পর্ব-৩
এখন আলোচনা করা হবে আসলে কি কি কারনে একজন ব্যাক্তি বাল্যকাল হতে ধীরে ধীরে নাস্তিকে পরিণত হয়। মোটামুটিভাবে নাস্তিক হবার কারণ সমূহকে কয়েকজন ব্যাক্তির বাস্তবমুখী ঘটনা হতে বিস্তারিত বা বিশদভাবে নিচে বর্ননা করা হচ্ছে।
১ম এপিসোড
বরিশাল, বাকেরগঞ্জ উপজেলায় গ্রামাঞ্চালে বসবাসকারী রমিজ উদ্দিনের পর পর ৩ টা কন্যা সন্তান হবার পরও আবার যখন তার স্ত্রী প্রায় শেষ বয়সে সন্তান সম্ভাবা হয় তখন সে ভাবে- এতদিন তো সে ধরেই নিয়েছিল যে তার আর বংশ রক্ষা হবে না ছেলে সন্তান না থাকায়। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে এই বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রীর প্রেগনেট হতে দেখে সে আবারও আশায় বুক বাধে ছেলে সন্তান দেখার কিন্তু যদি এবারও কন্যা সন্তান হয় এমন আশংকায় সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকার বড় হাসপাতালে গিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে দেখবে যে গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে ? যদি মেয়ে সন্তান হয় তবে সে এবরশন করাবে কারন তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা তেমন ভাল নয় সর্বশেষ ৩য় কন্যা জন্মের সময় তার অনেক কষ্ট হয়েছিল, অনেকটা মরানাপন্ন অবস্থা! তাই সে আবারও কন্যা সন্তানের জন্য এতবড় রিস্কে যেতে চায় না। যদিও তার স্ত্রীর কথা হল আল্লায় যা দেয় তাই ভাল, হোক ছেলে বা মেয়ে কিন্তু রমিজ উদ্দিন একগুঁয়ে স্বভাবের হসপিটালে তার স্ত্রীকে নিয়ে যাবেই। তাই কোন কুল কিনারা না পেয়ে অবশেষে রমিজের স্ত্রী আল্লহর কাছে মানত করে ফেলে যে তার যদি ছেলে সন্তান হয় তবে সেই সন্তানকে মাদ্রাসা লাইনে পড়াবে, রমিজ উদ্দিনও একই মানত করে তবে ঢাকায় ডাক্তারের কাছে ঠিকই যেতে হবে এবং অনেক পিরাপিরির পর যায়ও তারা। রাজধানীর একটি উন্নত ক্লিনিকে গিয়ে চেকাপ করে যখন জানতে পারল যে পেটে যে সন্তান আছে সে ছেলে সন্তান তখন দুজনার খুশি আর দেখে কে ! কিন্তু ডাক্তার সাহেব পরামর্শ দিলেন বেশী বয়সে সন্তান হওয়া খুবই রিস্ক তাই তাকে ক্লিনিকে রেখে সিজারের মাধ্যমে সন্তান নিতে হবে এবং রমিজ উদ্দিন ঠিক তাই করে, অবশেষে তারা ছেলে সন্তান পেয়েই যায়। মসজিদের হুজুররের কাছ থেকে শুনে ছেলের সবচেয়ে উত্তম নাম আব্দুল্লাহ রাখে এবং দুটা বড় ছাগল দ্বারা আক্বিকা করে যদিও ক্লিনিকে জন্ম হওয়ায় জন্মের পর পরই আযান দেয়া সম্ভব হয় নাই। এই বয়সে একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়ায় আব্দুল্লাহ তাদের কাছে খুবই আদরের সন্তান হিসেবে বড় হতে থাকে।
