আমার জন্য আমার "মা" অনেক কষ্ট পেয়েছেন অনেক কেঁদেছেন । সেই ছোট্ট বেলা থেকেই আমি "মা" এর দুঃখ কষ্টের কারণ হয়েছি বারবার ..
ছোট বেলায় খুব খাদক ছিলাম .. খাইয়ে দিলেই আমি ঠান্ডা । তখন মা আমাকে এক জায়গা বসিয়ে রেখে সব কাজকর্ম সেরে আসতেন । আর আমি আপন মনে খেলতাম ।
একদিন মা ঐভাবে আমাকে রেখে পাশের বাড়ির এক চাচির অনুরোধে তার সাথে কোথায় যেন গিয়েছিলেন .. আসতে একটু দেরি হওয়ায় নাকি আমার দাদী (মায়ের আপন ফুফু) "মা" কে অনেক বকা দেন এমনকি গায়েও হাত তুলতে যান ...
এরপর একদিন মা আমাকে তার বুকের উপর নিয়ে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে দিতে নিজেও কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েন ,,, আর আমি কিভাবে যেন নিচে পড়ে যায় ,,, তবে কোন এক অজানা কারনে কান্না করিনি .. তারপর খাটের নিচে এক কোনায় গিয়ে বসে বসে খেলতে থাকি একটা বল না কি যেন হাতে পেয়ে .।
এরপর মা ঠিক পেয়ে যখন দেখেন আমি নেই !!! তখন শুরু হয় খোঁজাখুজি ,, কোথাও পাওয়া যায় না ...!!! কেউ চুরি করে নিয়ে গেল না তো ????
এদিকে দাদী আবার একটু মাথা গরম মানুষ তাই "মা" কে অনেক বকাঝকা করতে থাকেন নানা কথা বলে .। মা একে তো ছেলে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গেছেন তার উপর দাদীর ওমন আচরণে আরও বেশি ভেঙে পড়েন ,, পরে অবশ্য ভাইয়া আমাকে খাটের নিচ থেকে বের করে আনেন
দুই বছর বয়স থেকে আমার অ্যাজমা ধরা পড়ে । আড়াই দিন এর ভয়ংকর রুপ স্থায়ী হওয়ায় গ্রামের ভাষায় আড়াই হাপি না কি যেন বলতো । ঐ সময় ঐ ২/৩ দিন আমি সারা রাত জেগে থাকতাম । আর সাথে প্রচন্ড জ্বর ও কাশির কারণে মাঝে মাঝেই বমিও করতাম ...। আর আমার মা নিজেকে আটকাতে না পেরে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতেন ..।
ডাক্তার কবিরাজ সবই দেখানো হতো ,, মা যেখানে যা শুনতেন এই অসুখ ভাল হওয়ার ব্যাপারে ,, সেখানেই আব্বা কে পাঠাতেন ...। আর ঐসব ডাক্তার কবিরাজদের নিষেধ থাকতো অনেক না খাওয়ার ব্যাপারে । আমি খেতাম না বলে আমার মা ও খেত না ...
আমার শরীর কাহার হওয়ার কারণে সবাই আমাকে বেশি বেশি রেস্ট নিতে বলতো . যার কারণে একটু ঘুম কুমার টাইপের হয়ে যায় .। আর যার দরুন রাতে স্বপ্নে হিসু করে বিছানা ভিজিয়েছি ক্লাস সেভেন এ পড়া অবধি .. । আর আমার মা সকালে সেই সব কাথা, তোশক , ধুয়ে মুছে নেড়ে দিয়েছেন ১২টি বছর ..
ক্লাস নাইন থেকে বড় ভাইয়ার মধ্যস্ততায় আমাকে বাড়ি ছেড়ে শহরের ভাল স্কুলে পড়ার ব্যাবস্থা করা হয় ... আমি একা থাকবো কি করে সেই চিন্তায় "মা" সব সময় চিন্তিত থাকতেন ,, এখনও থাকেন .। তখন আমার মোবাইল ছিলো না । প্রতিদিন আমি একটি দোকানে গিয়ে মা এর সাথে কথা বলতাম সাত টাকা মিনিট ,, প্রতিবার বাড়ি থেকে আসার সময় মা আমাকে দুই/তিন শত টাকা পকেটে দিয়ে দিতেন ঐ মোবাইল বিল বাবদ
এস.এস.সি পরিক্ষায় অনেক ভাল রেজাল্টের স্বপ্ন নিজে দেখি এবং মা বাবা ও শিক্ষকদেরও দেখায় । কিন্তু সারা জীবনের অভ্যাস অনুযায়ী পরিক্ষার সময় আমার হাঁপানি বেড়ে গিয়ে পরিক্ষায় খারাপ করে ফেলি । আর তারপরে রেজাল্টের দিন বাড়ি না গিয়ে বাইরে রাত কাটায় .। ঐদিন "মা" সারারাত কান্না করেন এবং কিছু মুখে দেন নি শুধু আমার জন্য ..।
তারপর এইচ.এস.সি পরীক্ষাতেও ঐ একই কারণে রেজাল্ট আবারও খারাপ । তবে এবার অসুস্থ হবার কারণ আমি নিজেই .. । পরীক্ষা শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে প্রথম প্রেমের জলন্ত খুন্তির ছ্যাকা খাই .. যার দরুন চরমভাবে নিজেকে ছাগলের মত নিঃশেষ করে ফেলার প্রয়াস এবং আমার অ্যাজমা বেড়ে আবারও পরীক্ষা খারাপ ..। এই বিষয়ে আমি "মা" কে সব আগে থেকেই বলে রাখায় এবং ছ্যাকা খাওয়ার পর "মা" এর কোলে মাথা রেখে হাউমাউ করে কান্না করা ,, যার ফলে বাড়ির সবাই যেনে যাওয়ায় ,, আমাকে সবাই চরম ভাবে বকাঝকা করে ...
