জ্বি স্যার।
অরিন রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি পত্রিকা পড়ায় মনযোগ দিলাম।
দুই।
ফোনটা বেজে উঠল।
জহির সাহেব। আমাদের প্ল্যান্ট ম্যানেজার।
-আসসালামু আলাইকুম স্যার। ভাল আছেন?
-এইতো জহির সাহেব। আপনার কি খবর?
-আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভাল আছি স্যার।
-হঠাৎ এই সময়ে ফোন করলেন। প্ল্যান্টে কোন সমস্যা হয়েছে?
-না না, স্যার, প্ল্যান্টে কোন সমস্যা হয়নি?
-তাহলে? ছুটি চান?
-না স্যার, ছুটি না। আসলে সামনের মাসে স্যার এআইসিএইচই(AIChE-American Institute of Chemical Engineers) এর সম্মেলন হবে আমেরিকায়।
-তো?
-আমরাতো টপসো’র ক্লায়েন্ট। ওরা ওদের এমোনিয়া সিম্পোসিয়ামে পার্টিসিপেট করার জন্য আমাদের কাছ থেকে ইঞ্জিনিয়ার চেয়েছিল।
-আচ্ছা?
-জ্বি স্যার। আমি আমাদের তিনজন ইঞ্জিনিয়ারকে রিকমেন্ড করে আপনার কাছে মেইল পাঠিয়েছিলাম।
-ওরা চেয়েছে কজন?
-একজন।
-এক কাজ করুন। আপনি তিনজনের সিভি আর সুপারভাইজারের রিকমেন্ডেশনসহ মেইলটা আমাকে আবার পাঠান। আর টপসো’র মেইলটাও আমাকে আবার ফরোয়ার্ড করুন।
-জ্বি আচ্ছা স্যার।
-আমি নেক্সট বোর্ড মিটিং-এ ব্যাপারটা তুলব।
-থ্যাংক ইউ স্যার।
-আর জহির সাহেব।
-জ্বি।
-আমি কিছুক্ষণ পর প্ল্যান্ট ভিজিটে আসব।
-নিশ্চয়ই স্যার।
ফোনটা কেটে দিলাম।
আউটলুক ওপেন করলাম।মেইল চেক করা দরকার।
শিট। জহির সাহেব সত্যিই মেইল করেছিলেন।মিস হয়ে গেল কিভাবে?
টপসো’তে আমাদের রিপ্রেন্টেটিভ আলিম সাহেব।
-হ্যালো, আলিম সাহেব।
-আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছে?
-এইতো। আপনার খবর দবর কি?
-আলহামদুলিল্লাহ। চলে যাচ্ছে বেশ ভালই।
-ফোন করেছি জরুরী দরকারে। আপনি এমোনিয়া সিম্পোসিয়ামের ব্যাপারে জানেন?
-জ্বি। টপসো মেইল করেছিল আমাকে।কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার চেয়েছে ওরা।
-আপনিতো আমাকে কিছুই জানালেন না।
-আমি আপনাদের প্ল্যান্ট ম্যানেজারকে জানিয়েছিলাম। জহির সাহেবকে।
-তা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু জহির সাহেবেরতো কোম্পানির খরচে কাউকে আকেরিকা পাঠানোর এখতিয়ার নেই। ওই অথরিটি থাকে কোম্পানির ডিরেক্টরের হাতে। মানে আমার হাতে।
-আমি ভেবেছিলাম জহির সাহেব আপনাকে জানাবেন।
-জহির সাহেব আমাকে জানিয়েছেন। কিন্তু টপসোতে আমাদের প্রতিনিধি আপনি। টপসো আপনাকে কিছু জানালে আমি আশা করতেই পারি আপনি আমাকে সেটা জানাবেন।
-আপনি আপনার অবস্থান থেকে ঠিকই আছেন।
-আপনি কি এখন ফ্রী আছেন? থাকলে অফিসে চলে আসুন। আপনার সাথে এই ব্যাপারে কথা আছে।
-আজকে আসলে সম্ভব না।
-কেন?
