টোলভিশন আধুনিক সভ্যতার একটি বড় অবদান। আজকে এর ফলে বিশ্বব্যাপী জ্ঞানের বিকাশ হয়েছে, যোগাযোগ বৃদ্ধি হয়েছে। মানুষের পরস্পরের জানাজানির সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। এ সবই বিজ্ঞানের অবদান।
বিজ্ঞানের এ যুগে আমাদের অবশ্যই টেলিভিশনের পজেটিভ দিকটি দেখতে হবে। টেলিভিশন আবিষ্কারের পর থেকে ৬০/৭০ বছর পার হয়ে গেছে। ভালো-মন্দ সুবিধা-অসুবিধার দিকসহ এর সামগ্রিক প্রভাব আজ আমাদের কাছে স্পষ্ট। বর্তমানে আমরা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যে, টেলিভিশনের খারাপ দিকগুলো রিভিও করে দেখার পয়োজন। আমি ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় দেখেছি অনেক বাড়িতে টিভি রাখা হয় না। এ মানসিকতাসম্পন্ন লোক সেখানে আছে। তবে অন্যান্য দেশের কথা আমি ঠিক বলতে পারবো না।
বছর তিনেক আগে আমার এক ছাত্র আমাকে একটি বই দেয়। বইটির নাম ছিল ঋড়ঁৎ অৎমঁসবহঃং ভড়ৎ ঃযব ঊষরসরহধঃরড়হ ড়ভ ঞবষবারংরড়হ, লেখক ঔবৎৎু গবহফবৎ বইটি আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয়। সেখানে টেলিভিশনের ক্ষতিকর ছয়টি দিক তুলে ধরে বলা হয়েছে, এ ছয়টি কারণের জন্য টিভি বন্ধ করে দেয়া উচিত। এছাড়াও ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে টেলিভিশনের ক্ষতিকর দিকগুলো আমাদের সামনে বিভিন্ন সময় তুলে ধরা হয়। এসব কি প্রমাণ করে? এসব প্রমাণ করে যে টিভির ব্যবহার বা টিভির কল্যাণকামিতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে। তবে সে প্রশ্ন কতোটুকু সঠিক আর কতোটুকু সঠিক নয়, আমি সে সামগ্রিক আলোচনায় যাচ্ছি না। কিন্তু সে প্রশ্ন উঠেছে আর তা উঠেছে পাশ্চাত্য দেশগুলোতেই। এরকম বই আমাদের দেশেও লেখা হয়নি।
আমাদের দেশে সরকারি, বেসরকারি টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো উন্মুক্ত। এসব চ্যানেলগুলোর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম প্রধান দিকটি হল খবর। এরপরই দেখা যায় নাচ, গান আর সিনেমা। এ নাচ, গান, আর সিনেমাই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ৫০ থেকে ৬০ ভাগ সময় জুড়ে রয়েছে। সেখানে খেলাধুলার প্রোগ্রাম রয়েছে। তবে খেলাধুলার জন্য কয়েকটি চ্যানেলই আছে। ২৪ ঘন্টাই খেলাধুলা সংক্রান্ত অনুষ্ঠান সেখানে দেখানো হচ্ছে। আবার কার্টুন চ্যানেলও আছে। কিন্তু সমাজে এর প্রভাব কিভাবে পড়ছে? বাস্তবে এটিকে কিভাবে দেখা হচ্ছে আর বাস্তবে মানুষের সময় কিভাবে ব্যয় হচ্ছে? সার্বিকভাবে আমরা দেখতে পাই শিশু-কিশোর থেকে যুবক শেণী পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের ২৪ ঘন্টার মধ্যে অনেকেরই ৬/৭ ঘন্টাই টেলিভিশনের পিছনে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা স্পোর্টস এডিকশনের বা নেশার ফলে ৫/৬ ঘন্টাই খেলা দেখার জন্য ব্যয় করছে। এটি অনেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এতে তাদের অন্যান্য কাজের ব্যাঘাত হচ্ছে, লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। তেমনি বাচ্চারা কার্টুন নিয়ে প্রায়ই ব্যস্ত থাকে। রাতে বা সকালে লেখাপড়ার মূল সময়টাতেও অনেকেই কার্টুন দেখে কাটায়। আবার কার্টুনের সব যে ভালো তা-ও আমি বলবো না। সেখানেও মারামারি আছে,অস্ত্র চালানোর ব্যাপার আছে। সেসব দেখে বাচ্চাদের একটু বয়স হলে তাদের মনে প্রশ্ন জাগে আমার বন্ধুক কোথায়? একজন যদি তার দিনে ৪ বা ৫ ঘন্টা টেলিভিশনের পিছনে ব্যয় করে তাহলে অবস্থা কেমন দাঁড়ায়?
