ইদানীং চাইলেও সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারিনা, কিন্তু আজ কিভাবে যেন ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে গেল।পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম, আকাশে মেঘ করেছে, খবরে দেখলাম চার না পাঁচ নম্বর সংকেত জারী করেছে।যেকোন মুহূর্তে ঝড় নামতে পারে। মেঘলা আকাশ ও বিষন্ন মন নিয়ে আমি বিছানায় শুয়ে থাকি।
হঠাৎ দরজাটা খুলে যায়। এত সকালে আমার রুমে আবার কে এল? তাকিয়ে দেখি, আমাদের বুয়া নাসার মা।
-ভাইজান, ঘর ঝাড়ু দিয়া দেই।
-দাও।
-আপনে আইজ এত সকালে উইঠা পড়ছেন?
-হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। তা এই আবহাওয়ায় তুমি না এলেও পারতে।
-আমরা হইলাম গিয়া জনমদাসী। আমাদের কি আর কামে না আইসা উপায় আছে?
-হুম।
-ভাইজান আইজ কোথাও যাইবেন নি?
-নাহ, আজ আমি কোথাও যাব না। সারাদিন বাসাতেই থাকব।
ঘর ঝাড়ু দিয়ে নাসার মা বেরিয়ে যায়। ফোনটা বেজে ওঠে। বালিশের পাশে রাখা ফোনটা ধরার জন্য আমি হাত বাড়াই। হাতের ঠেলায় কি যেন পড়ে যায়। আমি মুখ তুলে দেখি। বইটা পড়ে গেছে।
আমি বইটা তুলে নেই। টিনটিন। অপুর কাছ থেকে বইটা এনেছিলাম।অনেকদিন রুমে পড়েছিল, পড়া হয়নি। ইদানীং নাইট রিডার হয়ে যাচ্ছি, কালাটে বইটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, শেষ করা হয়নি। আমি আসলে একটা নরাধম। নইলে এমন বই পড়তে গিয়ে কেউ ঘুমিয়ে পড়ে?
বইটা পড়তে শুরু করব, এমন সময় ফোনটা আবার বেজে উঠল। এই বৃষ্টি ভেজা সকাল-এ আবার কে ফোন করছে? স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখি সোহানী, আমি আদর করে ডাকি টুম্পামনি। এই মেয়েটা প্রায়ই আমাকে রান্নাবান্না করে দাওয়াত দেয়।আমার প্রতি মেয়েটার অদ্ভুত নিঃস্বার্থ ভালবাসা আছে। কেন-কে জানে?
-হাই khairun[/si।
-এই গাধামানব, কোন সুন্দর নামে ডাকতে পার না?
-এটা কত সুন্দর নাম।খা-ই-রু-ন।
-ছিহ, শুনলেই কেমন গ্রাম্যবালিকা বলে মনে হয়।
আমি হাসলাম।-ফোন দিলি কেন?
-আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রন।
-এই ঝড়ের দিনে?
-হ্যা, তো সমস্যা কি? তুমি কোন কালে ঝড়-টড় মানতা?
-তা অবশ্য ঠিক। কি রান্না করেছিস?
-শুটকি মাছ।
-ছেহ, শুটকি আমি খাইনা। খাওয়ার মত কিছু থাকলে বল।
-মাগুর মাছ।
-খালি মাছ কেন? মাংস নাই?
-নাহ।
-ক্যা?
-মাংস কিনার টাক্কা নাই।
-নাই ক্যা?
-কমুনা।
-না ফিস খাব না।মুড নাই।
-তাহলে কি খাবি? কুনোব্যাঙ? চড়ুই?
-নাহ, এসবও খাব না।
-কেন? এগুলোতে মাংস নাই?
-আছে, তবে এগুলো পরিবেশের জন্য উপকারী। আমি আবার পরিবেশ বন্ধু কিনা, তাই এগুলোর কোন ক্ষতি করব না।
-খুব বড় ম্যাভেরিক হয়েছ? ভালয় ভালয় বাসায় এসে মাছ খেয়ে যাবি, নাহয় গু খাওয়াব।
স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার প্রফেসর ফোন করেছে।
-এই ফোন রাখি, প্রোফেসর শঙ্কু কল ওয়েটিং-এ আছে।
-এই ব্যাটা আবার কে?
-আমার থিসিস সুপারভাইজার।
-তাহলে আমার দাওয়াত?
-পরে কলব্যাক করব তোকে।
আমি কল কেটে দেই।
-আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। এত সকাল সকাল ফোন বিজি থাকে কেন?
