বাচ্চাটা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে। আমি হা করে তাকিয়ে দেখছি। আমি কিচ্ছু করছি না দেখে বাচ্চা আরো জোরে জোরে কাঁদছে। বাচ্চার কান্না থামানোর চেষ্টা করা উচিত। এই বাচ্চার কান্না থামানোটা ভয়ংকর কঠিন কাজ। আমার অভিজ্ঞতা বলে, এই বাচ্চার কান্না থামানো যায় না। বাচ্চার দোষ তেমন নাই অবশ্য। বাচ্চা কাঁদলে বাচ্চার বাবা দৌড়ায় আসে, কোলে তুলে নিয়ে পিঠে চাপড় মেরে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। গরিলা সাইজের বাবার দেড় মণ ওজনের হাত, নরমালি পিঠে হাত বুলায়ে দিলেও আমরা ব্যাথা পাই। বাচ্চা তো সেখানে চাপড় খায়, খেয়ে গলা ফাটায় চিল্লায়। এই বাচ্চার কান্না একমাত্র থামাইতে পারে তার মা....
বাচ্চার মা এখন কাছে নাই। নাই বাবার চেয়ে কানা বাবাও হয়ত ভালো, বেচারার বাবাও এখন কাছে নাই। বাচ্চার মামা আমার বন্ধু হয়। তার একমাত্র বড় বোনের একমাত্র ছেলে, বেচারা বাচ্চারে একা রেখে কোথাও যাইতে ডরাইতেছে। তাকে মাঝেমধ্যের টয়লেট ব্রেক দিতে আমার উপস্থিতি।
হালায় আমারে বাচ্চার কাছে গছায় দিয়া সেই যে বাথরুমে ঢুকছে, আর বাইর হওয়ার নাম নাই। তারে ডাকতে যেয়ে দেখি বাথরুম থেকে সিগারেটের গন্ধ আসে। তারে এখন বাথরুম থেকে বের করা সম্ভব না। আমি হতাশ হয়ে বাচ্চার কাছে এসে বসি।
বাচ্চা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতেছে তো কাঁদতেছেই.....
বাচ্চাটার কান্না থামানোর জন্য আমার কিছু করা উচিত। এইটা বাচ্চাটাও বুঝতেছে, আমাকেও বুঝানোর চেষ্টা করতেছে। আমি বুঝার চেষ্টা করতেছি না। মুগ্ধ নয়নে একজন মানুষের কান্না দেখছি। হ্যাঁ, একটা মিনি সাইজের, কাজ-কর্মে অক্ষম, অন্য মানুষের উপর ফুললি ডিপেনডেন্ট, বেচারা টাইপের মানুষ; তবু, মানুষ তো। আর মানুষটা কাঁদছে.....
মানুষ কাঁদে।
হ্যাঁ, মানুষই তো বেশি কাঁদে। ল্যাক্রিমাল নামের একটা গ্ল্যান্ড আছে, তার সিক্রেশন হয়; মানুষ কাঁদবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তাহলে মানুষকে কাঁদতে দেখলে এতটা অস্বাভাবিক লাগে কেন? খারাপই বা লাগে কেন?
সামনের বাচ্চাটার মত পিচ্চি ছিলাম একসময়। আমিও হয়ত এতটাই কাঁদতাম। সবাইই কাঁদে। তারপর বয়েস বাড়ে। ক্ষেত্র বিশেষে খুব করে কান্না করা তখনও জায়েজ, "আম্মু, গাড়িটা দাও না কিনেএএএএ.... (ভ্যাঁএএএএ কান্না)"
বয়েস আরেকটু বাড়ে। কান্না তখন ফোঁপানির গন্ডি পার করাও নিষেধ, সেও আবার খুব কাছের মানুষের চেনা গন্ডির মধ্যে। বাইরের কারো দেখতে মানা। আরও কিছুদিন পর সেই কাছের মানুষদের কাছ থেকেও আড়ালে চলে যেতে হয়। ঘরের ভেতর লুকিয়ে কাঁদে কেউ কেউ। কেউ কেউ সেখানেও মুখ শক্ত করে রাখে।
আমি কিন্তু খুব কাঁদতাম। ছিঁচকাঁদুনে ছিলাম, অনেক বড় হওয়া পর্যন্তও সামান্য কারণে কাঁদতাম। এতটাই কাঁদতাম, যে নিজের মা পর্যন্ত পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে বসলেন, "ছেলেমানুষ, এত কাঁদতে আছে?"
খুব নাটক করে বলা যায়, "তারপর থেকে আমি আর কাঁদিনি", মিথ্যে বলা হবে।
অনেক কেঁদেছি, এখনও কাঁদি, বেশিরভাগ সময়ই একা কাঁদি। কারণে কাঁদি, অকারণে কাঁদি। অন্য সব মানুষও কাঁদে। আপনিও কাঁদেন, বাথরুমে বসে থাকা আমার বন্ধুটাও কাঁদে। আমি দেখেছি, আমার কাঁধে মুখ লুকিয়েই কেঁদেছে কতদিন......
বেশিরভাগ মানুষের কান্নাই এক উপরওয়ালা ব্যতিত আর কেউ শোনে না। আর উপরওয়ালা শুনেও তাতে খুব বেশি পাত্তা দেন বলে মনে হয় না.....
বাচ্চাটার কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কিছুক্ষণ ফোঁপায়, তারপর আবার কাঁদে। কত বছর হবে বাচ্চাটার? এটুকু বয়সে লাইফ লেসন দেয়ার জন্য বসায় বসায় কাঁদানো ফালতু একটা কাজ হচ্ছে। এই কথাটা নিজে উপলব্ধি করে বাচ্চাটাকে কোলে নেবার আগেই বন্ধু মহাশয় হই হই করে মামাগিরি ফলাইতে আসে,
"কিইইই রে, পোলাটারে বসায় বসায় কান্দাইতাছস! কোলে লইতে পারস না?"
"দোস্ত, আমি ডায়পার ডরাই!"
"হ হইছে, যা অহন, ভাগ।"
"ভাগ মানে? আমার বেনসন কই?"
"তুই না খাস না?"
"খামু না, দোকানে বেচুম। ওই টাকা দিয়া কোক কিনুম, না পাইলে স্প্রাইট কিনমু, তুমি আমার ভাগ মারতে পারো না!"
বন্ধু তার ভাগনের ডায়পার পাল্টাচ্ছে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি।
না না, সিগারেট খাচ্ছি না। খুব গরম বলেই কি না, ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার একটু খোলা হাওয়ার দরকার......