মুক্তিযোদ্ধা রহমতুল্লাহ, ১১ নম্বর সেক্টরের একজন কোম্পানী কমান্ডার ডিসেম্বরে শেরপুর বিজয় অভিযানের সময়ের ঘটনা নিয়ে বলেন
শুরু হল আমাদের যাত্রা । ঘুটঘুটে অন্ধকার ,সামনে ছোট নদী পার হয়ে পানিহাতার দিকে নিরবে চললাম । আনুমানিক রাত ১১টায় পাকস্থানী বাহিনীর ক্যম্পের অতি নিকটে পৌছলাম । আঁধার রাতে কিছুই দেখা যাচিছল না । কিন্তু ক্যাম্পটি দেখা যাচেছ হারিকেন এর প্রজ্জ্বলিত আলোয় । বেশ কিছুক্ষন কাদাযুক্ত ধানক্ষেতে চুপটি মেরে থাকার পর আদেশ দিলাম ফায়ারিং এর । মিত্রবাহিনী শেল মারা শুরু করল । আর আমরা এল এম জি, এস এল আর ও রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলাম । প্রায় ৩ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলল । পাকিস্থানী বাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে সাজোঁয়া গাড়ি করে পালিয়ে গেল । ভোর ৪টায় পানিহাতা ক্যাম্পে রেড করলাম। বিজয় নিশান উড়ানো হল ময়মনশিংহ জেলার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাটি পানিহাতায়। শত্রুমুক্ত ঘাটিতে শুরু হল আনন্দ উল্লাস।
সকালে বাংকারের ভিতরে দেখলাম সম্পুর্ন নগ্ন মা -বোনদের । তাদের দেহে শক্তিবল কিছুই নেই , রক্তশুন্য ফ্যাকাঁসে ,একেকজন যেন জিন্দা লাশ । প্রশ্ন জাগে মনে “পাকিস্তানি সেনারা কি মুসলমান?", “তারা কি মানুষ নাকি নরপশু ?", “তারা কুকুরের চেয়েও কি নিকৃষ্ট জীব? ” । ১৭/১৮ জনকে জীবন্ত উদ্ধার করলাম । আমাদের সাথে যে গামছা ছিল তা' দিয়ে তাদের লজ্জা ঢাকার ব্যবস্থা হল । আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে বীরঙ্গনাদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌছানোর জন্য তাদের হেফাজতে দিয়ে ক্যাম্পে চলে আসলাম । সঙ্গে ছিল দুই সহযোদ্ধার লাশ ।
আমরা পৌঁছার আগেই হানাদার পাকিস্থানী বাহিনী ঘাটি ছেড়ে চলে গেছে। এই ঘাটিতেই শত শত স্বাধীনতাকামী লোকদেরকে এনে ক্রস ফায়ারে হত্যা করেছে। ভোর বেলায় আহম্মদনগর ক্যাম্প রেড করে শেরপুর সদরে আসার পথে আল বদর কমান্ডার কামারুজ্জামান (ভারতে থাকতেই শুনেছি , জামাতে ইসলামীর শেরপুরের নায়েবে আমির ফজলুর রহমান কামারুজামানকে দিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছেন এবং শেরপুর পাকস্থানী হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের নেতা সমর্থকদের হত্যার পরামর্শ দিয়ে লিখিত তালিকা পেশ করেছিলেন ) এর বাড়ী ঘেরাও করলাম কিন্তু তাকে পেলাম না। জানতে পারলাম আগের রাতে আহম্মদনগর ক্যাম্পের পাক বাহিনীদের সাথে জামালপুরে চলে গেছে।
কে তবে এই কামারুজ্জামান?
