মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে উদ্দেশ্য করে অত্যন্ত বিনীতভাবে আজ একটি কথা বলছি। এক অন্ধ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় এক সহমর্মী ব্যক্তি তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ডাইনে খানা, একটু বামে চেপে যান। অন্ধ ব্যক্তি বামে চেপে দু-এক পা এগোতেই আর এক জন বললেন, বামে গর্ত ডাইনে চেপে যান। তখন অন্ধ ব্যক্তি দুুঃখ করে বললেন ‘ডাইনে খানা বামে গর্ত, কোন পথে যাই বাবা।’
অন্ধের চলার পথটির দুরবস্থা এমন যে, কোন পাশ দিয়ে সুষ্ঠুভাবে চলার উপায় নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যশোরবাসীর পথ চলার ক্ষেত্রে অবস্থা হয়েছে এমনটিই। সারা জেলা জুড়ে এমন একটি রাস্তা নেই যার অবস্থা ভালো। পাবলিকের অভিযোগ এ দুরবস্থা কেবল যশোর অংশের। খুলনা যেতে নওয়াপাড়া পার হলে রাস্তা ভাল। ঝিনাইদহ যেতে সাত মাইল পার হলে কোন সমস্যা নেই। সীমাখালী পার হলে মাগুরায় যাওয়া যায় ভালো ভাবে। একই অবস্থা নড়াইল সড়কের। এ সড়কের অবস্থাও যশোর অংশের পর ভালো।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার অজানা থাকার কথা নয়, যশোর নামে অতীতে একটি রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যটি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ফলে পর্যায়ক্রমে আজকের জেলায় রূপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রেও যশোর গৌরবের অধিকারী। যুক্তবাংলার প্রথম জেলা এটি। বর্তমানে দেশে যে আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে তার সূতিকাগার হলো যশোর। স্মৃতির স্মারক হিসেবে সেই প্রশাসনিক ভবনটি যশোরে ক্ষয়িষ্ণু স্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা হলো এই যশোর জেলা। স্বাধীন দেশের মুক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন প্রথম জনসভাটি এই যশোরে করেছিলেন।
দেশের প্রথম পৌরসভা, প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি, সেই ব্রিটিশ আমলে নির্মিত বিমানবন্দর ও কেন্দ্রীয় কারাগার যা এখন খুলনা বিভাগীয় কেন্দ্রীয় কারাগারের মর্যাদায় উত্তীর্ণ এই যশোরে অবস্থিত। ফুলের রাজধানী খ্যাত গদখালীর প্রতি দৃষ্টি এখন সারা দেশের। বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। মাছ চাষে যশোরের সাফল্য ঈর্ষণীয়। দেশের মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ মাছের পোনার যোগান দেয় এই যশোর। যশোরের খেজুর রস ও গুড়ের ঐতিহ্য আপনার অজানা নয়। যশোর জেলার ১২ লাখ মানুষ কৃষি ও ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। এই ১২ লাখ মানুষ যশোরের অর্থনৈতিক কর্মকা-কে সচল রেখে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আর এই অবদানকে বেগবান করতে ভালো রাস্তাঘাট অপরিহার্য। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হওয়ায় আর ভারতের কসমোপলিটান রাজধানী কলকাতার সরাসরি যোগাযোগ ও দূরত্ব কম হওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যশোর এগিয়ে রয়েছে। ৩০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম আইটি পার্কটি আপনি যশোরে স্থাপন করে যশোরবাসীর হৃদয় কেড়েছেন। যশোরবাসী অকৃতজ্ঞ নয় বলে পার্কটি আপনার নামে নামকরণ করেছে। শোনা যাচ্ছে এটি আগামী ডিসেম্বর মাসে উদ্বোধন হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গৌরবের স্মৃতিবহ এত কিছু থাকার পরও যশোরবাসী যোগাযোগ সমস্যার কারণে আজ বড়ই নাকাল অবস্থায় আছে। অত্যন্ত কষ্ট নিয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, যশোরবাসীর এই সমস্যা ব্যাপারে আপনার সরকারের যেন বিমাতাসুলভ আচরণ রয়েছে। মানুষের সমস্যার কথা পুলিশের ভয়ে