প্রচন্ড বৃষ্টি পরছে। যাকে বলে ক্যাটস & ডগস। ক্যাটস & গডস বাংলাতে এই বৃষ্টির প্রচণ্ডতা বুঝাতে যথেষ্ট নয়। সুভহা'কে নিয়ে আমি বসে আছি ভিস্তা নামের গাড়ির ভেতর। আমাদের গাড়ি এই মূহুর্তে পার্ক করা শাল বনের পাশে। খুব কাছেই মাটির তৈরি ঘরে টি-ষ্টল। টি-ষ্টলের আলো অবশ্য এই বৃষ্টিতে এখন দেখা যাচ্ছে না। আমি প্রচন্ড ভয় পাচ্ছি উলটো দিক থেকে আসা কোন ট্রাক হয়ত আমাদের দেখতে পারবে না। মেরে দেবে উইন্ডশিল্ড বরাবর। আমার জীবন গেলে যাক, অপঘাতে যেন সুভহা'র প্রাণ না যায়!
ধীরে ধীরে হাত রাখলাম সুভহার হাতে। ক্রমে তারে উত্তেজিত করাই আমার লক্ষ্য। অবলা নারীরে জোড় জবরদস্তি করা আমার ধাতুতে নেই! দুর্বলের ওপর কিসের জুলুম? পুরুষ হয়ে থাকলে আস সেয়ানে সেয়ানে। বাঘে মহিষে একঘাটে জল খেতে পারে কিন্তু বাঘ সিংহ নয়। আমি নিজেরে একজন বাঘ মনে করি, নখ দন্তবিহীন এক বাঘ। নখ আর খতরনাক দন্ত হারালেও আমার বুকের ভেতর হাজার ঘোড়ার দামামা বাজে অবিরাম।
অনেকটা কাবু হয়ে গিয়েছে সুভহা। তার নাকের ডগাতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। ঠোঁটের ওপর মোচের রেখায় তার রগ রগে ঢেউ........আমি ওয়াইপার চালিয়ে দিই, ফোল্ডিং গিয়ার অন করে সিট ফেলে দিই পেছনের সিট বরাবর। হাঁটু মুচড়ে চলে আসি সুভহা'র সিটে। এই মূহুর্তে আমার জীবনের আরাধ্য শত্রুরে প্রণাম করতে চলেছি তাহার রক্তিম দেবালয়ে!
সুদর্শন পুরুষ নই আমি কোন কালেই তবে সুপুরুষ বৈকি। এই জীবনে কত নারীর কাংখিত শয্যা সংগী হয়েছি তার হিসেব আমিও জানিনা। অথচ সুভহা...... এই সুভহা আজীবন চরম অবহেলা দিয়েছে আমারে। সুভহা'ই একমাত্র নারী যারে আমি আহ্বান জানিয়েছিলাম ভালবাসতে, বলেছিলাম তুমি চাইলে কাজী অফিস থেকেই শুরু হবে আমাদের জীবন। আমার আহ্বান এক কানে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছে সুভহা।
যখন প্রথম চাকুরীতে ঢুকলাম সে বছর সুভহা'র কলেজের সামনে অনশনে বসেছিলাম আমি, শুধু সুভহা'রে পাওয়ার জন্য। সুভহা তখন আমার অনশন ভাঙ্গাতে না এসে পুলিশ নিয়ে হাজির হয়েছিল আমারে উচ্ছেদ করতে। ভালবাসার ডাকে সারা দিতে না পারলেও উচ্ছেদ করতে নেই, ভালবাসার ডাকে লাঠিপেটা করতে নেই।
সুভহা সেই কাজটাই করেছিল। সেই দিনই আমি সিদ্ধান্ত পাকা করেছিলাম।
------
সুভহা' ব্যসিকালি কিন্নরী। কিন্তু এই মূহুর্তে তার ভাঙ্গা গলার বেইজি টোন বলে দিচ্ছে কতটা তৃপ্ত হয়েছে। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও সে নারাজ। ঘর্মাক্ত দুহাত দিয়ে আমার পিঠ ক্রস করে দেয় সুভহা। ভালবাসার শেষে ভালোবাসার রেশ টুকুও হাতছাড়া করতে নারাজ সে। আহারে সুভহা যদি কলেজের সেই দিনও বুঝতি সত্যিই কতটা ভালবাসতাম।
গাড়িটা আমার খুব প্রিয়। অনেক দেখে শুনে এই গাড়িটা নিয়েছিলাম। ক্লোজ করার জন্য এতকমে ভিস্তার চেয়ে উপযুক্ত আর গাড়ি হয়না। ১৮০০ সিসি হলেও স্পেস অনেক ছোটখাটো SUV এর চেয়ে বেশি। স্পেসের চেয়েও এই গাড়ির শক এব্জর্ভিং সিষ্টেমটা আমারে বেশি টানে। ভেতরে হুটোপুটি যায় করুন ডগি, ডুব সাতার, ব্যাক ষ্ট্রোক বা এক্রোবেটিক; বাইড়ে খুবেকটা বাউন্স বুঝা যাবে না, ভিন গ্রহের কেউ বলবে না ডান্সিং কার।