-আসলে ডিসেম্বর মাস। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা শেষ। তাই পরিবারসহ কক্সবাজারে আমি এখন। আগামী পরশু শহরে ফিরব।
-ঠিক আছে, তাহলে আগামী পরশু।
-ওকে স্যার।
ফোন কেটে দিলাম।
শালা। কাজকর্মের ঠিকঠিকানা নাই, ফ্যামিলি ট্যুর দেয়া হচ্ছে কক্সবাজারে। যতসব অকর্মার দল।
তিন।
গাড়ীতে উঠে বসলাম।
ড্রাইভিং সীটে মোবারক মিয়া, পাশে প্যাসেঞ্জার সীটে অরিন। পেছনে আমি।
-মোবারক মিয়া, ফ্যাক্টরী চল।
হঠাৎ মোবারক আমার দিকে মিস্টির প্যাকেট এগিয়ে দিল।
-কিসের মিষ্টি?
-ছেলেটা বুয়েটে চান্স পাইছে। তাই আপনার জন্য আনছি স্যার।
-বুয়েটে? বাহ, ভাল তো। তা কোন সাব্জেক্টে?
-সাব্জেক্ট এখনো দেয় নাই স্যার। খালি রেজাল্ট দিয়েছে।
-ছেলে চান্স পেয়েছে-শুনে ভাল লাগল। এখন ফ্যাক্টরীতে চল।
-জ্বি স্যার।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
-স্যার, মিষ্টির প্যাকেটটা?
-অরিনকে দাও। ও বাসায় পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করবে।
-জ্বি আচ্ছা, স্যার।
মোবারক এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে, অন্য হাতে মিষ্টির প্যাকেটটা অরিনের দিকে এগিয়ে দেয়।
এ কি? অরিন কাঁদছে নাকি?
-অরিন।
-জ্বি স্যার।
-কোন সমস্যা?
-না।
-সব ঠিক আছে?
-জ্বি।
ছেলের রেজাল্টে যাইনি বলে কাঁদছে নাকি? কাঁদুক। অফিস শেষে মিষ্টির এই প্যাকেটটাই ওর ছেলের জন্য নিয়ে যেতে বলব। এতেই খুশি হয়ে যাবে।
ফোনটা আবার বেজে উঠল।
উফ। দুইটা মিনিট শান্তিতে বসার কোন উপায় নেই।
এবার কে? শান্তা।
-হ্যালো।
-কোথায় তুমি?
-গাড়ীতে। ফ্যাক্টরীতে যাচ্ছি।
-কেন? কোন সমস্যা?
-নাহ, রুটিন ভিজিট।ফোন কেন করছ?
-তুমি কয়েকটা দিন গ্যাপ নাও।
-কেন?
-সামীরের পরীক্ষা শেষ। সকাল সকাল থেকে বাসায় চেচামেচি করছে ঘুরতে যাব, ঘুরতে যাব বলে।
-তো শিশু পার্কে নিয়ে যাও ওকে।
-ও যেতে চাইলেতো নিয়েই যেতাম।তোমার ছেলে দূরে কোথাও যেতে চায়। সে সাগর আর পাহাড় দেখবে।
-বাচ্চা মানুষ, ওকে একটু ভুলিয়ে রাখতে পারনা? এক কাজ কর। বিকালে মার্কেট থেকে কয়েকটা নতুন খেলনা কিনে দাও আর কোন রেস্টুরেন্টে খেয়ে আস। দেখবা ছেলে চুপ।
-তা তুমি কি রেস্টুরেন্টে আসবা?
-আমি সময়ে কুলিয়ে উঠতে পারব না।তুমি আর সামীরই যাও।
-তা তোমার ছেলেকে নাহয় ভুলিয়ে রাখলাম। তোমার মাকে কিভাবে ভোলাবে?
-মানে?
-তোমার মা-ইতো সামীরকে এসব বুদ্ধি দেয়।সকাল থেকে দাদী-নাতি মিলে পুরা বাসা মাথায় তুলে রাখছে।আমি আর পারছি না। তুমি কথা বল তোমার মায়ের সাথে।
-আজাদ। আম্মার কন্ঠ।
-জ্বি আম্মা।
-তুই কোথায়?
-এইতো আম্মা, ফ্যাক্টরীতে যাচ্ছি।
-সারাদিন এতো কাজ করিস। ঘরের লোকজনেরওতো খবর রাখা দরকার।
-ঘরের লোকজনের জন্যইতো সব করতেছি আম্মা।
-তা আমি জানি বাবা। কিন্তু টাকা কামানোই কি সবকিছু?
-কি হয়েছে?