কেউ মুখ খুলে বলতে পারছে না বলে হয়তো আপনি জানতে পারছেন না। গণমানুষের দাবির কথা জানানোর সুযোগ থাকলে আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারতেন যশোর কি রকম সমস্যায় আছে। শুধু জনগণের ওপর পুলিশের অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ হলে জনতা তাদের সমস্যা জানাতে পথে নেমে আসবে। অচল হয়ে যাবে যশোরের সব যোগাযোগ। এখন যে ভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু আছে তা ঠেলে ঠুলে অবস্থা। কথায় আছে ‘এ লোকটা এত মার খেতে পারে?’ এ কথার উত্তর হল, ‘ধরে বেধে মারলে ঠেকাবে কে?’ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কেউ দাবি জানাতে পারছে না বলে কি মানুষের ক্ষোভ প্রকাশ থেমে আছে? নেই। বাসে চলতে গেলে চাকার প্রতি পাকে সরকারের উদ্দেশ্যে যাত্রী ও বাস শ্রমিকরা গালিগালাজ করছে। এই গালির ক্ষেত্রে কিন্তু সরকার বিরোধীরাই অংশ নিচ্ছে তা নয়। সরকারি দলের লোকজনও পিছিয়ে থাকছে না। তবে সরকারি দলের সমর্থকদের গালির ধরনটা একটু নরম। রাস্তার সমস্যার কারণে পথ চলতে শুধু বিরোধী দলের লোকজনের কষ্ট হচ্ছে তা নয়, কষ্টটা সরকারি দলের লোকজনেরও হচ্ছে। আর তাই যশোরের সড়ক সমস্যা এখন গণ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ক্ষিপ্ত হচ্ছে সবাই। আপনি ও আপনার সরকার অহরহ বলছেন উন্নয়নের কথা। কিন্তু আমরা যশোরবাসী তো তার ছিটেফোটাও পাচ্ছি না।
বেশি দূরে যেতে হবে না। যশোর পৌর এলাকার কথাই ধরা যাক। এমন কোন রাস্তা আছে কি যে রাস্তায় নির্বিঘেœ চলাচল করা যাচ্ছে? হাস্যকর ঘটনা হচ্ছে পিচের রাস্তা খানা খন্দে পরিণত হয়েছে আর তা সংস্কারের নামে সেখানে ইটের সলিং করা হচ্ছে। আজব কর্মসূচি।
যশোর পৌরসভার মেয়র জহিরুল ইসলাম রেন্টু চাকলাদার বলেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে যশোর পৌরসভাকে দৃষ্টি নন্দন করে তুলবেন। মেয়রের প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে উল্টোভাবে। অর্থাৎ দৃষ্টিকটু হয়েছে গোটা পৌর এলাকার। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিন্দুকেরা বলছেন, মেয়রের কথার ‘দৃষ্টি’ শব্দটাতো আছে। অসুবিধা কিসের।
দেশের বৃহত্তম স্থল বন্দর বেনাপোল। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাঁচ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় হয় এই বন্দরের মাধ্যমে। কিন্তু বিস্ময়কর ঘটনা হলো এই বন্দরের সঙ্গে সংযোগকারী যশোর-বেনাপোল সড়কের (যশোর রোড) অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এত খারাপ রাস্তা দেশে দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। এই রাস্তাটি হাইওয়েতো বটেই তার ওপর আন্তর্জাতিক সড়ক। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী কার্যক্রমে ঘর-বাড়ি ছাড়া মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে সব চেয়ে বেশি সংখ্যায় যশোর রোড ধরে ভারতে যায়। তারা বেনাপোলের বিপরীতে যশোর রোড দিয়ে সেখানকার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। এভাবে বনগাঁ থেকে কলকাতা পর্যন্ত ছোট-বড় হাট-বাজার বাংলাদেশের বাস্তত্যাগী মানুষে ভরে ওঠে। স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের দুর্বিষহ জীবন চিত্র এঁকেছেন মার্কিন কবি ও সাংবাদিক অ্যালেন গিন্সবার্গ। তিনি ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ শিরোনামে একটি কবিতাও লেখেন । কবি নিজ দেশে ফিরে গিয়ে এক কবিতা পাঠের আসরের আয়োজন করেন। ‘বাংলাদেশের জন্য মার্কিনীরা’ শীর্ষক ওই আসরে তিনি ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতা পাঠ করে সবাইকে আবগাপ্লুত করে তোলেন। এই কবিতাটি গান হিসেবে গেয়ে তার বন্ধুরা শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। আর ওই গানে সুরারোপ করেছিলেন কবির বন্ধু বব ডিলান ও অন্যরা। পরবর্তী সময়ে মৌসুমী ভৌমিক গানটি গেয়ে বাঙালি হৃদয়কে স্পর্শ করে।