পিতা-মাতা এবং বোনের আদরে যখন আব্দুল্লাহর বয়স ৩ এর বেশি তখন তাকে মসজিদের মক্তবে পাঠানো হয় আরবী পড়া শেখার জন্য কিন্তু মক্তবের হুজুরের হাতে প্রায়ই বেতের বারি খেত ছোট্ট শিশু আবুল্লাহ, তাই তার বাবা হুজুরকে অনুরোধ করে যে তাদের একমাত্র আদরের ছেলেকে যেন মারা না হয়, হুজুর রমিজ উদ্দিনের কথা রাখে কারন সে গ্রামের মাতব্বর এবং মসজিদ কমিটির সদস্য কিন্তু আব্দুল্লাহর ভয় কাটে না কারন এরপর থেকে হুজুর তাকে না পিটালেও অন্য শিশুদের ঠিকই ঠাস ঠাস করে পিটাত তার সামনেই আর হুজুর সবসময়ই হাতে ছরি ঘুরাত, তাই প্রায়ই আব্দুল্লাহ মক্তব মিস করত এবং খুব বেশি জড়াজড়ি না করলে সে মক্তবে যেতে চাইত না। আব্দুল্লাহ খুব বেশি আদরের হওয়ায় তাকে বাড়িতে যেমন পড়াশুনার জন্য বেশি চাপ দেয়া হত না ঠিক তেমনি মক্তবে যাবার জন্যও তাকে বেশি পিরাপিরি করা হত না তাই সে আরবি পড়ায় অনেক পিছিয়ে পড়ে। আব্দুল্লাহর পিতা-মাতা ভেবেছিল মক্তব হতে কুরান পড়া শিখার পরই তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে আসবে কিন্তু বছর পেরিয়ে যায় তবুও সে কুরান হাতে পায় না আবার তার মাতাও তাকে ছোট্ট শিশু বলে মাদ্রাসায় এখনি দিতে চায় না। আব্দুল্লাহর সমবয়সি জেঠাত ভাইগুলো এবং তার সমবয়সি সকল শিশুই সকালে মক্তবে পড়া শেষ করে আবার গ্রামের স্কুলে পড়তে যেত কিন্তু তাকে তার বাবা-মা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়নি বলে সে যেতে পারত না, সকালে নাস্তা করে সব শিশু যখন সুন্দর স্কুল ড্রেস পরে ব্যাগে করে বই নিয়ে দল ধরে স্কুলে যেত আবার দুপুরের দিকে দল ধরে হৈ চৈ করতে করতে বাড়ি ফিরত তখন সেসব দৃশ্য আব্দুল্লাহর মন কারত। বিকাল বেলা তার সাথে যারা খেলাধুলা করত তারা সবাই খেলার মাঝে মাঝে প্রায়ই স্কুলের বিভিন্ন গল্প বলত যেমন- পিটি করা, খেলা-ধুলার প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার , পিকনিক, বিভিন্ন প্রকার অনুষ্ঠান ইত্যাদি শুনে আব্দুল্লাহর মন আরো বেশি আকৃষ্ট হত স্কুলের প্রতি। তাই সে প্রথমে তার মা এবং তার বোনের কাছে জিদ ধরল যে সেও অন্যদের মত স্কুলে যেতে চায়, তার বোন রাজি হলেও মা বলল- তাকে নাকি মাদ্রাসায় পড়াশুনার মানত করা হয়েছে তাই স্কুলে পড়া যাবে না। আব্দুল্লাহ তার মায়ের কাছে জানতে চাইল মাদ্রাসা কেমন জিনিস? তার মা তাকে বুঝাল যে মক্তবে সে যেমন পড়াশুনা করে অনেকটা সেরকমই কিন্তু রাত্রেও সেখানেই থাকতেও হবে বাড়িতে আসতে পারবে না অনেকদিন আর বেশিরভাগ সময়ই আরবী পড়তে হবে হুজুরদের কাছে, এসব শুনে আব্দুল্লার মনে ভেসে উঠল ছরি হাতে হুজুর আর তাদের ঠাস ঠাস করে পিটানোর দৃশ্য, মক্তবে অল্প সময়ের জন্যই সে পড়তে যেতে চায় না আর সেখানে তার বাবা-মাকে ছেঁড়ে দিন-রাত থাকতে হবে ইত্যাদি সব ভেবে আব্দুল্লার মন হু হু করে উঠল আর সে পরিস্কার জানিয়ে দিল সে মাদ্রাসায় পড়তে যাবে না তাদের ছেঁড়ে বরং সে স্কুলে যাবে অন্য ছেলেদের মত।