-দুদিন হল তোর ছেলেটার পরীক্ষা শেষ। সকাল বিকাল কান্নাকাটি করতেছে ঘুরতে যাবে বলে। তুই একবারও খেয়াল করেছিস?
-আরে আম্মা, ও বাচ্চা মানুষ। ওর কথাকে এত গুরুত্ব দেয়ার কিছু নাই।
-বাচ্চা হোক আর বুড়া হোক, তোরইতো ছেলে। নিজের ছেলের কথার গুরুত্ব না দিলে কার কথার গুরুত্ব দিবি?
ধূর শালা, কি পেইন। সারাক্ষণ খালি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা।
-আম্মা রাখি। বাসায় এসে কথা বলব।
ফোনটা কেটে দিলাম।
চার
-স্যার, ফ্যাক্টরী আইসা পড়ছি।
-দারোয়ান কোথায়? গেট খোলে না কেন?
-দেখতেছি স্যার।
মোবারক গাড়ি থেকে নেমে যায়। ফিরে আসে একটু পরেই।
-স্যার, গেটে নাকি কি সমস্যা হইছে। বড় গেইটটা খোলা যাচ্ছে না।
-হোয়াট?
-জ্বি স্যার। বলে বড় গেইট খোলা যাচ্ছে না, তাই গাড়ি ঢোকানো যাবে না। আপনাদের ছোট গেইট দিয়ে ঢুকতে হবে।
মেজাজটা খারাপ হয়। সামান্য একটা গেট যারা মেনটেন করতে পারে না, তাদের হাতে আমার কোটি টাকার ফ্যাক্টরীর দায়িত্ব দিয়ে রেখেছি!
আবার ফোনটা বের করতে হল।
-জহির সাহেব।
-জ্বি স্যার।
-এসব কি? সামান্য একটা গেটের ঠিকঠাক মেন্টেন্যান্স হয় না, আপনারা করেন কি?
-স্যার, আপনি কি চলে আসছেন? আমি নীচে আসছি।
-আপনি এসে আর কি করবেন?লোকজন আসছে?
-জ্বি স্যার, ওয়ার্ক শপের লোকজন গেট দেখার জন্য যাচ্ছে।
-যাচ্ছে মানে? এখনো এসে পৌছেনি?
-আসলে স্যার ...
ধুর বাল। ফোনটা কেটে দিলাম।
-অরিন।
-জ্বি স্যার।
-এক কাজ কর। তুমি ভেতরে চলে যাও। মোবারক গাড়ীর কাছেই থাকুক।আমি একটু পরেই আসছি।
-আপনি কোথাও যাবেন?
-তুমি ভেতরে যাও। আমি এসে পড়ব একটু পরেই।
-জ্বি আচ্ছা, স্যার। অরিন গাড়ী থেকে নেমে ভেতরের দিকে হাটা দিল।
-মোবারক, তুমি গাড়ীতেই অপেক্ষা কর।
-আইচ্চা স্যার।
গাড়ী থেকে নেমে গেলাম।
পাঁচ
-স্যার, আপনে।কন্ঠটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম।
মধ্যবয়স্ক এক মহিলা আমাকে ডাকছে।
আমি ভাল করে তাকালাম। পরনে একটা মলিন শাড়ি, হাতে একটা খুন্তি। নিম্নবিত্ত পরিবারের কেউ-দেখলেই বোঝা যায়।
-তুমি?
-স্যার, চিনতে পারছেন আমারে? আমি মনোয়ারা।
হঠাৎ করেই আমার মনে পরে যায়।প্রায় বছর বিশেক আগের কথা। তখনও স্কুলে পড়ি। আব্বুর সাথে একবার ফ্যাক্টরী ভিজিটে এসেছিলাম।
আমাদের ফ্যাক্টরীর ঠিক বাইরেই এই মহিলা তার রুটি-ভাজির দোকান চালাতেন। ফ্যাক্টরীর বেশিরভাগ শ্রমিকই এই মহিলার দোকান থেকে সকাল-বিকাল নাস্তা করত।
-হ্যা, চিনতে পেরেছি। আপনি এখানে নাস্তার দোকান চালান।অনেকদিন আগে আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছিল।
-জ্বি স্যার। আপনে আছেন কেমুন?
-এইতো চলে যাচ্ছে।
-অহন আপনেই ফ্যাক্টরী চালান?