-ফ্রেন্ড ফোন করেছিল স্যার।
-এত সকালে তোমার ফ্রেন্ডরা ঘুম থেকে ওঠে? আমিতো কোনদিন সকালের ক্লাসে তোমাদের দেখি না।
কি জবাব দেব এই কথার? চুপ করে রইলাম।
-এহসান।
-জ্বি স্যার।
-কাজকর্ম ঠিকঠাক এগুচ্ছে?
-একদম স্যার।
-সামনের সপ্তাহে একটা মক প্রেজেন্টেশন দিয়ে দাও তাহলে।
-সামনের সপ্তাহে?
-কোন সমস্যা?
-আসলে স্যার কায়েস গেছে ওদের গ্রামে।আর হাসান-এর বাসায় কিছু সমস্যা চলছে।
-বাবা এহসান, আমার মাথার এই পাকাচুল-এর মানে জান? এর মানে অভিজ্ঞতা।ওসব অজুহাতে কোন লাভ হবে না। সামনের সপ্তাহেই প্রেজেন্টেশান।
স্যার ফোন কেটে দেন।
আমার মাথায় হাত। আরজু ম্যাডামকে ফোন দিতে হবে। স্যারের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রীদের একজন আরজু ম্যাম।ম্যাডাম বললে স্যার নিশ্চয়ই প্রেজেন্টেশন পিছিয়ে দেবে।
-কি খবর এহসান?
-ভাল আছেন ম্যাম?
-ভাল আর থাকি কিভাবে?গত মাসের দেয়ালিকার জন্য লেখা দাওনি কেন?নোটিশবোর্ড-এ লেখা চেয়েছিলাম।দেখোনি?
মাথায় ঠাডা পড়ল। শিট, একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
-দেখ এহসান, তোমার মধ্যে আমি জীবনান্দদাশের ছায়া দেখতে পাই।কিন্তু লেখালেখি একটা সিরিয়াস বিষয়, এটাকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই।তারওপর কর খালি বানান ভুল।এভাবে করলে তুমি এগোতে পারবে না।
-সেজন্যই ম্যাম ফোন করেছিলাম। আমি আসলে একটা লেখা রেডি করার চেষ্টা করছি, কিন্তু শঙ্কু স্যারতো সামনের উইকে প্রেজেন্টেশান দিয়ে রাখছে।এই টেনশান নিয়ে কি আর লেখালেখি হয় ম্যাম?
-তাই নাকি?
আমি যথাসম্ভব করুন গলায় বললাম, জ্বি।
-আচ্ছা, তুমি লেখা রেডি কর। আমি স্যারের কথা বলতেছি।
-থ্যাংক ইউ ম্যাম।
ফোনটা রেখে দেই। যাক, একটা ঝামেলা গেল।
ম্যাডাম যেহেতু লেখার কথা বললই, দেখি ব্লগের কি অবস্থা।ল্যাপীটা অন করে সামুতে লগ ইন করলাম।
আরে, সামুতে ছয় বছর পেরিয়ে গেছে আমার! ছ-য়-ব-ছ-র।
আহারে, একসময় কি সামু পাগলা-ই না ছিলাম আর ইদানীং লগিন-ই করা হয় না
ঝটপট একটা বর্ষপূর্তি পোস্ট লিখে ফেললাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই জাঝাযুক্ত কমেন্ট চলে এল।
আমি চশমখোর-এর মত সবার কমেন্টে লাইক দিলাম।
এর মধ্যে মির্জা বাড়ির বউড়া, খালি বালতিফারখালি বালতি, ওলে ওলে, এরশাদ চাচ্চু, উলে উলে বাবুতারে , বেদের ছেলে মফিজ মিয়া- সমানে কমেন্ট ফ্লাডিং শুরু করেছে। হারামজাদাদের সমস্যা কি? এভাবে সীমানা ছাড়িয়ে ফাত্রামি করছে কেন? সবকয়টা দেখি এক একটা বিতর্কিত উন্মাদ মানব।
প্রত্যেককে জবাব দিলামঃ
ওরে অমাবশ্যার চামচিকার দল
অযথা ফ্লাডিং করছিস কেন? বল।
ওরা বললঃ
আমরা সব ঠোটকাটা নির্লজ্জ
আমাদের মাথায় পাঠার বর্জ্য
জবাব দেখে আমি নীরব হয়ে গেলাম। নাহ, অনেক হয়েছে, সবকয়টাকে ব্লক মেরে দিলাম।
মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এসব বান্দরদের জন্যই আমি লিখতে চাই না।
আর ভাল্লাগছে না। লগ আউট করলাম
ধুর শালা। মেজাজটাই গরম হয়ে গেল।
এর মধ্যে মাহমুদ উকি দিল।
-কি চাস?অণুজীব-এর মত উকি খাপ্পাচ্ছিস কেন?
-আমি আসলে একজন ঘূণপোকাতো, সেজন্যই খাপ্পাচ্ছি। তুই দেখি উঠে পড়েছিস?
-তো উঠব না?
-তুই যে টিভি পাগলা। সারারাত টিভি দেখলি। ভাবলাম উঠতে পারবি কিনা।
-উঠেইতো পড়ছি।
-তাতো দেখতেই পাচ্ছি। এলোমেলো চুলে তোকে পুরাই দিশেহারা রাজপুত্র মনে হচ্ছে।
-আজাইরা কথা বাদ দে। খাজুরা কথা শোনার মুড নাই।কি বলতে চাস,বল।
-শায়মা আন্টি ফোন করছিল। রেজোয়ানা আন্টিও উনার ওখানে আছে।আমাদের যেতে বলছে।
-কক্সবাজারে? কবে?
-আজ রাতে রওয়ানা দেব।ভোরের দিকে কক্সবাজার পৌছাব।
-এই ঝড় বাদলের মধ্যে? কোমেন আসবে কখন?
-জানি না বাল।ঝড়ের মধ্যে সাগর পাড়ে গিয়ে সূর্যোদয় দেখতে তোর কোন সমস্যা? সারাদিনতো পড়ে পড়ে ঘুমাস। এবার একটু অ্যাডভেঞ্চার কর।আর তাছাড়া ...
-তাছাড়া কি?
-তাছাড়া জনৈক গন্ডমূর্খ বলেছেনঃ
যখনই উঠিবে ঝড়
তখনই ছেড়ে ঘর
সাগরের পথ ধর।
-অ্যাঁ?
-শোন ভাই,এখন জুন মাস, হোটেলের ভাড়াও কম।চল।
-ওকে।
দুই।-------------------------------------------------------------------
বেশ কবছর আগের গল্প।
তখন কোপায়ে ব্লগিং। ব্লগিং-ই তখন ধ্যানজ্ঞান।খাই-ঘুমাই-ব্লগাই।এই তখন আমার রুটিন।
এর মাঝে খবর এল সমুদ্রে ঝড় উঠেছে, দুএকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অতিক্রম করবে।
পোলাপান হইহই করে উঠল।কক্সবাজার যাবে।ঢাকাবাসী আমিও সাহসী সন্তান রওয়ানা দিলাম ওদের সাথে।
নিজেদের গাড়ি।হোটেলে ব্যাগ রেখেই সরাসরি চলে গেলাম বীচে।
আমার কোন সময় জ্ঞান ছিল না।আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে।
গাড়ি থেকে নামলাম। বাতাসের শো শো শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না।
আর তখনই ...
আধার আলো ভেদ করে এক অপ্সরী বেরিয়ে এল।
কি নামে ডাকব একে? আধারি অপ্সরা?
সিনেমায় দেখেছি প্রথম দেখায় মুগ্ধ হয়ে গেলে নাকি চারদিকে নাকি ভায়োলিন বাজতে থাকে। বাতাসের শো শো শব্দও আমার কাছে মিষ্টি মধুর সংগীত মনে হল।
আমি এই ঝড়, উড়তে থাকা ধুলো-সব উপেক্ষা করে এই সমুদ্রকন্যার সামনে দাড়ালাম।
মেয়েটা ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে জানতে চাইল, কি?
-তোমার নামটা জানতে পারি?
-উশৃংখল ঝড়কন্যা।কেন?
-যাকে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি তার নামটা জানা থাকা দরকার। "এই" "ওগো"-এসব আসলে এই যুগের সাথে যায় না কিনা।
-পাগল নাকি?
-হ্যা, তোমাকে দেখার পর পাগল হয়ে গেছি।উইল ইউ ম্যারী মি?
-অ্যাঁ।
-এখনই জবাব দেয়ার দরকার নেই।আশেপাশের এই ঝড় থেমে গেলেও তোমার জন্য এই মনের ঝড় কখনও থামবে বলে মনে হয় না।সময় নাও, ধীরে সুস্থে জবাব দাও।
মেয়েটা হঠাত হাসল।
-তো ডিয়ার ফিউচার হাজবেন্ড, কি নামে ডাকব তোমাকে?
-আমি তোমার কাল্পনিক ভালবাসা।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ৯:৫৭