তার নাম মোঃ কামারুজ্জামান, পিতা-ইনসান আলী, গ্রাম-কুমরি মুদিপাড়া, পোঃ + ইউনিয়ন- বাজিতখিলা, থানা+ জেলা- শেরপুর। আল বদর বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব কমান্ড।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোটের পক্ষে জাতীয় সংসদের শেরপুর-১ (সদর উপজেলা) আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন জামাতে ইসলামীর এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। এই কামারুজ্জামানের অতীত নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা। জামাত নেতা কামারুজ্জামান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শেরপুরসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের হত্যা, নির্যাতন, তাদের সম্পদ লুণ্ঠনসহ ঘৃণ্যতম অপরাধ সংঘটিত করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের ওপর পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যায় প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন তিনি। শীর্ষ স্থানীয় শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষকসহ বরণ্যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য গঠিত ‘আলবদর বাহিনী’ সংগঠিত করাসহ কামারুজ্জামানের দুষ্কর্মের বর্ণনা ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের রিপোর্ট’-এ বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
কামারুজ্জামান ছিলেন ময়মনসিংহ অঞ্চলে বদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক। এই অঞ্চলে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা হত্যার অভিযোগ রয়েছে নরঘাতক কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে শিবিরের রগকাটা রাজনীতির সংস্কৃতিরও প্রবর্তক এই কুখ্যাত ঘাতক কামারুজ্জামান। আলবদর বাহিনীর কমান্ডার কামারুজ্জামানের দায়িত্বপ্রাপ্ত্ এলাকগুলো ছিল- ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ ও শেরপুর। মুক্তিযুদ্ধের সময় কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা মুক্তিবাহিনীর সদস্য ও সমর্থকদের প্রতিহত এবং বিভ্রান্ত করতে স্বাধীন বাংলা চেকপোস্ট নামে একটি চেকপোস্ট খুলেছিল। ওই চেকপোস্টে মূলত ভারতগামী সাধারণ মানুষকে নাজেহাল করা হতো। কোন কোন ক্ষেত্রে চেকপোস্ট থেকে অনেককে ধরে নিয়ে হত্যাও করা হয়েছে। ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের কমান্ডার সুলতান মাহমুদের মনোরঞ্জনের জন্য নিরীহ বাঙালী নারীদের সরবরাহও ছিল কামারুজ্জামানের অন্যতম দায়িত্ব। একাত্তর সালে ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা এবং বদর বাহিনীর অন্যতম সংগঠক মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এখন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল। অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বাঙালী নিধনযজ্ঞে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহে বদর বাহিনী গঠনে নেতৃত্বে দিয়েছেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও শেরপুর অঞ্চলে কামরুজ্জামানের হত্যা নির্যাতন অগ্নিসংযোগ লুটপাটের প্রত্যক্ষদর্শীরা স্মৃতির রোমন্থনে এখনও শিউরে ওঠেন। শেরপুরের সাধারণ মানুষ এখনও তাকে আলবদর কমান্ডার হিসেবেই জানে। তার নামের সঙ্গে বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষ 'কুখ্যাত', 'নরঘাতক' শব্দদ্বয় ব্যবহার করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
বদর বাহিনী এপ্রিল মাসের শেষ দিকে প্রথম গঠিত হয় জামালপুরে। জামায়াতে ইসলামীর নেতা এই মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ছিলেন বদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীতে এই সংগঠন সারাদেশে সম্প্রসারণ করা হয়। বদর বাহিনী সার্বিকভাবে জামায়াতের প্রাক্তন আমির গোলাম আযমের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো। এর প্রকাশ্যে নেতৃবৃন্দের মধ্যে সারা পাকিস্তান প্রধান ছিলেন জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী। পূর্ব পাকিস্তানপ্রধান ছিলেন জামায়াতের বর্তমান সেক্রেটারি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। প্রধান সংগঠক ছিলেন জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত বদর বাহিনীর প্রধান কাৰ্য ছিল সারাদেশে স্বাধীনতাকর্মীদের খুঁজে বের করা, হিন্দুদের বলপূর্বক মুসলমান বানানো, সেমিনার সিম্পোজিয়াম ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচার প্রপাগান্ডা এবং প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্রভাবে মোকাবেলা করা। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় বদর বাহিনীর নৃশংসতা মুক্তিযুদ্ধের শেষ পাঁচটি মাসে জনমনে ভয়াবহ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল।
মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা গণহত্যা করেছিল, যারা শান্তির ধর্ম ইসলামের নাম ব্যবহার করে প্রত্যক্ষভাবে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল, স্বাধীনতার ৩৬ বছর পরও তারা বীরদর্পে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এবং গণহত্যায় অংশ নিয়ে যে কুখ্যাত ব্যক্তিরা এক সময় ছিল ধিক্কৃত, নিন্দিত হয়েছে তাদের কেউ কেউ জোট আমলে লাখো শহীদের রক্তে ভেজা মতার লাল-সবুজের পতাকা নিজেদের গাড়িতে উড়েছে। এদেরই একজন নরঘাতক জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সম্পাদক এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক।
জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামও সে সময় বদর বাহিনীকে উত্তেজিত করে। ১৪ সেপ্টেম্বর '৭১ 'আলবদর' শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংগ্রাম লিখেছে, "আলবদর একটি নাম! একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আলবদর সেখানেই। যেখানেই দুষ্কৃতকারী, আলবদর সেখানেই। ভারতীয় চর কিংবা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।"
মুক্তিযুদ্ধকালে বদর বাহিনীর কমান্ডার কামারুজ্জামানের হত্যা-নিধনযজ্ঞ শেরপুরের একজন মুক্তিযোদ্ধা জানান, আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের সময় শেরপুরের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের নেতা বুলবুলকে হত্যা করে। এ সময় সে শেরপুরের শিক্ষক অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ নেয়ায় জুতার মালা পরিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। শেরপুরে অন্তত ৮০ জন প্রগতিশীল ব্যক্তি হত্যার নায়ক এই কামারুজ্জামান।
জামালপুরের এক মুক্তিযোদ্ধা জানান, জামালপুরের অন্তত ১০ মুক্তিযোদ্ধা কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় উপনেতা আবদুল হামিদ মোক্তার ও তিতপালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাট্যাভিনেতা হায়দার আলীকে হত্যার মধ্য দিয়ে কামারুজ্জামান ও তার সহরযোগীরা সাধারণ মানুষের মাঝে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। সেই থেকে সে জামালপুর কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, শেরপুরসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ ঘৃণ্য মানুষ হিসেবে পরিচিত।
জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র সংঘের যেসব নেতার চিন্তা থেকে ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনীর জন্ম হয়, কামারুজ্জামান তাদের অন্যতম। এক্ষেত্রে তার সহযোগী ছিল মোঃ আশরাফ, আবদুল মান্নান, আবদুল বারী প্রমুখ। এদের প্রধান কাজ ছিল ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের প্রধান সুলতান মাহমুদকে বাঙালী নিধনে সহযোগিতা করা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজ ছিল আলবদর বাহিনীর অন্যতম দফতর। জামালপুর মেডিক্যাল রোডেও ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও আলবদর বাহিনীর অন্যমত দফতর। ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের কমান্ডার সুলতান মাহমুদের মনোরঞ্জনের জন্য নিরীহ বাঙালী নারীদের সরবরাহও ছিল কামারুজ্জামানের অন্যতম দায়িত্ব। স্বাধীনতার পরপরই তার সহযোগী আবদুল বারীর একটি রোজনামচা মুক্তিযোদ্ধারা হাতে পায়। ওই রোজনামচায় হিন্দু মহিলাদের ধর্ষণ ও মুক্তিকামী মানুষ হত্যার বিশদ বিবরণ ছিল। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে ওই রোজনামচার আংশিক অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল।
কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে পরীক্ষামূলকভাবে গোটা ময়মনসিংহ জেলার ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের আলবদর বাহিনী হিসেবে সংগঠিত করে সশস্ত্র ট্রেনিং দেয়া হয়। কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে মাসখানেকের মধ্যেই ময়মনসিংহ জেলার সব ইসলামী ছাত্র সংঘ কর্মীকে আলবদর বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। (তথ্য সূত্র : একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র, ঢাকা ১৯৮৭)।
শেরপুরের একজন শহীদের পিতা ফজলুল হক গণতদন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন, তার ছেলে শহীদ বদিউজ্জামানকে মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ় মাসের একদিন তার বেয়াইয়ের বাড়ি থেকে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে ১১ জনের একটি দল ধরে নিয়ে যায়। বদিউজ্জামানকে ধরে আহমদনগর পাকিবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর শহীদের বড় ভাই হাসানুজ্জামান বাদী হয়ে নালিতাবাড়ী থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার ১৮ আসামির অন্যতম ছিলেন কামারুজ্জামান। মামলাটির নম্বর-২(৫)৭২। জিআর নং-২৫০(২)৭২। শেরপুর জেলার শহীদ গোলাম মোস্তফার চাচাত ভাই শাহাজান তালুকদার জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ২৪ আগস্ট আলবদররা গোলাম মোস্তফাকে শেরপুর শহরের একটি সড়ক থেকে ধরে জোরপূর্বক তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। শেরপুর শহরের সুরেন্দ্রমোহন সাহার বাড়িটি দখল করে আলবদররা তাদের ক্যাম্প বানিয়েছে। সে ক্যাম্পে গোলাম মোস্তফাকে ধরে নিয়ে আলবদররা তার গায়ের মাংস ও রগ কেটে হাত বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় শেরী ব্রিজের নিচে। সেখানে তারা গুলি করে হত্যা করে গোলাম মোস্তফাকে। কামারুজ্জামানের প্রত্যক্ষ নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।
শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জিয়াউল হক জানিয়েছেন. ১৯৭১ সালের ২২ আগস্ট বিকেল ৫টায় কামাড়িচরে তার নিজের বাড়ি থেকে গাজীর খামার যাওয়ার সময় ৩ আলবদর তাকে ধরে শেরপুর শহরে আলবদর টর্চার ক্যাম্পে নিয়ে গেলে সেখানে কামারুজ্জামানসহ তার সহযোগীদের দেখেন। তারা জিয়াউল হককে দু'দিন টর্চার ক্যাম্পে 'অন্ধকার কূপে' আটকে রাখে। এরপর শেরপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার শর্তে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। অন্যথায় তারা তাকে হত্যা করবে বলে হুমকি দেয়। শেরপুরের জাতীয় পার্টির নেতা মুক্তিযোদ্ধা এমদাদুল হক হীরা জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই কামারুজ্জামানের সহায়তায় পাকিস্তানীরা তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছিল। সেখানে তারা ৫টা বাঙ্কার করেছিল। তার বাড়ির লিচু গাছের নিচের মানুষ ধরে এনে হত্যা করেছে। অপর একজন প্রত্যক্ষদর্শী, শেরপুরের নকলার হাজি জালাল মামুদ কলেজের শিক্ষক মুসফিকুজ্জামান জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে তিনআনি বাজারে বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লুট করা হয়েছিল কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে।
শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী, রাজাকার ও আলবদর কর্তৃক নিরীহ লোকজনদের ধরে আনা এবং তাদের লাশ বহন করার জন্য ব্যবহৃত ট্রাকগুলোর একজন ড্রাইভার জানিয়েছেন, কামারুজ্জামান নকলার মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি পোড়ানোর জন্য পাকিস্তানী বাহিনীকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যায়। তখন সেখান থেকে কামারুজ্জামান প্রায় ১০০ মণ চালও লুট করেন । এছাড়াও কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদররা সাধারণ মানুষের গরু, ছাগল ধরে নিয়ে আসতো এবং পরিত্যক্ত সম্পত্তিসহ অন্যান্য জমি-সম্পত্তি জোর করে দখল করে নিতো বলে জানিয়েছেন এই ট্রাক ড্রাইভার। কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে সেই সময় ডাকাতির অভিযোগও পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শেরপুর জেলা শাখার সাবেক সভাপতি শহীদ পিতার সন্তান তাপস সাহা জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আলবদর ক্যাম্পে নারী-পুরুষ-যুবক ধরে নিয়ে তাদের ওপর অত্যাচার