কুমিরের চামড়া বার্নিশ করে লাগিয়েছি গাড়ির সিট কাভার। সেই প্রিয় সিট কাভার নোংরা করে ফেলেছে সুভহা। শীর্ষ অনুভূতির শেষে মাথা হালকা হয়ে গিয়েছিল তার, বুঝে উঠতে পারেনি এমন সময় এভাবে উঠে বসতে হয় না। দুজনের যৌথ চাষাবাদে যতটুকু জল, বীজ সার জমা হয়েছিল পুরোটাই এসে পড়েছে সিটে। সুভহা তো সেই নারী যে আমারে পুলিশ দিয়ে লাঠি পেটা করিয়েছিল। ভালবাসার প্রতিউত্তরে প্রেমের কীর্তি নাশা হয়েছিল। আর এই গাড়িটা আমাকে দিয়েছে শুধু ভালোবাসা। যখনি মন খারাপ হয়েছে গাড়ি নিয়ে একাকী বেড়িয়ে পরেছি আমি। ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ে থেকে কক্সবাজারের সুবিশাল মেরিন ড্রাইভ। কখনো চলে গিয়েছি পাটুরিয়া ঘাট। মাত্র ধরা তাজা মাছের মচমচে ভাজা খেয়ে মন ভালো করেছি। ঢাকা সিলেট হাইওয়ে ধরে পৌঁছে গেসি টিলা'র ওপর সাজানো চা বাগানে।
কদিন অবশ্য ফেরি পেরিয়ে দৌলতদিয়া পর্যন্ত গিয়েছি। নিষিদ্ধ পল্লীর কানা গলির মুখে গাড়ি রেখেছি ভেতরে যাব বলে। কিন্তু না যেতে পারিনি। না আমি কোন আদর্শ পুত পবিত্র পুরুষ বলে যায় নি তা নয়। বরং এই ভিস্তাকে সাক্ষী রেখে আমি অনাচার করতে পারিনি।
সেই গাড়ির সীটে সুভহা মাখিয়ে দিয়েছে সব কলঙ্ক। মিজাজ ঠিক রাখা দায় তো অবশ্যই। শুয়োরের বাচ্চা বলে চিৎকার করে উঠলাম, আরে চুতিয়া টিস্যু বক্স দেখিস না..গুঁজে নিবি না তুই...ভেতর…আমি আচনক উত্তেজিত হয়ে যায়। আসলে আচানক বলা ঠিক হচ্ছে না। সুভহা'র প্রতি আমার জমে আছে অনেক যুগের ঘৃণা। সুভহা'র সাথে মোটেই ভালবেসে মিলিত হইনি আমি, বরং মিলিত হয়েছি শরীর মগজে দীর্ঘ যুগ ধরে উৎপন্ন হওয়া বিষ নামিয়ে দিতে।
ট্রাউজারের বেল্টটা লাগিয়ে নিয়ে সুভহাকে বললাম গাড়ি থেকে বের যেতে। আমার কথা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে। রাজ্য'র বিস্ময়, আর ঘৃণা জমা হওয়া চোখ হতে অবিশ্বাসের বিস্ফোরণ ঘটছে ওর। ওর চোখের জলের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৃষ্টির প্রকোপ। স্কার্ট টা কোন ভাবে কোমরে জড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে যায় সুভহা। আমি হর্ণ দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করি ওর কিন্তু পিছু ফিরে তাকায় না সে।
আসে পাশে যাবার মত কোন স্থান এখন নেই, যাবার উপায় তো নেই-ই। আমি জানি ঐ টি ষ্টল টাই একমাত্র ভরসা। আমার অবশ্য পুরো ভরসা আছে আমার গাড়ি থেকে নেমে সে যখন টি-ষ্টলে পৌঁছুবে তখন তারে নূন্যতম অসম্মান করার হিম্মত কারো হয়নি। যত নিচু মানুষ হই না কেন কেউ তারে নূন্যতম ভ্রূ-কুঙ্চিত করবে নগদে নিজ হাতে তার দু চোখ তুলে নেবার ক্ষমতা আমার আছে। সুভহা'র যে পরিণতি আমি করেছি সেতো তার প্রাপ্য। ২১ বছর বয়সী এক উচ্ছল শান্ত প্রেমিক কে অবহেলা ভরে লাঠিপেটা করার ফলাফল তো তাকে পেতেই হবে। এই দুনিয়াতে তারে আমি পরিপূর্ণ শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দিলে ওপারে নিশ্চিত জান্নাতের পথে বাধা থাকবে না তার!