প্রথমে আব্দুল্লাহর মা মেনে না নিলেও পরে যখন ভাবল মাদ্রাসায় পাঠাতে এখনও যেহেতু কয়েক বছর দেরি হবে আবার তাই ছেলেও এতকরে বলছে আর সারাদিন খেলাধুলা করার চাইতে আপাদত সে স্কুলে যাক, অন্তত বাংলা পড়তে শিখলে তো ভালই। তাই সে আব্দুল্লাহর বাবাকে অনেক বুঝিয়ে তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। আব্দুল্লাহ এবার অনেক খুশি সে প্রত্যহ তার বন্ধুদের সাথে স্কুলে যায় আসে। তার সবচেয়ে ভাল লাগে পাঠ্যবইয়ের চিত্রগুলো আর পাশাপাশি তার বর্ননা আরেকটি জিনিস তার ভাল লাগে তা হল সেখানে দুজন ম্যাডাম তাদের শিক্ষিকা একজন দেখতে তার মায়ের মত, অন্যজনও আদর করেই পড়াশুনা করায় তাদের হাতে কোন বেত থাকত না কয়েকজন স্যার বেত হাতে ক্লাস নিলেও ছাত্রদের মারত না আর একজন শিক্ষক ছিল হুজুরদের মত দেখতে যাকে সবাই মৌলভী স্যার বলত ঐ স্যারই শুধু বেত নিয়ে ক্লাসে ঢুকত এবং ছাত্রদের বেদম মারপিট করত যদিও পড়াশুনা ঠিকমত দিতে পারলে ছাত্রদের কিছুই বলত না তাই ঐ মৌলভী স্যারের ভয়ে ছাত্ররা পড়াশুনা ভালভাবেই করে যেত। এভাবে বছর দুয়েক পরে যখন সে ক্লাস ওয়ানে ওঠে তখনও সে কিন্তু মক্তবে কম যাওয়ায় এখনও কুরান হাতে নিতে পারেনি। এদিকে স্কুলে তার দিনকাল ভালই কাটছিল কিন্তু বেশকিছুদিন হল সে তার সহপাঠিদের সাথে স্কুলে যাওয়া আসার পথে কয়েকটি গাছের ফল চুরি করে সবাই মিলে খেত যা তার বাবার কাছে নালিশ যায় আবার স্কুলে কয়েকজন ছেলের সাথে তার মারামারিও হয় সেটাও তার বাবার কানে যায় তাই তার বাবা রমিজ উদ্দিন তার মাকে বলে ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে দুষ্ট হয়েছে কারন তার ১ম মেয়ে ক্লাস সিক্সে উঠেই এক ছেলের সাথে প্রেম করে তাই তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় এরপরের মেয়ে ক্লাস নাইনে থাকাকালীন তাদের বাড়িতে এক গরীব ছেলেকে লজিং হিসেবে রাখার পর এই মেজ মেয়েটিও তার সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় তাকেও বিয়ে দেওয়া হয়, ৩ নাম্বার মেয়েটাই শুধু কলেজে পড়ছে এসব ব্যাপারে তার রিপোর্ট ভাল হলেও তার আচার-আচরন রমিজ উদ্দিনের কাছে মোটেও ভাল লাগে না, মোটকথা মেয়েদের পড়াশুনা করতে দিলেই কিভাবে যেন তারা নষ্ট হয়ে যায়, যদিও এটা সে খুব ভাল করেই জানে কিন্তু পড়াশুনা করতে না দিলে আবার ভাল পাত্রও পাওয়া যায় না তাছারা অত্র এলাকায় মহিলা মাদ্রাসাও নেই যে সেখানে তাদের পড়বে তাছারা তার বন্ধুর এক মেয়েকে নাকি শহরে আলিয়া মাদ্রাসায় পড়তে