যশোরবাসী দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছেন এই ঐতিহাসিক সড়কটি ফোর লেনের হবে। সড়কের পাশের ১৭৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী গাছগুলো রক্ষার স্বার্থে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ৩৮ কিলোমিটার সড়কের ১০ কিলোমিটার ফোর লেনের হবে। বাকিটা দুইপাশে তিন ফুট করে ছয় ফুট বাড়িয়ে উন্নয়ন করা হবে। দু’-দশ দিন যায় আর শোনা যায় অমুক সময় থেকে সড়ক উন্নয়নের কাজ শুরু হবে। কিন্তু কাজ আর শুরু হচ্ছে না। এ দিকে সড়কের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রায় জায়গায় ইটের সলিং বুনে জোড়াতালি দিয়ে কোন রকমে চলছে। এই সড়কটির জন্য শুধু যে যশোরবাসী দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন তা নয়। যেহেতু এটি একটি আন্তর্জাতিক সড়ক সেহেতু সারা দেশের মানুষের সঙ্গে বিদেশিরাও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। এই সড়কটির উন্নয়নের সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তিও জড়িত। আল্লাহ মালুম কবে যশোরবাসী এই সড়কের উন্নয়নের মুখ দেখবে।
যশোরের প্রাণ প্রবাহ বলে পরিচিত ভৈরব নদ আজ মৃত। এ নদের অস্তিত্বের সঙ্গে যশোরে শহরের উন্নয়ন অগ্রগতি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। আর তাই যশোরবাসীর প্রাণের দাবি নদটিকে খনন করে এর বুকে প্রবাহ সৃষ্টি করা। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আপনি যশোরের এই নদটি জীবিত করতে ২৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন, আমরা যশোরবাসী শুনেছি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সব কিছু শোনার মত আর একটি শোনার ঘটনা বাড়লো। কিন্তু দেখার সৌভাগ্য যশোরবাসীর হচ্ছে না। কবে এ নদে প্রবাহ বইবে কবে মানুষ দেখবে মৃত ভৈরব জীবিত হওয়ায় যশোর সঞ্জীবনী শক্তি ফিরে পেয়েছে। এ প্রতিক্ষার কবে হবে শেষ, কবে হবে অবসান।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যশোরবাসীর প্রতি আপনার এত অভিমান কেন? জেলাবাসী তো আপনার প্রতি কোন সময় অবহেলা বা উদাসীনতা দেখায়নি। রাষ্ট্র পরিচালনায় আপনার হাতকে শক্তিশালী করতে জাতীয় নির্বাচনে যশোরের ছয়টি আসনের প্রতিটি থেকে একাধিকবার প্রতিনিধি দিয়েছে। যশোরের আটাটি উপজেলা পরিষদের প্রায় সব ক’টিতে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে যশোরবাসী দেখিয়ে দিয়েছে তারা আপনার প্রতি কতটুকু সম্মান শ্রদ্ধা দেখায়। জঙ্গি ও নাশকতার বিরুদ্ধে যশোরবাসী একট্টা হয়ে আপনার পদক্ষেপকে সফল করতে সারা দেশের মধ্যে দৃষ্টান্ত রেখেছে। এরপরও যশোরবাসীর প্রতি যদি আপনার কোন অভিমান থেকে থাকে তাহলে ভুলে গিয়ে নিজ গুণে ক্ষমা করে দিয়ে যশোরবাসীর প্রতি সদয় হওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনার আদর্শ ও লক্ষ্যের বিরুদ্ধবাদী আমরা নই, আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণকারীও। আপনার কাছে যে দাবি তুলে ধরলাম তা কোন রাজনৈতিক হীন স্বার্থে নয়, নিছক যশোরের আপামর জনতার স্বার্থে মাত্র। মনের অজান্তে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বড় মানুষের কাছে ছোট মানুষটির যদি কোন ত্রুটি হয়ে থাকে তাহলে আমি শেষবারের মতো বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে যশোরবাসীর দাবির কথা শেষ করছি। আপনি ভালো থাকুন।
দেশবাসীর স্বার্থে আপনার মিশন ভিশন সফল হোক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাক এ কামনা করি।