হুমায়ূন আহমেদের বর্ণনানুসারে একদিন কবরস্থান থেকে ফিরেই প্রথম উপন্যাস লেখায় হাত দেন । সেই সন্ধ্যায় আয়োজন করে কেমিস্ট্রির বই নিয়ে পড়তে বসেন তিনি । খাতায় লিখা শুরু করেন- The term ‘macromolecule’ was first suggested by staudingen…..
এইটুকু লিখে পরের লাইনেই লিখলেন- “ বাস থেকে নেমে হকচলিয়ে গেলাম ।“” তখন বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, কারেন্টও চলে গেছে । আর হারিকেনের সামনে বসে একের পর লাইন লিখে চলছিলেন সদ্যভূমিষ্ঠ উপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ । সেই যে শুরু হল, পরবর্তী চার দশক বিশাল পাঠকশ্রেণীকে মুগ্ধ করে চলছিলেন তিনি । তাঁর সবাইতে বড় কৃতিত্ব হল, তিনি বাংলাদেশের মানুষকে বই পড়তে শিখিয়েছেন । তিনি যদি না থাকতেন তাহলে হয়ত পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের বইয়ে সয়লাব হয়ে থাকত বাংলা একাডেমীর বইমেলা । কিন্তু বাদ সাধলেন ভারিক্কি সাহিত্যের পাঠক ও কর্ণধাররা ।
কমবয়সী ছেলেপিলে বইমেলায় ভিড় করে হুমায়ূন আহমেদের বই কিনে, তাঁর লেখনভঙ্গি অত্যন্ত সহজ-সরল, পাঠক চরিত্রগুলোর সাথে নিজের মিল খুঁজে পায়, এখটু আধটু লেখালেখি যারা করে তার হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়ে অবাক হয়ে ভাবে, “আরে এরকম একটা লেখা তো আমার লেখা উচিত ছিল!” এতে করেই বোঝা যায় বাংলাদেশের পাঠক সমাজের ওপর কি জাদুকরী প্রভাব ছিল তাঁর ।
কিন্তু উনার দোষ খুঁজে বের করার সর্বাত্নক চেষ্টা চলল, উনি মানের দিকে খেয়াল না রেখে শুধুমাত্র ব্যবসা বাড়ানোর জন্য বেশি বেশি লেখেন, তাঁর বেশিরভাআগ লেখাই গার্বেজ, উনি “চানাচুর” সাহিত্য সৃষ্টি করছেন, তাঁর লেখার বেশিরভাগ পাঠক হল কমবয়সী কমবয়সী অবুঝ পোলাপান, তাঁর লেখাগুলো কালজয়ী হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি । এসব বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদেরও কিছু বলার ছিল । উনি কছু কিছু পত্রপত্রিকায় বলেছেনও । এখন আমি আপনাদের দুজন পাঠকের উদ্দ্যেশ্যে লেখা তাঁর একটি চিঠির কথা বলছি । এখানে হুমায়ূন বিস্তারিত লিখেছেন তাঁর এত বেশি বেশি লেখার কারণ ।
১৯৮৮ সাল । লেখক ও নাট্যরচয়িতা হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছিলেন হুমায়ূন আহমেদ । তিনি প্রচুর লেখালেখি করছেন দেখে তাঁর অনেক ভক্তই তাঁর আগামী কাজের মান নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ছিলেন । এমনই দুজন পাঠিকা(এর মধ্য একজন হচ্ছে আমার মা) “আপনি এত বেশী লিখছেন কেন?? এত বেশী লিখলে তো আপনার লেখার মান খারাপ হয়ে যাবে । আমরা চাই না আমাদের প্রিয় লেখকের মৃত্যু হোক ।“” অনেকটা এমন কিছু কথা লিখে ছোট্ট একটা স্লিপ রসায়ন বিভাগের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন তারা দুজন । তারা হয়ত ভেবেছিলেন এত ছোট একটা চিঠি হয়ত গুরুত্ব দিবেন না তিনি । কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ গুরুত্ব দিলেন । কারণ চিঠিতে যেই কথাগুলো বলা ছিল সেই কথাগুলো সেই ১৯৮৮ সালে সম্ভবত তাঁর কাছে নতুন শুনিয়েছিল । কাজেই তিনি বিশাল উত্তর দিলেন সেই ছোট্ট চিঠির । তিনি কি লিখেছিলেন তা দেখুনঃ
(চিঠিটি প্রকাশ করার আগে প্রাপকের যথাযথ অনুমতি নেওয়া হয়েছে ।)
সুকনিষ্ঠেষু,
তোমাদের ছোট্ট স্লীপ পেয়েছি । এরচে ছোট কাগজ বুঝি হাতের কাছে ছিল না ?
আমাকে কম লিখতে বলছ- আমার তো আর তোমাদের মত কাগজের টানাটানি নেই- হা হা হা ।
আচ্ছা এখন বল, কম লিখলে লেখার মান ভাল হয়, এই অদ্ভুত তথ্য কোথায় পেলে । এই পৃথিবীর( অন্য কোন গ্রহের খবর জানি না) সব লেখক দু’হাতে লিখে গেছেন । সবাই এত লিখেছেন যে তাঁদের এলেখা কপি করতে গেলে একজীবন কেটে যায় । বাংলা সাহিত্য থেকে উদাহরণ দিচ্ছি- রবীন্দ্রনাথ, মানিক, বিভূতি, তারাশংকরস্মরেশ, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সতীনাথ.........) কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে- এই মুহূর্তে ক্যামুর কথা মনে পড়ছে। এই বেচারা কিন্তু মারা গিয়েছিলেন অল্প বয়সে বেঁচে থাকলে তিনিও লিখে আলমারী ভরিয়ে ফেলতেন ।
লিখতে হয় অজস্র তার মাঝখান থেকে দু’ একটা টিকে যায় । তুমি যদি সারাজীবনে তিনটি লেখা লিখ তার কোনটিই না টিকতে পারে যদি ৩০০ লেখা লিখ তাহলে এর মধ্যে দু’ একটা ভাল হয়েও যেতে পারে । মানিক বন্দোপাধ্যায় অজস্র উপন্যাস লিখেছেন নাম করবার সময় তুমি নাম কর- পুতুল নাচের ইতিকথা এবং পদ্মা নদীর মাঝির । তাই না?
তোমরা আমার প্রতি মমতা বশত আশংকা করছ বেশী লেখার কারণে আমার লেখক জীবনের মৃত্যু ঘটবে । মৃত্যু হবার থাকলে কম লিখেও হবে । তা ছাড়া “শত বর্ষ পরে” কেউ আমার লেখা পড়বে এই আশা নিয়ে কিন্তু আমি লেখি না । আমি লেখি আমার নিজের আনন্দের জন্য । সেই আনন্দের ভাগ যদি আমার কোন পাঠক নিতে পারে তাহলে তা আমার পরম সৌভাগ্য । না পারলেও ক্ষতি নেই ।
তোমরা ভাল থাক এবং সুখে থাক ।
তোমাদের তিন লাইনের চিঠির এত বড় জবাব দিলাম এর থেকেই বুঝতে পারছ কম লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব ।
হুমায়ূন আহমেদ(স্বাক্ষর)
২২/১১/৮৮
উনার যুক্তিগুলো উপেক্ষা করার উপায় নেই । “কম লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব ।“” এই কথাটার প্রমাণ উনি বাকি জীবন দিয়েই গিয়েছিলেন । হ্যাঁ, এটা ঠিক যে উনার হালকা লেখার পরিমাণ কম নয়, তারপরও বলছি তাঁর মাতাল হাওয়া, লীলাবতী, ১৯৭১, শঙ্খনীল কারাগার, কোথাও কেউ নেই, এইসব দিনরাত্রি, নন্দিত নরকে, আয়না, বোতল ভূত, দেবী, এসব তো ভুলে যাওয়ার মত কিছু নয় । হিমু, মিসির আলীর লজিক ও এন্টি-লজিকের খেলা বিশ্বের আর কোন সাহিত্যে পাবেন আপনি??? তাঁর যদি ভালো লেখার সংখ্যা বের করতে যাই তবে ৩০০র মাঝে দুই-তিনটি নয় বরং তার চেয়ে অনেক বেশি হবে এতে কোন সন্দেহ নেই ।
এখন একটা দুঃখের কথা বলি, আমি আমার প্রায় ২১ বছরের জীবনে একবারও বই মেলায় যেতে পারিনি । কাজেই লেখক হুমায়ূন আহমেদের দেখা পাওয়া হয়ে উঠেনি আমার, ময়মনসিংহের কথা তিনি বার বার বলতেন তিনি তাঁর লেখায়, সেই জায়গাতেই আমার বেড়ে ওঠা পড়াশোনা সবকিছু, ইচ্ছা থাকলেও তাই ঢাকায় যাওয়া হয়ে ওঠে না সবসময় । তাই তার শেষ বিদায়ের সময় উপস্থিত থাকারও সুযোগ হয়নি ।
তাঁর নামের সাথে আমার পরিচয় যখন তখন তিনি তাঁর সেরাসময় পেরিয়ে এসেছেন বলা চলে । ১৯৯৮ সালের কোন এক সন্ধ্যায় দেখি বাসায় একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে, কেন? কারণ সেদিন হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখাবে, “আজ রবিবার”......... নাটকটা দেখতে শুরু করলাম, হাসি রাখার জায়গা কোথায় পাবো তা বুঝতে পারলাম না ।
হনেস্টলি বলতে গেলে, উনার শেষ দিকের নাটকগুলো দেখে তেমন ভালো লাগত না । কিন্তু, লেখালেখিতে ভাটার ছাপ তেমন একটা দেখতে পাইনি । কারণ এই সময়টাতেই তিনি- জোছনা ও জননীর গল্প, লীলাবতী, মাতাল হাওয়ার মত দারুণ উপন্যাস লিখেছেন ।
১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নুহাশ পল্লীতে গিয়েছিলাম । তখনও জায়গাটার অনেক কাজ বাকি । কাঠের একটা বাড়িতে ঘুরে ফিরে দেখছিলাম । সেখানেই একটা শেলফে/ শোকেসে সারি সারি করে স্যারের অনেক সাজানো বইপত্র দেখে এবং সামনে সাজানো নানা বাদ্যযন্ত্র দেখে চমকিত হয়েছিলাম, এখানেই তিনি থাকতেন মাঝে মাঝে!
এর পর ১৪ বছর চলে যাচ্ছে, আমার, আপনার, সবার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ নুহাশপল্লীতে শুধুই আর মাঝে মাঝে থাকেন না ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৩৪