দিয়েছিল দাখিল পরিক্ষায় পাশ করার আগেই নাকি সে পিতা-মাতাকে না জানিয়ে ঐ মাদ্রাসারই এক হুজুরের সাথে ভেগে গিয়ে বিয়ে করে কারন পিতা-মাতারা নাকি ঐ হুজুর গরীব বলে কিছুতেই বিয়ে দিতে রাজি ছিল না। সুতারং মেয়েদের মাদ্রাসায় পড়িয়েও ভরসা নেই তবে অনেক ভেবেচিন্তে আব্দুল্লাহর মায়ের মানত অনুযায়ি সে ছেলের ব্যাপারে অনেক আশাবাদী যে তার ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়িয়ে যদি হাফেজ-মাওলানা বানাতে পারে তবে পরকালে তার ছেলে আব্দুল্লাহর শাফায়েতে পাপী রমিজ উদ্দিনের পুরো পরিবারই বেহেশতে যাবার সৌভাগ্য হবে কারন সে হুজুরদের ওয়াজ-খুতবায় বহুবার শুনেছে যে একজন আলেম ৭০ জনকে শাফায়েত করতে পারবে এমনকি কেউ যদি অনেক পাপি হয় তবু সেই পাপী যদি কোন একজন আলেমের প্রতি ভালবাসা-মহাব্বত রাখে তবে সেই ভালবাসার উচিলায়ও নাকি আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে বেহেশতে দিবেন। একজন আলেমের এত মরতবা অন্যদিকে আব্দুল্লাহ মাত্র কয়েক বছর স্কুলে পড়েই চুরি করা আর মারামারি করা শিখেছে! এতো দেখা যাচ্ছে এর বোনদের চাইতে বেশি খারাপ হবে স্কুলে পড়ালে তাই আব্দুল্লাহকে সে খুব দ্রুত মাদ্রাসায় দিতে চায় যদিও সে মক্তবে কুরান পড়া শিখেনি আর এতে খুব সমস্যাও নাকি হবে না বলেছে মসজিদের ইমাম সাহেব।
রমিজ উদ্দিন মাতব্বর একটু মোল্লা টাইপের মানুষ বলে সমর্থ থাকার পরও সে তার বাড়িতে টিভি আনেনি কিন্তু নিজের স্ত্রী, মেয়েসহ কাজের লোক পর্যন্ত পাশের বাড়ির করিম বিএসসির বাড়িতে অনেক আগে থেকেই টিভি দেখতে যায়, মানা করলেও শুনে না লুকিয়ে লুকিয়ে ঠিকই যায়, এদিকে কিছুদিন হল এক বিচারে করিম বিএসসির সাথে তার কথা কাটাকাটি হয় এরপর হতে সে আর রমিজ উদ্দিনকে রাস্তায় দেখা হলেও সালাম দেয় না তাই রমিজ উদ্দিনও আর করিমের সাথে কথাবার্তা বলে না অথচ সেই করিমের বাড়িতেই কিনা তার পরিবারের মেয়েরা এখনও টিভি দেখে? এতে তার মান-মর্জাদার কি দাম থাকল? ব্যাপারগুলো আব্দুল্লাহর মাকে বুঝিয়েও কোন লাভ হল না, সে ও তার মেয়েরা চুরি করেই যায় এমনকি ছোট্ট বাচ্চা আব্দুল্লাহকে নিয়েই যায়। এসব দেখে রাগে তার মনে চাইত করিমের বাড়ির টিভিটা ভেংগে ফেলতে অথবা করিমের টিভির চাইতে বড় একটা টিভি তার নিজ ঘরেই কিনে আনতে কিন্তু হুজুররা বলে টিভি হল শয়তানের বাক্স তাই কিভাবে সে এটাকে ঘরে আনতে পারে! এদিকে তার ছেলে আব্দুল্লাহও বড় হচ্ছে তাকে তো হুজুর বানাবে সে যদি টিভি দেখে নষ্ট হয়ে যায়? কিন্তু এক হুজুরের ওয়াজে সে শুনেছে যে টিভিতে অনেক ভাল জিনিসও দেখায় যেমন-খবর, শুধুমাত্র খবর দেখার উদ্দেশ্যে টিভি দেখলে নাকি হারাম হবে না। তাই সে আর দেরি না করে শহর