-চালাই মানে মাঝে মাঝে আসি আরকি। আমার আরও ব্যবসা আছে। ওগুলোও দেখতে হয়।
-তাতো হইবই স্যার।তাইলেতো মনে ফ্যাক্টরীতে প্রতিদিন আসেন না?
-প্রতিদিন আসার সময় কোথায়? সপ্তাহ দুই সপ্তায় আসি আরকি।
-আপনার দোকান এখন কোথায়?
-ওই যে স্যার, রাস্তার ওই পারে। আঙ্গুল উচিয়ে দেখায় মনোয়ারা।
পাশাপাশি দুটো চুলা। একটা চুলায় হাড়ি বসানো, ধোয়া বের হচ্ছে। কোন তরকারী হবে হয়ত। পাশের চুলায় একটা তাওয়া। তার ওপর রুটি সেকছে ছোট্ট একটা ছেলে।
বয়স কত হবে ছেলেটার?
ছয়-সাত? হতে পারে।
আট-নয়? অসম্ভব কিছু নয়। এই শ্রেনীর লোকেরা খুব অপুষ্টিতে ভোগে।
-ছোট একটা ছেলে রেখেছেন দেখি। আগেরবারতো একটা মেয়ে দেখেছিলাম।
-ওইটা আমার মাইয়া ছিল স্যার। আর এইটা আমার মাইয়ার পোলা, আমার নাতি।
-নাতি? বাহ।আপনি তাহলে নানু হয়ে গেছেন।
-জ্বি স্যার। মনোয়ারার মুখে আমি নানু হওয়ার আনন্দ দেখতে পাই।
-তা আপনার মেয়ে কোথায়?
মনোয়ারার মুখটা হঠাৎই অন্ধকার হয়ে যায়।
-বড় শখ কইরা মাইয়াটারে বিয়া দিছিলাম স্যার।জামাইটারে রিকশাও কিন্যা দিছিলাম।
-ওরা এখন কোথায়?
-জামাইটা একটা জানোয়ার ছিল। রোজ মাইয়াটারে মারত। একদিন হঠাৎ রক্তবমি করতে করতে মাইয়াটা মইরা গেল। তারপরেই নাতিটারে নিয়া ফিরা আইছি।
-ফিরে এসেছেন মানে? কোথায় গিয়েছিলেন?
-আপনে জানেন না?
-কি জানব?
-সেই যে একবার আপনে আমার দোকানে রুটি খাইতে আইলেন আর আপনার আব্বায় দেইখা ফেলল। আপনেতো চইলা গেলেন গাড়ি কইরা। আপনের আব্বার লোকেরা আমার দোকান ভাইঙ্গা দিছিল।
বলতে গিয়ে চোখ ছল ছল করে ওঠে মনোয়ারার।
-হোয়াট?
মনোয়ারা শাড়ির আচল দিয়ে চোখ মোছে।
-স্যার, আইজকা খাইবেন আমার দোকানে? মনোয়ারা জানতে চায়।
বলে কি এই মহিলা? পাগল নাকি? উদীয়মান শিল্পপতি আজাদ চৌধুরী কিনা নাস্তা করবে ফুটপাতের এই রুটির দোকানে!
-স্যার, আইজকা, ফুলকপি আর বাধাকপি দিয়া ভাজি করছি। রুটি দিয়া খাইতে খুব ভালা লাগব।
মনোয়ারা খুব আশা নিয়ে তাকায় আমার দিকে।
বুকের মধ্যে হঠাৎ কেমন যেন লাগে। বিশ বছর আগে একদিন এই মহিলার দোকানে নিতান্তই খেয়াল বসে রুটি খেয়েছিলাম। আব্বা দেখতে পেয়ে সাথসাথে আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দেন।রিয়াজ চৌধুরীর ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুটপাতের খাবার খাচ্ছে-এই দৃশ্য তিনি সহ্য করতে পারেন নি।
আজ না এলে আমার জানাই হত না আব্বুর লোকজন মনোয়ারার দোকান ভেঙ্গে দিয়েছিল।
-আচ্ছা, চলেন যাই।আমি বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। একটার বেশি রুটি খাব না।
-জ্বি, আইচ্চা।
-আপনার দোকান আগে এই পাড়ে ছিল না? আবার ওই পাড়ে নিয়ে গেলেন কেন?
