প্রজেক্ট পেপারক্লিপ
সিআইএ'র যে কয়টি অভিযান আজও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় তার মধ্যে প্রজেক্ট পেপারক্লিপ অন্যতম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স জার্মানির বৈজ্ঞানিক সামর্থ্য জানতে বিভিন্নভাবে সার্চ টিম পাঠিয়ে তথ্য-উপাত্ত হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মূলত জার্মানির প্রযুক্তিগত শক্তিমত্তা জানতে ভীষণ তৎপর হয়ে ওঠে সিআইএ। তবে কেউ কেউ বলেন, সরাসরি প্রযুক্তি নয়, জার্মানির চিকিৎসা খাতে প্রযুক্তি ও অগ্রগতি এবং রকেট ও বিমান বাহিনীর উৎকর্ষতা জানতে সংগঠনটি মরিয়া হয়ে ওঠে। যদিও কাগজে-কলমে এটুকুই ছিল সিআইএ'র গোয়েন্দা তৎপরতার মূল বিষয়, কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। নজর রাখছিল জার্মানিতে থাকা বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার এবং সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের ওপর। সিআইএ ধারণা করেছিল এদের কব্জা করতে না পারলে বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিকে দমানো যাবে না। 'অপারেশন ওভারকাস্ট' ছিল এই গোপন গোয়েন্দা তৎপরতার আসল নাম, যা বাইরে থেকে প্রজেক্ট পেপারক্লিপ বলে প্রচার হয়েছিল। অপারেশন ওভারকাস্টের মূল ফোকাস ছিল সেরা মেধাবীদের বুঝিয়ে, ব্রেইনওয়াশ করে আমেরিকার পক্ষে কাজ করানোর। এত বড় একটি প্রজেক্টেও সিআইএ অত্যন্ত গোপনে কোনো ভিসা ছাড়াই প্রায় এক হাজার ৬০০ বিজ্ঞানীকে তাদের পরিবারসহ জার্মানি থেকে আমেরিকায় সরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এদের দিয়ে পরবর্তী সময়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মিসাইল ও ব্যালাস্টিক মিসাইলের নকশা প্রণয়ন করে সিআইএ। সিআইএ'র এই প্রজেক্টটি ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ও লাভজনক। জার্মানির সেসব বিজ্ঞানীকে কাজে লাগিয়ে সিআইএ, এমনকি নাসা পর্যন্ত বিভিন্ন মহাকাশ প্রোগ্রামে অনেক সফলতা পায়। সিআইএ'র পুরো গোয়েন্দা ইতিহাসে সবচেয়ে সফল প্রজেক্ট এই পেপারক্লিপ।
পিগস ইনভেশন বা জ্যাপাট
অপারেশন জ্যাপাটা নামে অধিক পরিচিত সিআইএ অপারেশন দ্য বে অব পিগস ইনভেশন। সিআইএ গোয়েন্দা হামলার তালিকায় বরাবরই শীর্ষস্থানে অবস্থান করে এই অপারেশন। শুধু সিআইএ নয়, বরং সারা দুনিয়ার ইতিহাসের সেরা গোয়েন্দা হামলার একটি এই অপারেশন জ্যাপাট। অপারেশন জ্যাপাট যে শুধু সিআইএ'র জন্য একটি দুর্ধর্ষ অভিযান ছিল তা নয়, গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে সিআইএ কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে সেটার একটি চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়ায়। ১৯৬১ সালে কিউবায় প্রায় এক হাজার ৫০০ অত্যন্ত দক্ষ সিআইএ সেনা এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিল। পিগস ইনভেশন নামটি দেওয়া হয় গোয়েন্দা হামলার মারাত্দক ব্যর্থতার জন্য। এই অপারেশনে সংগঠনটির কয়েক হাজার সেনা কিউবার সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং তাদের নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করা হয়। ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সিআইএ এই গোয়েন্দা হামলার নীলনকশা করেছিল। বাইরে থেকে পরিকল্পনার সব ঠিক দেখালেও কিউবায় হামলা করতে নেমে পরিস্থিতি একেবারেই সিআইএ'র প্রতিকূলে চলে যায়। একে তো ক্যাস্ট্রোর ব্রিগেড সিআইএ'র হামলা সম্পর্কে আগেই জেনে ফেলেছিল এবং ক্যাস্ট্রোর সেনা ব্রিগেডের বিছানো ফাঁদেই সিআইএ পা ফেলেছিল। সব মিলিয়ে সিআইএ'র অপারেশন জ্যাপাটা ছিল একটা লম্বা দুঃস্বপ্ন। বোদ্ধারা বলেন, সেই অপারেশনের ক্ষয়ক্ষতি আজও পুষিয়ে উঠতে পারেনি তারা। এক হাজার ৫০০ জনের সিআইএ'র প্রশিক্ষিত বাহিনী কিউবার উপকূলে নামমাত্র হামলা করতে পেরেছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কিউবার সেনা ব্রিগেড তাদের ঘিরে ধরে এবং আটকে ফেলে। তথ্যগত কোনো ত্রুটি যতটা না ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল প্রতিপক্ষের সামর্থ্য মোকাবিলায় নিজেদেরে দুর্বলতা। তবে সিআইএ ছেড়ে কথা বলেনি। কিউবা সীমান্তে প্রতিরোধ গড়ে তোলে কিউবা ব্রিগেড। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সিআইএ বাহিনী ধরা পড়ে গেলে পুরো যুদ্ধের ময়দানে আলোচিত হয় সিআইএ'র সামর্থ্য নিয়ে।
অথচ পরে জানা যায়, সিআইএ'র আমেরিকান সেনা ছিল ২০০ জনের মতো। সামান্য এক তরফা লড়াইয়ের পর কিউবার
ব্রিগেডের কাছে হাজারখানেক সিআইএ এজেন্ট ও যোদ্ধা জবাই হয়ে যায়। এত বড় আকারের অপারেশনে সিআইএ'র এই হতাশাজনক পরিণতি ঘটলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ইতিহাসে এই হামলা একটি অন্যন্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
অপারেশন গোল্ড
ফোনকলে আড়িপাতার চর্চা অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। তবে এর গোড়াপত্তন হয় রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শীতল টানাপড়েনের পরই। রাশিয়া যখন বার্লিনে তাদের যুদ্ধকৌশল বিস্তারের জন্য ফোনকল নির্ভর হয়ে পড়ে তখনই তথ্যচুরির জন্য সিআইএ ফোনকলে আড়িপাতার ধারণাটির জন্ম দেয়। শুরু হয় বিশাল আকারের ফোনকল চুরির ঘটনা। সিআইএ খুব গোপনে এই মাস্টার প্ল্যানটি দাঁড় করায়। অপারেশন গোল্ড নামটা শুনে অনেকেরই মনে হতে পারে স্বর্ণ উদ্ধার বা স্বর্ণ নিয়ে কিছু একটা হবে। আসলে এই অভিযানে স্বর্ণ নিয়ে কোনো হানাহানি নয়, তবে সিআইএ'র স্বর্ণোজ্জ্বল একটি অভিযান ছিল এই অপারেশন গোল্ড। ব্রিটিশ সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস ১৯৫৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে শীতল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সে সময় ইন্টেলিজেন্স টিম এম-১৬ নিয়ে কাজ করে। শুরুতেই রাশিয়ার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ফোনকলে আড়িপাতে। ফোনকলে আড়িপাতার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সিআইএ দুর্ধর্ষ একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। রাশিয়ার সামরিক শক্তির নিরাপত্তা বলয়ে ঢাকা পূর্ব বার্লিনে সিআইএ ঢুকে পড়ে। পূর্ব বার্লিনে সবচেয়ে ব্যস্ততম সড়কের নিচ দিয়ে চলে গেছে টেলিফোনের তার। রাস্তার নিচে প্রায় ১,৪৬৭ ফুট লম্বা টানেল ধরে এগিয়ে যায় ইন্টেলিজেন্স টিম এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সংযুক্ত করে টেলিফোনের তারে। ১৯৫৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে পুরো কাজটি শেষ হতে সময় নেয় ১৯৫৫ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ফোনকলে আড়িপাতার ঘটনা কতটা ভয়াবহ ছিল সেটা একটা ছোট উপাত্ত দিয়ে অনুমান করা যায়_ মাত্র এক বছরেই রাশিয়ার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পাঁচ লাখ ফোনকলে আড়িপাতে সিআইএ! আশ্চর্যের এখানেই শেষ নয়, সিআইএ পুরো ব্যাপারটা এতটাই গোপনে ও সফলভাবে করে যে, ব্রিটিশসহ অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এর খোঁজ পর্যন্ত পায়নি। তবে রাশিয়া কৌশলগত কারণেই পূর্ব বার্লিনে মূল-পরিকল্পনার খুব সামান্যই আদান-প্রদান করত। তাই দেরিতে হলেও ফোনকলে আড়িপাতার বিষয়টি যখন টের পায়, তখন খুব একটা আগ্রাসী মনোভাব দেখায়নি রাশিয়া। সিআইএ'র বিরুদ্ধে পাল্টা হামলায় যায়নি তারা। তবে পৃথিবী প্রথমবারের মতো জানতে পারে ফোনকলে আড়িপাতায় সিআইএ'র এ মারাত্দক দক্ষতার কথা।
সংগৃহিত