থেকে বেশ দাম দিয়ে বড় একটা টিভি ঘরে নিয়েই আসে শুধু খবর দেখার উদ্দেশ্যে, সে ধরে নিয়েছিলে এতে তার পরিবারও করিমের বাড়ি গিয়ে আর নাটক-ফাটক দেখবে না আর নিজ ঘরে শুধুই তার সাথে খবরই দেখবে আর বাদবাকী সময় সে টিভি বন্ধ করেই রাখবে কিছুতেই চালাতে দিবে না। কিন্তু টিভি কিনে আনার পর সকলেই খুশি হলেও সে যখন টিভি ছেরে শুধুই খবর দেখে তখন তার পরিবারের কেউ থাকে না! শুরুতে শুধু তার স্ত্রীই সাথে বসে খবর দেখত কিন্তু তেমন কিছু বুঝত বলে মনে হত না এমনকি তেমন আনন্দও পেত না এর কিছুদিন পর থেকে তার স্ত্রীও আর তার সাথে বসে খবর দেখে না, বাধ্য হয়ে সে একাই খবর দেখে আর সে ঘরে থাকাকালীন বাদবাকী সময় টিভি বন্ধই থাকত।
রমিজ উদ্দিনের দিন রাত বেশিরভাগ সময়ই বাইরে কাটাতে হত, একমাত্র রাত্রেই সে ঘরে আসতে পারত তখন সে শুধুই খবর দেখে টিভি বন্ধ করে শুয়ে পরত কিন্তু সে কিছুদিন পরে জানতে পারে যে যখন সে বাইরে থাকে তখন নাকি প্রায় সময়ই তার বাড়িতে টিভি চলে আর সেসময় নাকি খবর না দেখে শুধুই নাটক সিনেমা গান ইত্যাদি দেখে পরিবারসহ আশপাশের প্রতিবেশীরাও আর যখনই তার বাড়ি আসার সময় হয় তখনই আগেভাগেই টিভি বন্ধ করে যে যার যার মত কাজে চলে যায়, এসব শুনে রমিজ উদ্দিন মাতব্বর ভীষণ রাগান্বিত হয় এবং তার স্ত্রীকে বললে সে উত্তর দেয়- আপনি চলে গেলে সকলেই এমন জড়াজড়ি করে যে সেও নাকি বাধ্য হয় তাদের আবদার মানতে কিন্তু কে বা কারা সবচেয়ে বেশি জড়াজড়ি করে তা সে স্পষ্ট করে বলে না তবু রমিজ উদ্দিন তার স্ত্রীকে শাষিয়ে দেয় যেন টিভিতে খবর ছাড়া আর কোনকিছু না দেখে। কিছুদিন পর রমিজ উদ্দিন জানতে পারে যে তার বাড়িতে বিশেষ করে রাত্রে সকলেই বেশী ভীর করে নাটক দেখার জন্য তাই একদিন সে রাত্রে ঠিক ঐ সময়েই তারাতারি বাড়ি ফিরে দেখে তার বাড়িতে সিনেমা হলের মত লোকজন জড়ো হয়েছে। সে দেখে ছোট ছেলেমেয়েসহ তার পাশের বাড়ির দুই ঘনিষ্ঠ মুরব্বীরাও আছেন, উনাদের দেখে রমিজ উদ্দিন অবাক হয় আর সেদিন টিভি বন্ধ করতে বলেও না, সকলে তখন নাটক দেখছিল তাই সেও বসে নাটকে কি হচ্ছে দেখতে থাকে আর মনে মনে ভাবতে থাকে আজকে অন্তত দেখুক কেননা অনেক গন্যমান্য লোকও আছে এদের সামনে টিভি বন্ধ করলে ভাববে সে টিভির অহংকার করছে যদিও এরপরে আর দেখতে দিবে না। নাটক চলার মাঝে হটাৎ এড শুরু হলে তার পাশের মুরব্বীরা বলল- খবর আর নাটক ছাড়া তারা আর কিছুই দেখে না কারন এই দুটি জিনিসে কোন অশ্লীলতা নেই বরং শিক্ষনীয় অনেক কিছু আছে সিনেমা আর গান দেখা সরাসরি হারাম, রমিজ উদ্দিন মাথা নারিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সম্মতি জ্ঞাপন করল আর নাটকটি ভালভাবে চুলচেরা দেখতে লাগল যে কোথাও কোন