-ভয় পাইছিলাম স্যার। ফ্যাক্টরীর একদম সামনে দোকান দিলে যদি আবার দোকান ভাইংগা দেয়।
-বাশার, স্যাররে বসতে দে।
মনোয়ারার নাতির নাম তাহলে বাশার। সুন্দর নাম।
কোত্থেকে বাশার একটা মোড়া নিয়ে আসে।দোকানের কাস্টমাররা কেউ দাঁড়িয়ে, কেউবা ফুটপাতে বসে খাচ্ছে।
আমার জন্য মোড়া? নিজেকে কেমন যেন ভিআইপি গেস্ট মনে হল।
-নেন স্যার।
মনোয়ারা একটা প্লেটে ভাজি, আরেকটা প্লেটে একটা রুটি এগিয়ে দেয়।
-বাহ, সুন্দর প্লেট তো।
-সবাইরে দেই না স্যার। খালি ইস্পিশাল গেস্ট আসলে দেই। মনোয়ারার পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে জবাব দেয় বাশার।
হঠাৎ আমার চোখ যায় গেটে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ড আর দারোয়ানের দিকে।অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ওরা।
থাকুক। সবকিছু পাত্তা দিলে চলে না।
-ও চাচী, আর দুইটা রুটি।পাশ থেকে একজন কাস্টমার বলে ওঠে।
-দিতাছি বাবা।
মনোয়ারা কাস্টমারদের খাবার সার্ভ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি রুটিতে প্রথম কামড় বসাই।
কত সেকেন্ড সময় লাগে মানুষের একটা রুটি খেতে? ত্রিশ? চল্লিশ? সর্বোচ্চ এক মিনিট?
হয়ত। খেতে খেতে কখন তিনটা রুটি খেয়ে ফেললাম বুঝতেই পারিনি।
প্লেট দুটো মনোয়ারার দিকে এগিয়ে দিতে যাব, হঠাৎই একটা দৃশ্য দেখে আমার চোখ আটকে গেল।
মনোয়ারার মুখে রুটি তুলে খাইয়ে দিচ্ছে বাশার। বাশারের মুখে শিশুসুলভ নিষ্পাপ হাসি, মনোয়ারার চোখের কোনে অশ্রু। সেই অশ্রুর কষ্টের নয়-বোঝার জন্য কোন রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না।
শেষ কবে এমন নিশ্চিন্ত মনে হেসেছিলাম?
ছয়
ফ্যাক্টরী ভিজিট শেষ।ফেরত যাচ্ছি অফিসে। আগের মতই মোবারক গাড়ি চালাচ্ছে, তারপাশে অরিন আর আমি পেছনের সীটে।
-অরিন।
-জ্বি স্যার।
-আজকে রাতে কক্সবাজারের চারটা টিকেট কর। আর হোটেল রয়াল টিউলিপে একটা স্যুইট বুক দিয়ে দাও।
-স্যার, বিজনেস মিটিং?
-নাহ, ফ্যামিলি ট্যুর। অনেকদিন সবাই মিলে বাইরে যাওয়া হয় না।
-আচ্ছা স্যার।
-তোমার ছেলের রেজাল্ট কয়টায়?
-এগারটায় স্যার।
-এখন কয়টা বাজে?
-এগারটা বাজতে দশ মিনিট বাকি স্যার।
-মোবারক।
-জ্বি স্যার।
-দশ মিনিটের মধ্যে কি তোমার অরিন ম্যাডামের ছেলের স্কুলে পৌছানো যাবে? আর অরিন, মিষ্টির প্যাকেটটা এদিকে দাও। সুখবরের মিষ্টি বাসি করতে নেই।
___________________
আমার লেখা আরও কিছু গল্পঃ
==================
গল্পঃ যে কারণে ভালবাসি বলা হয় না
গল্পঃ ভালবাসার বৃষ্টি
গল্পঃ কুয়াশায় ঢাকা গল্প যত
গল্পঃ প্রিয়তমা, তোমার জন্য... ...
গল্পঃ তোমার বসন্ত দিনে ... ...
গল্পঃ তামাশা
গল্পঃ অতিথি
আমার লেখা সব ভৌতিক গল্প পড়ার জন্য ক্লিকান এখানে
কাহলিল জিবরানের গল্প পড়ার জন্য ক্লিকান এখানে
মার্কিন সাহিত্যের সেরা সব গল্প পড়ার জন্য ক্লিকান এখানে
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:২৪