শৈশবে গ্রামীণ জীবনে ভাদ্র-আশ্বিন মাসের অন্য এক রূপ ছিলো যা হয়তো এখনকার দিনে গোচর হয় না। ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস মিলে শরৎকাল হলেও প্রকৃতি এখন আর আগের মত ধরা দেয়না। আমরা শৈশবে যৎকিঞ্চিত দেখেছি এখনকার ছেলে-মেয়েরা নেহাত বঞ্চিত বলেই মনে করি। আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা না হয় বাদই দিলাম, ওদের বইয়ের পাতায় সিমাবদ্ধ থাকতে হবে শরতের রূপ সম্পর্কে, যেখানে আমরা চোখে দেখা প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে বই পড়তাম। এক্ষেত্রে বলা যায় আমাদের প্রজন্ম কিছুটা হলেও ভাগ্যবান, কিছুটা হলেও শরতের রূপ আস্বাদন করতে পেরেছি আমরা।
লাফ-ঝাঁপ
ভাদ্র মাসে পাড়ার পুকুর গুলো থাকতো পানিতে টইটম্বুর, এমনই অবস্থা যে একটু বৃষ্টি হলেই দুই পুকুর এক হয়ে যেতো। আমরা পুকুর পাড় থেকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়তাম পানিতে। কখনো বা পুকুর পাড়ের হেলে পড়া গাছের মগ ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম, কসরত দেখিয়ে পানিতে জাম্প দেয়া, এভাবেই চলত আমাদের দুরন্ত দিনগুলো।
সকালের শিউলি
বাড়ি থেকে আমাদের পুকুর পাড়ে যেতে ছিলো একটি শিউলি গাছ, আমারই লাগানো। শরতের মিষ্টি সকালকে আরো সুন্দর করে তুলতো সাদা সাদা শিউলি ফুল। খুব ভোরে মায়ের সাথে ডালা ভোরে শিউলি কুড়ানো ছিলো আমার নিত্যদিনের অভ্যাস। শিশির ভেজা সকালে ঝরে থাকা ঝাফ্রান রঙয়ের বৃন্ত আর সাদা পাপড়ির শিউলি অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য তৈরি করতো।
তাল
আমাদের পাড়ায় প্রায় গোটা দশেক তাল গাছ ছিলো, তাল গাছ গুলোর একটা করে নামও ছিলো (নাম গুলো ভুলে গেছি) স্বাদের উপর ভিত্তি করে। যাইহোক, ভাদ্র মাস তাল পাকার সময় বাড়িতে বাড়িতে তালের সুগন্ধ আর পিঠা বানানোর ধুম চলতো। তাল গাছের মালিক থাকলেও তালের মালিক হবে যে কুড়িয়ে পাবে সেই এটাই ছিলো তখনকার রীতি। আর তাল গাছ গুলো কেন জানি পুকুর পাড় ঘেঁষেই থাকতো। সারাদিন ঢাপুস-ধুপুস করে পানিতে তাল পড়া আর আশপাশের মানুষের ছুটে যাওয়া। যে পানিতে নেমে আগে তালটি ধরতে পারবে সেই মালিক । সবাই সতর্ক থাকতো তাল পড়ার শব্দ নিয়ে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পানিতে নেমে তাল খোঁজা ছিলো অনেকের কাছে নেশার মতো। আমরা শিশুরা তালের আঁটি মাচা করে জমিয়ে রাখতাম শাস খাওয়ার জন্য। কে কতটা আঁটি জমাতে পারে এই প্রতিযোগিতা চলতো আমাদের মত বাচ্চাদের মাঝে। অবস্থা এমনই ছিলো যে, স্বপ্নেও মাঝে মাঝে তাল পড়ার আওয়াজ পেতাম।
শাপলা
শখের বসে বা রান্নার জন্য কখনো বা আমরা বাচ্চারা দল বেঁধে বিলে যেতাম শাপলা তুলতে। আমি অবাক হয়ে যেতাম শরতের শিশির শুভ্র শাপলা দেখে। ভাবতাম এইটা না ওইটা তুলবো, ওইটা দেখতে আরো ভালো।
শৈশবে আমার দেখা প্রকৃতির রূপের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। মাসটি এলেই এগুলো শুধু স্মৃতি হয়ে ধরা দেয়। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই তাল কুড়ানোর দিনগুলোতে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৯:৪৭