অশ্লীলতা আর শিক্ষনীয় বিষয় আছে কিনা ? তার নাটক দেখে মনে হল এসব নাটকে অশ্লীলতা তো নেইই বরং নাটকে যেসব মেয়েদের দেখানো হয়েছে তার চাইতে তার গ্রামের মেয়েছেলেরাই বেশী বেপর্দা হয়ে থাকে, অধিকাংশ মহিলারাই মাথার চুল তো খোলা রাখেই এরসাথে পেট পিঠও খোলা রাখে কিন্তু নাটকের মেয়েদের শুধু চুলই খোলা ছিল আর সবচেয়ে ভাল ব্যাপার হল সে নাটকে অনেক শিক্ষনীয় বিষয় খুজে পেল এমনকি এই নাটক এমন এক জায়গায় শেষ হল রমিজ উদ্দিনের মনই খারাপ হয়ে গেল সে বলল কাহিনী এখানে সমাপ্ত না হলেও পারত কিন্তু তখনি তার পাশে বুড়ো লোকটি বলল- কাহিনী এখানেই শেষ নয় সামনের শুক্রবারে নাটকের পরের কাহিনী দেখানো হবে এটাকে নাকি বলে ধারাবাহিক নাটক বা টিভি সিরিয়াল যা একদিনেই শেষ না হয়ে অনেক দিন পরে শেষ হয়, তখন রমিজ উদ্দিন ভাবল সামনের বারে সে অবশ্যই এই নাটক দেখবে আর তার বাড়িতে খবর আর এই ধরনের নাটক ছাড়া আর কিছু চালানো যাবে না। এরপর হতে রমিজ উদ্দিন প্রায়ই বাড়িতে তারাতারি ফিরত এই আশায় যে সকলের সাথে বসে রাত্রের নাটক দেখবে। যাইহোক আব্দুল্লাহর বাবা রমিজ উদ্দিন টিভি কেনার পুর্বে বাড়িতে শুধু একটা ক্যাসেট প্লেয়ার কিনেছিল রেডিওর সংবাদ শুনা আর মাঝেমধ্যে ওয়াজের ক্যাসেট শুনার জন্য। কিন্তু বাবা বাড়িতে না থাকলে আব্দুল্লাহর বোন রেডিওর গান শুনত আর কিছু গানের ক্যাসেট লুকিয়ে রাখত যা মাঝেমধ্যে সে প্লে করত আব্দুল্লাহ তার বোনের সাথে বসে বসে এসব শুনত আর তার এসব গান খুবই ভাল লাগত, মাঝেমধ্যে তার বাবা ওয়াজের ক্যাসেট যখন চালাত তখন আব্দুল্লাহর তেমন ভাল লাগত না কারন এসব ওয়াজের সুর আর তাদের বাড়িতে প্রতি শুক্রবারে ভিক্ষা করতে আসা দুইজন ফকিরের সুর অনেকটাই একইরকম ছিল। রেডিও ক্যাসেটের গানের সাথে টিভি প্রচারিত গানের অনেকটা মিল থাকায় সেগুলোও তার খুবই পছন্দ হত আর সবচেয়ে বেশি ভাল লাগত সিনেমা, কিন্তু সিনেমা প্রতিদিন হত না তবে যেদিন হত সেদিন তার খুবই আনন্দ লাগত কেননা এইদিন অনেকেই সিনেমা দেখতে আসত আর অনেকক্ষন ধরে চলত, গানসহ মারামারি-ফাইটিং দৃশ্যও থাকত যেগুলো তার খুবই পছন্দনীয় ছিল।
প্রতি শুক্রবারে তার বাবা আব্দুল্লাহকে আগেভাগেই গোসল করিয়ে জুম্মার নামাজে নিয়ে যেত এজন্য যে আগে গেলে নাকি একটা ঊট কুরবানীর সওয়াব পাওয়া যায় এদিন তার বাবা নাকে পাঞ্জাবী-পায়জামা এবং আতর লাগিয়ে নিয়ে যেত কিন্তু তার এসব মোটেও ভাল লাগত না কারন, পায়জামার দড়ি সে ভালভাবে বাধতে পারত না আবার তার বাবা বেধে দিলে সে খুলতে পারত না পরে তার মা বা বোনকে দিয়ে খুলে নিত এছারা তার বাবা যে আতর ব্যাবহার করত এবং তার কানের মাঝেও তুলা দিয়ে লাগিয়ে দিত সেই আতরের গন্ধে তার ভয়ের অনুভুতি আসত কারন তাদের গ্রামে কোন মানুষ মারা গেলে গোলাপ-জল এবং আগর বাতির যেরকম গন্ধ বেড় হত ঠিক সেরকমই একটা গন্ধ তার বাবার আতরে থাকত, কোন মানুষ মারা গেলে সবাই কান্নাকাটি করত আর তার খুবই ভয় লাগত কিন্তু প্রতি জুম্মাবার তার বাবার আতর লাগানোতে প্রায় সারাদিনই তার সেই গন্ধ নাকে ভেসে আসত আর তার কাছে সেই মরা বাড়ির অনুভুতি মনে আসত। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগত তার জুম্মাবারে আগেই মসজিদে এসে ইমাম সাহেবের ওয়াজ শুনা, কারন খতিব সাহেব কি বলত তার কিছুই বুঝত না শুধু কিছুক্ষন পর পর সুবহানাল্লাহ বলতে হত এভাবে একসময় তার ঘুম চলে আসত, তার সহপাঠি যারা ছিল তারা প্রায় সকলেই আসত অনেক পরে আর বসত পিছনে যতক্ষনই ওরা খুতবা পেত ততক্ষনই গল্পগুজব করত, এসব দেখে আব্দুল্লাহর মনে হত- বাবার সাথে না এসে তাদের সাথে যদি আসত তবে খুবই মজা হত আর বাড়ি ফিরতেও পারত তারাতারি। আব্দুল্লাহ শুধু শুক্রবারের নামাজই পড়ত যদিও সেটি তারকাছে মোটেও মজার কিছু ছিল না কিন্তু তাদের মসজিদে একবার তাবলীগ জামাত আসল আর অনেকেই ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে লাগল এমনকি তার খেলার সাথীরাও ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করল তা দেখে আব্দুল্লাহও নিয়মিত মসজিদে যাওয়া শুরু করল কিন্তু বড়রা ছোটদের একদম পিছনের সারিতে নামাজ পড়তে বলত তখন নামাজের মধ্যেই ছেলেপেলেরা অনেক দুষ্টমী করত এমনকি চিমটি কাটা, কাতুকু্তু দেওয়া, হাসাহাসিও করত এসব আব্দুল্লাহর আরো বেশী ভাল লাগত এমন মজার উদ্দেশেই সে ফজরের নামাজসহ জামাতে পড়া শুরু করল এসব দেখে তার বাবা মাও ভীষন খুশী, তারা নামাজের মাঝে দুষ্টমী করায় নামাজ শেষে অনেক সময় মুরব্বীদের কেউ সতর্ক করত অনেক সময় গালিও দিত আবার অনেক সময় কেউ কিছুই বলত না তবে হাসাহাসি আর দুষ্টমীর পরিমান বেশী হলে কেউ কেউ বলত- তোদের মাঝে কে এমন করেছে নাম বল কিন্তু কেউই নাম বলত না কারন সবাই এমন করত। একদিন নামাজের মাঝে দুষ্টমীর পরিমান এতবেশী হয়ে যায় যে জামাতে নামাজরত অবস্থায় কিল ঘুষি আর জোড়ে জোড়ে আওয়াজ করতে থাকে তখন নামাজের ছালাম ফেরানোর পর ইমাম সাহেব বেত নিয়ে ছেলেদেরকে মারতে এলে সকলেই মিলে দৌড় দিয়ে মসজিদ হতে পলায়ন করে আব্দুল্লাহসহ। সেদিনের ঘটনার পর থেকে আব্দুল্লাহ এবং অন্নান্য ছেলেপেলেও মসজিদে ভয়ে আর নামাজ পড়তে যায়নি।