"মা" তার ছোট ছেলের এমন শাস্তি সহ্য করতে না পেরে কথা বলতে গিয়ে নিজেও অনেক বকা শুনে পরে ঘরের কোনায় বসে কান্নাকাটি করেন আড়ালে .। তবে সেটা আমার চোখ এড়াতে পারে নি ...
ছোট বেলায় নাকি বলতাম " মা আমি ঢাকায় থাকবো , আর তুমি বড় ভাইয়ার কাছে বাড়িতে থাকবা ,, আমি প্রতিবছর তোমাকে দুই একবার এসে দেখে যাবো ".. অথচ ছোট বেলায় মা কে রেখে এক মুহুর্তের জন্যও বাইরে থাকতে পারতাম না .. এমনকি ছোট বেলা থেকে বাড়িতে যতদিন ছিলাম ততদিন মা এর সাথেই ঘুমাতাম ..। এখনও বাড়ি গেলে মাঝে মাঝে মা এর পাশে ঘুমায় ..
এখন আমি ঢাকায় থাকি সপ্তাহে তিন/চার দিন মা এর সাথে কথা হয় । ফোন দিলেই মা নানা প্রশ্ন করতে থাকেন
খেয়েছিস ?? এখন কোথায় ?? শরীর ভাল আছে তো ?? পড়া লেখা ভাল করে করছিস ??
আরও নানা প্রশ্ন ....।
কিন্তু আমি মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতে ভুলে যায় ..
"মা তুমি কেমন আছো ??? অসুধ খাচ্ছো তো ??
তবুও মা কিছু মনে করেন না .. আমি যে তাক ফোন করে কথা বলছি এটাই তার কাছে যেন অনেক বড় পাওয়া .। তিনি এটুকুতেই সন্তুষ্ট ।
অথচ আমি যখন বলি "তোমার জন্য কি আনবো বাড়িতে আসার সময়"????
মা বলে " বাবা তুই ভাল ভাবে আমার কোলে ফিরে আয় , আমি তাতেই খুশি " পথে সাবধানে আসবি , !!
বাড়ি থেকে যখন চলে আসবো বলে বের হয় ..। তখন মা আমার পিঠে হাত রেখে দোয়া করে দেন ... তারপর আমাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যান ...। যতক্ষণ না আমি তার চোখের আড়ালে চলে যায় ,, ততক্ষণ আমার মা পথের দিকে চেয়ে থাকেন ......
মা তোমার মত মমতা , স্নেহ , ভালবাসা , আদর আর কোথাও পাবো না জানি .. তোমার শরীর এখন অনেক দুর্বল .. শেষ বয়সে চলে এসেছো প্রায় .. আমি জানি এখনও তোমার মর্ম বোঝার মত ক্ষমতা আমার হয়নি ,, কারণ তুমি এখনও আমার সাথে কথা বলো ,, তোমাকে বাড়িতে গেলে দেখতে পায় ।,, তুমি জীবিত ... তুমি এখনও বেঁচে আছো ...।
তুমিও বল মাঝে মাঝে আমি খুব নিষ্ঠুর ,, কোন মায়া দয়া নেই আমার মনে .. কিন্তু কথাটা সত্য নয় মা ...। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিলেও তোমার প্রতি আমার দুর্বলতা তুমি জানো না মা ...। আমি তোমাকে খুব বেশি ভালবাসি ..।
যদি কারও "মা" এর মৃত্য সংবাদ শুনি ,, তখন মনে হয় আমার "মা"ও তো একদিন চলে যাবে আমাকে ছেড়ে ,,, তখন আমি কাকে মা বলে ডাকবো ... কে আমাকে আদর করে খাইয়ে দেবে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে .. কে তোমার মত কৌতুহল নিয়ে আমার খোঁজ নেবে , আমার জন্য অপেক্ষা করবে " কখন খোকা তোমার কোলে ফুরে আসবে " তার জন্য ... এসব ভাবলে আর নিজেকে আটকাতে পারি না মা ।
মা তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মত সাহস আমার নেই ... তোমার সামনে গিয়ে অমন কথা বলার মত সুযোগ বা পরিস্থিতি হবে কি না জানি না .. তবুও তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিবা আমি জানি ,,, কারন শত অন্যায় করলেও যে আমি তোমার রক্তে মাংসে গড়া তোমার নাড়ী ছেড়া সেই সন্তান যাকে তুমি দশ মাস দশ দিন তোমার নিজের ভেতরে নিদারুণ কষ্টে বয়ে বেড়িয়েছ ,,
" মা " তোমরা এত নিঃস্বার্থ কিভাবে হও "মা " ??????