দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও একটি বছর। এ বছরের প্রথম দিনটি আমার শুরু হয়েছিল ইংরেজি প্রবাদ - মর্নিং সোজ দ্য ডে কে স্মরণ করে। সেদিন আমার অবস্থান ছিল পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরিকোস্টের এক হাসপাতালের বিছানায়। পায়ের মাংস পেশীর ইনজুরিতে পড়ে ভর্তি হতে হয়েছে দিন কয়েক আগে। তাই চোখের সামনে অন্যদের যখন দেখলাম থার্টি ফার্স্ট পালন করতে দলবেঁধে আবিদজান যাচ্ছে তখন মন খুব মন খারাপ হয়েছিল। নতুন বছরকে স্বাগতম জানাতে আবিদজান স্টেডিয়াম আর প্লাতো শহরে চলে উত্তাল কন্সার্ট, লেজার শো। মুহুর্মুহু আতশবাজির শব্দ আর চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জায় পুরো আবিদজান এক অচেনা রূপ ধারন করে থার্টি ফার্স্ট রজনীতে। সে সব দেখতে না পারার আপসোসে নিজের ইনজুরিকে অভিসম্পাত দিয়েছিলাম বার বার। তখনি মনে হয়েছিল ২০১৩ সালটা বোধহয় আনলাকি থার্টিন হতে যাচ্ছে আমার জন্য। থার্টি ফার্স্ট নাইটে আমার ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয় যখন সংবাদ আসে আবিদজান স্টেডিয়ামে নববর্ষ পালন করতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মারা গেছে ৬০ জন। এদের অধিকাংশই ছিল নারী এবং শিশু। এ ঘটনা শোনার পর পা হারানো লোক দেখে জুতার খেদ মেটার অনুভূতি হল আমার। যাক বাবা বাঁচা গেল, আবিদজান যেতে পারলে আমিও হয়ত থাকতাম ওই কনসার্টে।
২০১৩ এর প্রথম দিন আমার বাজেভাবে শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল ভিন মহাদেশের এক ভিন দেশে। কিন্তু তাই বলে অপয়া বছরের রাহুর কবলে পড়বে বাংলাদেশ , ঠিক অতোটা বোধগম্য হয়নি তখন। ২০১৩ এর বিদায় লগ্নে এসে বছরটিকে এখন মনে হচ্ছে মহা অপয়া। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত আর মৃত্যুর বিভীষিকায় এখন আফ্রিকাকে ও হারিয়ে দিয়েছি আমরা। ওরা জাতিগত সংঘাত আর দাঙ্গা হাঙ্গামায় লিপ্ত হয়ে করে খুনোখুনি, রক্তপাত। ওখানে জীবন্ত মানুষের হাতপা বেঁধে পুড়িয়ে মারার ভিডিও ক্লিপ দেখে শিউরে উঠেছিলাম। কিন্তু আজ বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় যেভাবে পুড়িয়ে মানুষ মারতে দেখছি সেটা আফ্রিকানদের বর্বরতার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। পত্রিকার পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ বছর অস্বাভাবিক ঘটনায় প্রান গেল ২৪৪৬ জনের! এর মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতার বলি ৪৯২ জন। বছর শেষ হতে আর যে কয়দিন বাকি আছে আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে তাতে এ পরিসংখ্যানে আরও কিছু লাশ যোগ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনাই বেশি। এক সময় আমি বেশ গর্ব ভরে বলতাম , আমাদের দেশে অন্তত পাকিস্থান , আফগানিস্তানের মত গুপ্ত হামলা কিংবা নাশকতা হয়না, মসজিদে বোমা হামলা হয়না, রাস্তায় গাড়ি বোমা বিস্ফোরিত হতে কেউ দেখে না। কিন্তু ইদানিং কালের পরিস্থিতি আমার সেই গর্বের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে। রাজনীতির এহেন অমানবিক আচরণ দেখে নিজেকেও কেমন জানি আজকাল অসভ্য আর বর্বর মনে হয়। রাজনীতি থেকে দেশপ্রেম বিসর্জিত হয়ে সেখানে দখল করেছে স্বার্থবাদীতা, হিংসা , পরশ্রীকাতরতা। ক্ষমতার লোভ লালসায় আজ আমরা অন্ধ হয়ে গেছি। দেশের ভাল মন্দ আজ আমাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় নয়। আমাদের লক্ষ্য এখন কি করে ক্ষমতা দখল করে কিংবা ক্ষমতা পাকাপোক্ত রেখে নিজের আখের গোছানো যায়। ক্ষমতার অমিয় সুধা পানে সবাই কেন এত মরিয়া সেটা কিছু নেতানেত্রীর নির্বাচনী হলফনামায় আঙ্গুল ফুলে বট বৃক্ষে পরিণত হওয়ার উদাহরন দেখেই আঁচ করা যায়। হলফনামার তথ্য পত্রি কায় প্রকাশ হওয়ায় অনেকের থলের বেড়াল বেরিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়ে গেছেন। কেউ কেউ পত্রিকার রিপোর্টকে কাল্পনিক বলে অভিযোগ খন্ডনের বৃথা চেষ্টা করেছেন। সে রকম ধোয়া তুলসি পাতা গোছের কেউ থাকলে এতদিন আদালতে কোটি টাকার মানহানি মামলার ঘটনা চোখে পড়ত। কিন্তু সেরকম বুকের পাটা কারো আছে বলে মনে হয়না। তথ্য প্রমান না থাকলে এত বড় রুই কাতলাদের বিরুদ্ধে কেউ গল্প ফাঁদার দুঃসাহস দেখানোর কথা নয়।
রাজনীতিকে দিন দিন নীতিহীন করে ফেলার অশুভ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। দেশকে নিয়ে ভাবার ফুরসৎ নেই রাজনিতিকদের। বর্তমানে দেশের অচল অবস্থা নিয়ে আমাদের চেয়ে বিদেশী বন্ধুদের বেশি উদ্বিগ্ন মনে হয়। কিন্তু প্রধান দুই রাজনৈতিক দল নিজেদের দলীয় চিন্তা চেতনায় অন্ধ থেকে দেশের ভাগ্য প্রশ্নে থাকছে নির্বিকার। এ রকম নির্জীব , স্থবির অবস্থা কোন দেশের জন্যই কল্যানকর নয়। দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে হলে, দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিকে বেগবান করতে হলে আমাদের নিজেদের সৃষ্ট সংকটের আশু সমাধান করতে হবে। আমরা চাইনা ২০১৪ এর ঘটনাপঞ্জী ২০১৩ কে ছাড়িয়ে বলতে বাধ্য করুক যে আনলাকি থার্টিনই ভাল ছিল।
বিঃ দ্রঃ অনেকদিন ব্লগে পোস্ট দেয়া হয়না। তাই ইহা আমার ব্লগারস ব্লক কাটিয়ে উঠার একটা ক্ষুদ্র চেষ্টা মাত্র। অনেক কিছুই বলার ছিল। কিন্তু পরে ভাবলাম – এত অরণ্যে রোদন করে কি লাভ? তবে বিরোধী দলের লাগাতার অবরোধে পাবলিকের বিতৃষ্ণা ধরে যাওয়ায় দুই প্রধান দল তাদের কর্মসূচী হাতবদল করেছে দেখে কিঞ্চিৎ মজা লাগছে। আগামীকাল ১৮ দলীয় জোটের কর্মসূচীকে প্রতিহত করতে সরকারী দলকে দেখা যাবে অবরোধকারীর ভূমিকায়। জয়তু রাজনীতি.........।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৩৬