টিপাইমুখ বাঁধ। আসলে কি হতে পারে বাঁধ নির্মাণের ফলে? আমরা অনেকেই মিডিয়াতে পড়ছি। প্রতিনিয়ত জানতে পারছি। আসুন টেকনিক্যালি ব্যাপারটা একটু জেনে দেখি।
খুব সংক্ষেপে বলব। ফারাক্কা বাঁধ আর টিপাইমুখ কিন্তু এক না। এটা একটু খেয়াল রাখতে হবে। ফারাক্কা ব্যারেজ পৃথিবীর সব থেকে বড় বাঁধ যেটা নির্মাণ করা হয়েছিল, গঙ্গার পানিকে বাংলাদেশে ঢুকতে না দিয়ে কোলকাতার হুগলি নদীতে ডাইভার্ট করার জন্য। অনেকে মনে করেন ফারাক্কা দিয়ে পানি আটকে ভারতীয়রা সেচ কাজ করবে। আসলে তা নয়, এই বাঁধের কাজই হচ্ছে পানিকে ডাইভার্ট করে দেওয়া। বাংলাদেশের সাথে যুক্তি মোতাবেক ভারত একটা নির্দিষ্ট পরিমান পানি প্রতিবছর বাংলাদেশকে দিবে।
যদিও তা তারা করে না। ভারত বাঁধ দিয়ে হুগলিতে পানি দিত, কারণ হুগলিতে প্রাকৃতিক ভাবে গঙ্গার পানি যেত না। ফলে নদী শুকিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে এই বাঁধ নির্মাণের ফলে গঙ্গার অতিরিক্ত পানি হুগলিতে হুরমুর করে ঢুকে পড়ে, তার ফলে সেখানে বন্যা হয় প্রতিবছর। ভারত তখন এই অতিরিক্ত পানিকে বাংলাদেশের দিকে পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশের নদীগুলো তখন ভরাট হয়ে বন্যা হয়। ব্যাপারটা উভয় সংকট। এখন কথা হলো, এই বাঁধ নির্মাণের ফলে আসলে কে কতটা লাভবান হয়েছে?
বাঁধ নির্মাণ না করে নদী ড্রেজিং করলে হুগলী শুকাত না। আর অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে বন্যাও হত না। ব্যাপারটা খুব সাধাসিধা। ভারত তা না করে বাংলাদেশের উপর তাদের পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করল, যা একটা বড় দেশ হয়ে ছোট দেশের প্রতি জঘন্য আচরণ।
এবার আসি টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে। টিপাইমুখ বাঁধের স্ট্রাকচারটা ভালো করে লক্ষ্য করলাম। এটা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নির্মীত হচ্ছে। এটাতে নদীর পানি ডাইভার্ট করার কোন সিস্টেম নাই। তবে মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকটা বাঁধে একটা নির্দিষ্ট পরিমান পানি ধরে রাখার ক্ষমতা থাকে। টিপাইমুখ বাঁধের এই ক্ষমতা কতখানি তা আমরা জানি না। তবে মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যায়, অনেক বেশি। কাপ্তাই লেকে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল, তাতে সম্ভবত এগার হাজার কিউবিক মিটার পানি ধরার ক্ষমতা ছিল। যে পানিকে ছেড়ে দিলে, আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। অনেক মানুষ তাদের বাড়ি ছাড়া হয়। এক হিসেবে ৪০ হাজার চাকমা আদিবাসীকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। কাপ্তাই বাঁধ দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন শুনেছি বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আসলেই অনেক ক্ষতি হয়। নদীর পানি একসময় তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলে। কাপ্তাই বাঁধের ফলে আমাদের দেশের সে এলাকার অনেক জীব বৈচিত্রের ক্ষতি হয়েছে।
টিপাইমুখ বাঁধ হলেও ঐ এলাকার হাজার হাজার মানুষের ক্ষতি হবে। এবং একসময় এ বাঁধের কার্যকারিতা হারাবে। তখন কিন্তু বাঁধ ঠিকই থাকবে, অথচ, যা ক্ষতি হবার হয়ে যাবে।
কথা হলো, বাংলাদেশের নদীগুলোতে এর প্রভাব কী হতে পারে? এটার দু'টা ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। প্রথমটা হলো, এখানে কোন ব্যারেজ নির্মিত হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের নদীগুলো প্রাথমিকভাবে পানি পেতে পারে। তবে সেটা কয়েকবছরের জন্য। এরপরে টিপাইমুখ দিয়ে পানি আসা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন নদীগুলো শুকিয়ে যাবে।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হলো, ভারত টিপাইমুখে পানি আটকে রাখতে পারবে না। পানি ছাড়তে তাদের হবেই। কিন্তু খেয়াল করুন, পানি ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে, তাহলে বাংলাদেশে সে পানির যতসামান্যই আসবে। এতে আমাদের জীব বৈচিত্র, কৃষি, এবং তথাপি নদী পথের হাজার হাজার প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি হবে। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল একটা মরুভূমিতে পরিণত হবে। ভেবে দেখুন...
বাংলাদেশের বৃহত্তম স্বার্থে আমি বলতে চাই, সরকারি দল আর বিরোধিদলকে ঐক্যে আসতে হবে। এখন ঝগড়া করার সময় নয়। এখন কাজ করার সময়। আমাদের আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। মুছে ফেলতে হবে পূর্বে কে কী করেছে, সেইসমস্ত চিন্তা।
সরকার বরাবরই বলেছে এই বাঁধের ফলে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবে না। বাংলাদেশের তথাকথিত পানি বিশেষজ্ঞ বলে যে কথা ভারতীয় হাইকমিশন বলেছেন, তা আসলেই সত্য। তার বলা উচিৎ ছিল, সরকারি তথাকথিত পানি বিশেষ অজ্ঞরা মনে করেন এই বাঁধ ক্ষতি করবে না।