আব্দুল্লাহর বয়স যখন ১০ এর কাছাকাছি তখন তার বাবা তাদের মসজিদের ইমামের সাথে বরিশাল জেলার একটা বড় কওমী আবাসিক মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে রেখে আসে। তার বাবা চলে যাবার পরে তার এত খারাপ লাগে যেন তাকে একটা জেলখানায় রেখে গেছে আর ১ম কয়েকদিন রাত্রে তার মা-বাবা, বোনের কথা মনে করে সে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছেও। তাছারা এখানকার মাদ্রাসার ছাত্রদেরও তার তেমন ভাল লাগত না বেশিরভাগই গরীব শ্রেনীর আর খ্যাত টাইপ যদিও কয়েকজনের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছে তবু তারা বেশিরভাগই তার বয়সী হলেও খারজী বিভাগে পড়ে আর শুধু বিকাল বেলা খেলার সময়ই দেখা হত অন্য সময় তেমন দেখা হত না কারন তাকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে হাফেজী বিভাগে। আব্দুল্লাহর বাবাকে মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফেজ সাহেব বুঝিয়েছে যে ১মে হাফেজ হয়ে তারপর আলেম হলে বেশি ফায়দা তাছারা যে পিতামাতা তার ছেলেকে হাফেজ বানাবে হাশরের মাঠে তাদের মাথায় নাকি নূরের তাজ পরানো হবে। কয়েক বছরে পুরো কুরান আরবী ভাষায় অর্থ না বুঝে শুধু মুখস্ত করলেই সে হাফেজ হয়ে যায় কিন্তু এতবড় কুরান শরীফ আব্দুল্লাহ কিভাবে মুখস্ত করতে পারবে সেটা তার মাথায় খেলত না এবং ভীষন ভয়ও লাগত নাজানি এজন্য তাকে কত বেশি পড়াশুনা করতে হয়। তবে কিছুদিন পর আব্দুল্লাহর আগের মত আর খারাপ লাগত না, ইদানিং তার মাদ্রাসাতে দুটি সময় বেশ আনন্দ বিনোদনে কাটত আর এই দুই সময় কখন আসবে তারজন্য সে সর্বদাই ব্যাকুল থাকত ১ম সময়টি হল- বিকেল বেলা খেলার সময় আর ২য়টি হল- তিন বেলা খবার সময়, এছারাও মাদ্রাসার ছাত্রদের সংগে তার ভালই ভাব জমে উঠেছে আর তাদের সাথে সে প্রায়ই হাসি ঠাট্টাও করত। আব্দুল্লাহর সবচেয়ে ভাল লেগেছে যেটি তা হল- এখানকার সকলেই তার নাম আব্দুল্লাহ এটাকে খুব সুন্দর করে উচ্চারন করে কিন্তু স্কুল এবং গ্রামের বন্ধু-বান্ধব তার নাম আব্দুল্লাহ হলেও প্রায়ই আব্দুল বলে ডাকত অনেকে আবার আব্দুল বলে তাকে গালিও দিত কিন্তু এখানে সম্পুর্ন তার উল্টো। আর সবচেয়ে আজব ব্যাপার হল মাদ্রাসার ছাত্ররা কালেমার অর্থ করে এভাবে যে- কালেমা- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ অর্থ নাই কোন মা'বুদ আল্লাহ ছাড়া এবং মুহাম্মদ সঃ আল্লাহর রসুল । কিন্তু আব্দুল্লাহ এতদিন কালিমার অর্থ জানত এরকম- আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই আর মহানবী হযরত মুহাম্মদ সঃ আল্লাহর প্রেরিত নবী ও রসুল। শুধু তাই না স্কুল আর বাড়ি হতে যে শিক্ষা সে পেয়েছিল তাতে তার মনে হয়েছিল যে উপাস্য আর মাবুদ একই জিনিস অর্থাৎ আল্লাহ। কিন্তু মাদ্রাসায় এসে জানতে পারল- মা'বুদ মানে হল-যার গোলামী করা হয় আর উপাস্য মানে হল- যার উপাসনা বা পুজা করা হয় মোটকথা যার জন্য নামাজ পড়া হয়।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ৮:০৯