চালাতো। আলবদররা তাদের চাবুক দিয়ে পেটাতো। কামারুজ্জামানের বাহিনী শেরপুর পৌরসভার সাবেক কমিশনার মজিদকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল টর্চার ক্যাম্পে। সকালে ধরে নিয়ে পুরো দিন তাকে টর্চার ক্যাম্পের ‘অন্ধকার কুপে' এ আটকে রাখে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'পাকিস্তানের ২৫-তম আজাদী দিবস উপলক্ষে গত মনিবার মোমেনশাহী আলবদর বাহিনীর উদ্যোগে মিছিল ও সিষ্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এই সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন এই অঞ্চলের আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক কামারুজ্জামান। সিম্পোজিয়ামে বিভিন্ন বক্তা 'দেশকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দুশমনদের' সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন।
জামাত নেতা রাজাকার কামরুজ্জামান কর্তৃক একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শেরপুরের মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফাকে নৃশংসভাবে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনার ভিডিও সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদকে প্রদান করা হয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের ৫ তারিখে ঢাকায় সেনা সদর দফতরে সাক্ষাৎ করে জেনারেল মইনকে ভিডিওটি প্রদান করেছেন নিউইয়র্কের লেখিকা এবং বাংলা হলোকাস্ট এন্ড নাৎসী রিসার্চ সেন্টারের প্রধান ডাঃ মিনা ফারাহ। ১৪ জানুয়ারি বার্তা সংস্থা এনাকে ডাঃ মিনা ফারাহ আরো বলেন, ঐ ভিডিওটি আমি নিজে সংগ্রহ করেছি শেরপুরে গিয়ে। কেননা একাত্তর সালে শেরপুর শহরস্থ আমাদের বাড়িকেই আল বদর বাহিনীর ক্যাম্প করা হয়। সে ক্যাম্পের অধিনায়ক ছিলেন বদর বাহিনীর কমান্ডার বর্তমানে জামাত নেতা কামরুজ্জামান। কামারুজ্জামনের সহযোগী রাজাকার মোহন এখনও বেঁচে রয়েছে। মোহনের জবানবন্দিতে স্পষ্ট হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফাকে হত্যার ঘটনাবলী। মোহন বলেছে কামারুজ্জামানের পৈশাচিকতার অনেক অজানা তথ্য। এই ভিডিওটি জামাত নেতা কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের প্রধান সাক্ষী হতে পারে বলেই তা আমি সেনাপ্রধানের কাছে হস্তান্তর করেছি। একইসাথে তিনি ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের ভিডিও’র কপিও প্রদান করেছেন বলে ডাঃ মিনা ফারাহ জানান। উল্লেখ্য যে, ১২ জানুয়ারি ডাঃ মিনা ফারাহ'র মালিকানাধীন বাংলাদেশ প্নাজার কনফারেন্স রুমে প্রবাসের সাংবাদিক ও সুধিজনের উপস্থিতিতে রাজাকার মোহনের জবানবন্দি সংবলিত ভিডিওটি প্রদর্শন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিসত্মান সেনাবাহিনী রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করলে অন্যান্য সহযোগীর মতো কামারুজ্জামানও নিজ এলাকা থেকে পালিয়ে অন্যত্র আত্মগোপন করে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন তার খোঁজে বৃহত্তর ময়মনসিংহের সর্বত্র চষে বেড়াচ্ছিল তখন কামারুজ্জামান সিলেটের দরগামহল্লায় পালিয়ে ছিল। ১৯৭৭ সালে মায়ের অসুস্থতার অজুহাতে জামায়াতের সাবেক আমির নরঘাতক গোলাম আযম পাকিস্তানী পাসপোর্টে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফিরে এলে মতিউর রহমান নিজামী ও অন্যদের সঙ্গে কামারুজ্জামান প্রকাশ্যে বের হতে শুরু করে।১৯৭৭ সালে জামায়াতের বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আহজারুল ইসলাম, কাদের মোলা, মীর কাশেম আলী, আবু তাহেরের নেতৃত্বে ঢাকার ইডেন হোটেলে ইসলামী ছাত্র সংঘ নাম পরিবর্তন করে ছাত্রশিবির নামে আবির্ভূত হয়। ছাত্রশিবিরের প্রথম কমিটির সভাপতি ছিলেন মীর কাশেম আলী। আর সাধারণ সম্পাদক ছিল কামারুজ্জামান। পরে অবশ্য কামারুজ্জামান ছাত্রশিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে। সেই থেকে সে স্বাধীন বাংলাদেশে নিরাপদে বসবাস করছে। তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হচ্ছে না। সরকারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়ার পরও তারা নানারকম হুঙ্কার দিচ্ছে। তাদের এই ঔদ্ধত্যে দেশের সাধারণ মানুষ যারপরনাই হতাশ-ক্ষুব্ধ। নিজেরা আইন হাতে তুলে নিতে চায় না বলে জনগন এদের বিচারের প্রতিক্ষায় অধীর অপেক্ষায় প্রতীক্ষমাণ।