একজন পুরুষ নাকি ৭০ জন নারী বা হুর পাবে ওপারে! তবে গাণিতিক হিসাবে কি নারীর সংখ্যা ৭০ গুন বেশি হবে পৃথিবীর শেষ দিন? আমার পজরের হাড় দিয়ে আমার হুর দের বানাতে হলে তো আমার কংকালের অর্ধেক নেই হয়ে যাবে! তখন কি হবে আমার? সুভহা যদি আমার পাজরের হাড় সমেত বেহেস্তে প্রবেশ করে তো কিভাবে আমি জাহান্নামে থাকি?
পরস্ত্রী সুভহা ঢুকে গিয়েছে টি ষ্টলে। ভেতরে কেউ নেই। থাকার কথাও না। তিন চার দিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি থেমে রোদ না উঠা পর্যন্ত ভেজা চুলাতে আগুন ধরানো যাচ্ছে না। অতএব দোকানে বসার কোন কারণ ঘটেনি। চুলার আশেপাশে জমে আছে কিছু কাঠ কয়লা। কাঠ কয়লা আমার ভীষণ প্রিয়...প্রায় রাতে উঠে একুরিয়াম থেকে মাছ তুলে এই কাঠ কয়লা দিয়েই বারবিকিউ করি আমি।
আমার গাড়ির পেছন দিক সরাসরি লাগিয়ে দিলাম ছোট্ট টি-ষ্টলের দুয়ারে। ব্যাকডালি খুলে কাঠ কয়লা বুঝায় করলাম কিছু। সুভহা কোন কথা বলল না, মাঝেমাঝে ডুকড়ে ডুকড়ে কেঁদে উঠলো শুধু। টিষ্টলের দুয়ার বন্ধ করে দিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম আমি। বসার আগে সাইলেন্সারের মুখে ছোট্ট একটা পাইপ লাগিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম টি-ষ্টলের ভেতরে। আমার গাড়ি ষ্টার্ট নিয়ে নিয়েছে। ফলস পিকাপ তুলছি আমি, সাইলেন্সার থেকে ঝড়ের মত আওয়াজ বের হচ্ছে। টহল পুলিশের গাড়ি পার হল মাত্র। পুলিশের গাড়ি দেখে আওয়াজ বাড়িয়ে দিলাম আমি। এই দেশের পুলিশ ফাকা রাস্তায় নষ্ট হওয়া গাড়ি নিয়ে খুবেকটা ভাবে না। তাদের কেরামতি সব ভিভিআইপি যাত্রাপথে থাকলে।
কেউ একজন টি-ষ্টলের দড়জাতে প্রচন্ড শক্তিতে ধাক্কা দিচ্ছে। আমি জানি সুভহা ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। সুভহা'র ধাক্কার সাথে পাল্লা দিয়ে আমিও সাইলেন্সারের গ্যাস ছাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছি। কিছুক্ষনের ভেতর দুপ করে একটা শব্দ'র মত হয়, থেমে যায় সব ধাক্কাধাক্কি, ডাকাডাকি'র শব্দ। গাড়ি টান দিয়ে পুলিশ ষ্টেশনে চলে গেলাম আমি। মিসিং রিপোর্ট লিখাতে হবে এখন। পরদিন সুভহা'র লাশ উদ্ধার হল, বিষাক্ত গ্যাসে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে অপঘাতে মৃত্যু, স্থান শাল বাগান সংলগ্ন টি-ষ্টল।
এবার আমি ফোন থেকে মুছে ফেললাম সুভহা'র ছবি ফোন নাম্বার সব কিছু। যে চলে গেছে তারে সেল ফোনের মেমোরিতে রাখার মত দুঃখ বিলাশী আমি না। দু মিনিট ভেবে আমার ঠোঁটে ভেসে উঠলো বাঁকা হাসি। টি-ষ্টলের মামা নির্ঘাত এখন জেলে অন্তত রিমান্ডে তো অবশ্যই। মামা'র ফোন নিশ্চিত এখন তার মেয়ের হাতে। মেয়েটা বেশ ডাগর ডাগর দেখতে। আমারে ভাইয়া বলে ডাকলেও তুমি সম্বোধন করে…
আমি কাঠ কয়লায় পুড়িয়ে নয়া ঘ্রাণ স্বাদের বারবিকিউ বানাতে আগুন প্রস্তুত করলাম।।
---------
#বনল
এপ্রিল ৭, ২০২০
উত্তরা
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৮