স্কুলে থাকতে আবুল মন্সুর আহমদের দুইটা গল্প পড়েছিলাম । একটা হল “সবজান্তা শমশের” ও আরেকটি হল আদু ভাইয়ের গল্পটা । দুইটা গল্পই ছিল পাঠ্য । আর ইন্টারে পড়েছিলাম “রিলিফ ওয়ার্ক” । স্যাটায়ার আমার ভালো লাগা শুরু হয়েছিল আবুল মনসুর আহমদের লেখা পড়ার সময় থেকেই । বাংলা বই থেকে জানতে পেরেছিলাম লেখকের অন্যান্য লেখার নাম । “ফুড কনফারেন্স”, “আসমানী পর্দা” ইত্যাদি বইগুলো পড়ার ইচ্ছা তখন থেকেই হয়েছিল ।
একদিন বইয়ের দোকানে গিয়ে থরে থরে সাজানো বইয়ের বামদিকে খেয়াল করি বেশ কিছু পুরোন আর কম চোখে পড়ে এমন কিছু বই সাজানো আছে । “ফুড কনফারেন্স” বইটাও চোখে পড়ল । কি টাইপের বই সেটা নিয়ে ক্ষনিক ধোঁয়াশায় থাকলেও বইটা কিনে ফেলেছিলাম । বাসায় এসে পড়তে আরম্ভ করলাম । মোট নয়টি গল্প আছে এই বইটিতে । গল্পগুলোর নাম যথাক্রমে- ফুড কনফারেন্স, সায়েন্টিফিক বিজিনেস, এ আই সি সি, লঙ্গরখানা, রিলিফ ওয়ার্ক, গ্রো মোর ফুড, মিছিল। জমিদারী উচ্ছেদ, জনসেবা ইয়ুনিভার্সিটি । কিছুক্ষণ পরেই হাসি থামানো কঠিন হয়ে পড়ল ।
প্রতিটা গল্পেই ব্যাংগ, রঙ্গ , হিউমার এর সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলার জাতীয় জীবনে নৈতিক অধঃপতনের বয়ান দিয়েছেন লেখক । আবুল কালাম শামসুদ্দিনের মতে, লেখক এই গ্রন্থে বাঙ্গালি হিন্দু-মুসলমানের সাধারণ চরিত্রের দিক তুলে ধরেছেন । কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, সবকালেই ছিল । তাদের কথাও আবুল মনসুর বাদ দেননি । “রিলিফ ওয়ার্ক” এর হামিদ তেমনই একটি চরিত্র ।
“ফুড কনফারেন্স” গল্পে দুর্ভিক্ষ সামলাতে ব্যর্থ নেতাদের শেরে বাংলা, মহিষে-বাংলা, কুত্তায়ে বাংলা, বিল্লিয়ে বাংলা, চুঁহায়ে বাংলা, বেজিয়ে বাংলা, শিয়ালে বাংলা থেকে শুরু করে পোকায়ে, মাকড়ে, চিঁউটিয়ে বাংলা ইত্যদি নানা নাম দিয়ে ইজ্জতের লটারী করে ছেড়েছেন । চরিত্রগুলোর মুখে নানা সংলাপের মাধ্যমে তিনি ব্যাঙ্গের তুফান ছুটিয়ে দিয়েছিলেন । খাদ্য সংকট কেন দেখা দিল সে নিয়ে পাঁচটি সূত্র দিয়ে সব দোষ চাষীদের উপর চাপিয়ে দেন নেতারা । আর যুক্তিগুলোর কথা নাইবা বললাম! “ফুড কনফারেন্স” এর শেষে সব “জানোয়ারে-বাংলা” রাই বেঁচে থাকে, “মানুষে বাংলা”রা সব মরে যায় ।
“সায়েন্টিফিক বিজিনেস” নামক গল্পে চাপরাশীগিরি আর কেরানীগিরি করে অভ্যস্ত বাঙ্গালি জাতিকে ব্যবসা, তেজারতি ইত্যাদি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় । আবুল মনসুর আহমদের কল্পনায় বাঙ্গালিতা তেজারতি শিখলে কি পরিমাণ অনর্থ করতে পারে তার বিস্তারিত বয়ান দিয়েছিলেন । বাঙ্গালি সবকিছুতেই তেজারতি করতে থাকায় রোগে ভুগে দুনিয়া থেকে সাফ হয়ে পরকালেও তেজারতি করে দুই নাম্বারি আরম্ভ করে । এই গল্পের শেষ হয় এভাবে-“……বাঙ্গালি জাত যেখানে যেখানে বাস করেছে, সেখানে হাইজিনিক মেযার হিসেবে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দাও ।” মোটকথায় বাঙ্গালির ইজ্জতের লটারী এই গল্পে ভালোভাবেই করা হয়েছে ।
“এ আই সি সি” এর পূর্ণরূপ “অল ইন্ডিয়া কন্ডোলেন্স কমিটি” । এই লেখাটি যেই সময়ে লিখেছিলেন আবুর মনসুর আহমদ, সেই সময়ে সম্ভবত ভারতবর্ষে বিভিন্ন “শোক প্রকাশ সমিতি” গঠনের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল । তাই নিয়ে ব্যাংগ করেই হয়ত এই লেখাটি লেখা হয়েছিল । যথারীতি হাস্যরসে পরিপূর্ণ একটি লেখা ।
“লঙ্গরখানা” গল্পটি আমার মতে বাংলা স্যাটায়ার হিসেবে ক্লাসিকের পর্যায়ে পড়ে । দুই বন্ধু আকবর ও শমশের কিভাবে অধ্যাপনা ও উকিলগিরি ছেড়ে ধান্ধাবাজী করতে করতে নেতার পারমিশন বাগিয়ে লঙ্গরখানার কারবার খুলে বসে তাই নিয়ে এই স্যাটায়ার । এই লঙ্গরখানা ভুখা-নাঙ্গাদের খাওয়ানোর চেয়ে পেছনের দরজা দিয়ে চাল-ডাল পাচারের কাজেই বেশি ব্যবহার হতে লাগল । কাজেই দিনে দিনে বাড়ে লঙ্গিরখানার সংখ্যা, দিনে দিনে বাড়ে অভুক্তের পরিমাণ । মৃত মানুষের, মজুদদারদের, সেবক(!)দের পরিমাণ বাড়তেই থাকে । এভাবেই কাহিনী পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় ।
“রিলিফ ওয়ার্ক” এর হামিদের কথা আগেই বলেছি । বিপন্ন মানুষের সেবা করার জন্য ত্রাণ কর্যের দলে যোগদান করে । কিন্তু সেখানে গিয়ে হামিদ দেখতে পায় দুর্বল ভুখা-নাঙ্গারা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে, আর মাত্রাতিরিক্ত খাতির আর ত্রাণ পাচ্ছে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা । হামিদের চোখে এই অনাচার বর্ণনা করেছেন লেখক ।
“গ্রো মোর ফুড” তখনকার কৃষিব্যবস্থার অব্যবস্থাপনাকে ইঙ্গিত করে আর “মিছিল” সাম্প্রতিক রাজনীতির পটপরিবর্তন নিয়ে লিখেছিলেন লেখক । এধরণের লেখা লিখতে হিম্মতের দরকার আছে । একেবারে হুল বিঁধানো মার্কা লেখা ।
“জমিদারি উচ্ছেদ” এই বইয়ের আমার অন্যতম পছন্দের একটা গল্প । এই গল্পে সাধারণ একজন ব্যক্তি(মুনশীজি) জমিদারি উচ্ছেদের অঙ্গীকার করে নির্বাচন করেন । লোকজন রেডিমেড খানবাহাদুরকে ভোট না দিয়ে মুনশীজিকে জেতাবার পর তার ভোল পালটে যায় । তিনি নিজেই নতুন জমিদার সেজে বসেন । আর নানা কুযুক্তি দিয়ে বোকা বানাতে থাকেন গ্রামের সরল সাধারণ মানুষদের ।
“জনসেবা ইয়ুনিভার্সিটি” গল্পটাও ভাল । একজন শিক্ষিত যুবক নানা-ছলাকলা করে জনসেবা করার কথা বলে লাটসায়েব হয়ে শেষ পর্যন্ত জনসেবা করতে সমর্থ হল তার একটি ব্যাঙ্গাত্নক কাহিনী ।
সব মিলিয়ে বইটা একেবারে মাস্ট রিড । না পড়া থাকলে এখনই পড়ে নিন । সংগ্রহে রাখার মত বই ।
আগের রিভিউঃ মাসুদ রানা থ্রিলার রিভিউ- 'ব্ল্যাক স্পাইডার'(১৯৭৪)