তুলনামূলকভাবে ভালো প্রোগ্রাম হলেও সেখানে ৪/৫ ঘন্টা ব্যয়ের প্রশ্ন চলে আসে। আমাকে বিভিন্ন ব্যক্তি টিভির সিরিয়াল প্রোগ্রামের কথা বলেছে। সেগুলো কতোটুকু ভালো, কতোটুকু কল্যাণকর আর জ্ঞানের, আমি সে বিষয়ের দিকে যাবো না। এ সিরিয়াল, মেগা সিরিয়াল প্রোগ্রামের একটি প্রভাব হলো এর ফলে মহিলারা এ প্রোগ্রাম দেখতে যেয়ে প্রতিবেশির সাথে দেখা - সাক্ষাতের সময় বের করতে পারে না। আগে মহিলারা যেভাবে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতেন, পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করতেন, পাশের বাড়ি যেতেন - সেটি কমে এসছে এবং তারা সম্পূর্ণরূপে ঘরমুখী হয়ে যাচ্ছেন। তাদের মাথায় থাকছে কোন সময় কোন প্রোগ্রাম শুরু হবে আর কোনটা দেখতে হবে। এর ফলে দেখা গেছে আমাদের সামাজিকতা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। এতে আমাদের পারস্পরিক সহানুভূতি, কল্যাণকামিতা, খোঁজ খবর নেয়া ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
এ স্পোর্টস, কার্টুন, নাচগান, সিনেমা কিংবা সিরিয়াল, মেগাসিরিয়াল প্রোগ্রামের মাধ্যমে মানুষের যে খুব একটি মানসিক উন্নয়ন হয় কিংবা অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় তা বলা যায় না। এর সার্বিক প্রভাব নৈতিকও নয়, কল্যাণকরও নয়। কিছু কিছু ভালো প্রোগ্রাম আছে। এ বিষয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু সার্বিক প্রভাব কল্যাণকার তা বলা মুশকিল।
টেলিভিশন প্রসঙ্গে আমি এখানে যে বিষয়টি জাতির সামনে তুলে ধরতে চাই তা হচ্ছে সময় অপচয় প্রসঙ্গ। টেলিভিশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে কতোটা আদর্শ, নৈতিকতা আছে আর কতোটা নেই এসব আলোচনা বর্তমান নিবন্ধের মুল বিষয় নয়। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে যে, এতে কতোটা সময় যাচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করেছি ছেলেমেয়ে, বাচ্চা, গৃহিণী আর ছাত্রদের কি পরিমাণ সময় টেলিভিশনের বিভিন্ন প্রোগ্রামের পিছনে যায়। আমরা এ-ও লক্ষ্য করলাম যে, এই সময় দিনে ১ ঘন্টা নয়, বরং ঘড়ে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭/৮ ঘণ্টাও যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি জাতির জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। একটি স্টাডিতে দেখা গেছে যে, একজন মানুষের ৫০/৬০ বছরের জীবনের ১২ বছর সময়ই ব্যয় হয়েছে শুধু টিভির পিছনে। একটি জীবনের যদি এ ১২ বছরই টিভির পেছনে যায় তাহলে তার অবস্থা আমরা কল্পনা করতে পারি! উৎ. ঐরংযধস ধষ-ঞধষরন তার ঞৎধরহরহম এঁরফব ভড়ৎ ওংষধসরপ ডড়ৎশবৎং বইতে এ হিসাবের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর সমাধান কি, আমার মনে হয় এর জন্য একটি আন্দোলন দরকার। এ আন্দোলন সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত, সামাজিক - সকল পর্যায় থেকেই করতে হবে। সে আন্দোলনের শ্লোগান হবে- আমরা টিভি কম দেখবো। এখানে আমরা টিভি দেখবো না বা টিভি ব্যান্ড করে দিতে হবে তা বলছি না। এখানে আমরা শুধু বলছি, টিভি দেখার সময় আমাদের কমাতে হবে। যে যার পছন্দ অনুযায়ী টিভি প্রোগ্রাম বেছে নিতে পারে কিন্তু এজন্য সারা দিনই তাকে টিভি দেখতে হবে এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। যে খবর দেখতে চায় দেখবে। কেউ তার নিজের সবচেয়ে বেশি পছন্দের অনষ্ঠান বেছে নিয়ে যদি শুধু সেটিই সীমিত সময় দেখে তাহলেও তার অনেক সময় বেঁেচ যায়। দিনে ১/২ বার খবর সহ সপ্তাহে কিছু ভালো অনুষ্ঠান কিংবা শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, কার্টুন ছবি ইত্যাদি দেখলো। তবে আমাদেরকে টিভি দেখার সময় অবশ্য অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে যদি আমরা জাতিকে গঠন করতে চাই। জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে সময়। সময় হচ্ছে জীবন। জীবনই হচ্ছে সময়। সময়ই যদি আমরা অপচয় করে দিই তাহলে কি করে আমাদের উন্নতি সম্ভব হবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কোনো উন্নয়নই সময়ের সদ্ব্যবহার ছাড়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের নতুন শ্লোগান হওয়া উচিত- আমরা টেলিভিশন কম দেখবো এবং আমরা সময়কে কাজে লাগাবো। এর ফলে যে বিশাল সময় বেঁচে যাবে তা আমরা ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারি। যেমন আমরা আমাদের ছাত্র জীবনের সময়গুলোতে বিভিন্ন লিটারেচার পড়তাম। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র সহ বিভিন্ন রকম সাহিত্য পড়তাম। আজকের দিনে সেগুলো পড়ার সংখ্যা খুবই কমে গেছে। এটি যে কত বড় ক্ষতি তা আমরা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবো।
সাহিত্য না পড়ার জন্যও অনেক ক্ষেত্রে সময়কে দায়ি করা হয়। সাহিত্য হচ্ছে মানুষের জীবনের দর্পণ - এটি একটি দিক। অন্যদিক হচ্ছে সাহিত্য মানুষকে মহৎ করে। যারা ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিক পড়বে, টলস্টয়, ম্যাক্সিম গোর্কি, পার্ল বাক আর রবীন্দ্রনাথের হোক বা আল্লামা ইকবালের হোক, নজরুলের হোক- তারাই জীবনে মহৎ হবে। এদের দ্বারা মানবতা কল্যাণ পাবে। অথচ আজকে সেরকম লোক তৈরি হওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হলো বেশির ভাগ লোক আজকে সাহিত্য পড়ছে না। যখন একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে সেখানে সে প্রফেশনাল শিক্ষাই পাচ্ছে। সেখানেও সাহিত্যের গুরুত্ব কম। বাংলা পড়লে আমরা নাক সিটকাচ্ছি কোনো কোনো ইউনিভার্সিটি বলছে এগুলো পড়ার দরকার কি, আমাদের সে শিক্ষা দরকার যা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য কাজে লাগবে, যা আমাদের কমিউনিকেশনের কাজে লাগবে, যা আমাদের কনস্ট্রাকশনের কাজে লাগবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর দ্বারা মানুষ রোবট তৈরি হবে- মানুষ তৈরি হবে না। আমরা এ জিনিসটি ভুলে যাচ্ছি।
এ পরিস্থিতিতে আমার মনে হচ্ছে, আমাদের একটি আত্মনিয়ন্ত্রণ দরকার। আমাদের সময় বাঁচাতে হবে। আমরা সময় বাঁচাবো, সময়কে মানবতার কাজে লাগাবো, মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করবো। জাতির কল্যাণে, জাতি গঠনে ব্যবহার করবো। এ সময়কে আমরা ফ্যামিলির ডেভেলপমেন্টের কাজে ব্যবহার করবো, নিজের আতœগঠনে ব্যবহার করবো, আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীর জন্য ব্যবহার করবো।
নিজেরা নিজেদের সময়কে বাঁচাবো। আমরা কতক্ষণ টিভি দেখবো তা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কিন্তু সরকার চাইলে খারাপ চ্যানেলগুলো যতদিন পর্যন্ত সম্ভব ততদিন তারা সেসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এ উদ্যোগ অবশ্যই সরকারকে নেয়া উচিত। বছর খানেক আগে সরকার কিছু চ্যানেল বন্ধ করে ভালোই করেছিল যদিও তা পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেনি। সরকারকে অবশ্যই এসব খারাপ চ্যানেলগুলোর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হবে।
সবশেষে যেটা জাতির কাছে বলতে চাই, সকলেই এ বিষয়টি ভেবে দেখবেন এবং প্রত্যেই তার নিজের ফ্যামিলিতে টিভি ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করবেন। এ ব্যাপারে ফ্যামিলিতে মায়েদের বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। তারা নিজেরাই যদি বেশি করে টিভি দেখেন তাহলে বাচ্চাদের আটকানো সম্ভব হবে না। আমি মনে করি, এ বিষয়টি সকলেই বিশেষভাবে বিবেচনা করে দেখবেন। পত্রিকাগুলো এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারে। এটি একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হতে পারে। এতে আমাদেরই কল্যাণ হবে। আমার মতে, ‘আমরা টিভি কম দেখবো ঃ সময়কে কাজে লাগাবো’- এ শ্লোগান জাতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
লেখক
সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার