স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দালনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদী ছাত্রদলের গ্রহন করা প্রথম চ্যালেঞ্জ। চরম বৈরী পরিবেশে বেড়ে ওঠা শেখার শুরু মূলত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদত বরণের পরে।
দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়া তখন সদ্য প্রয়াত , বর্তমান নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তখন রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় হন নি , সাধারন গৃহবধূ মাত্র। আজকের ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান তখন একজন পিতৃহারা নাবালক।
১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ও তার ঠিক সাত দিনের মাথাতে ২৩ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতি বার , মূলত ছাত্রদলের এ্যসিড টেস্টের শুরু। এদিন থেকেই বিরধী বেঞ্চে অবস্থান করে কিভাবে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে হয়, শিখতে শুরু করে ছাত্রদল।
১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছিল শিক্ষা দিবস, ছাত্রদলের প্রথম মিছিলের জন্য এরচেয়ে জুতসই সময় আর কি হতে পারতো ?
কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শিক্ষা দিবসে মিছিল হবে, এই সময় ফিলিস্তিনে ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছিল বাংলাদেশ সহ অন্যান্য বেশ কিছু দেশে। এদেশে অবস্থিত ফিলিস্থিনী ছাত্রদের সাথে আলাপ আলোচনা করে তাদের সাথে নিয়ে মিছিল করার সিধান্ত গ্রহণ করে ছাত্রদলের তৎকালীন নেতৃত্ব। রমজান মাসের শেষ জুম্মার পরে বাইতুল মোকাররম মসজিদ থেকে মিছিল নিয়ে মার্কিন দুতাবাস পর্যন্ত রুট তৈরী হয়। এরশাদের অধীনস্থ সামরিক শাষনের ভেতর এটাই ছিল কোন ছাত্র সংগঠনের প্রথম মিছিল। জনগণ এবং প্রশাসন উভয়েই হতবাক হয়ে যায় এই মিছিল দেখে। যদিও শান্তিপূর্ন মিছিল করার প্রস্তুতি ছিল তারপরেও পুলিশ আকস্মিক হামলা চালালে ছাত্ররা এরশাদ বিরধী শ্লোগান দিতে দিতে ছত্রভঙ্গ হয়। তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তে, এবং হাই কমান্ডের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করে ছত্রভঙ্গের মূহুর্তে সরকার বিরধী স্লোগান দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোন ছোটখাট সাহসের কাজ নয়। এরজন্য বুকের চওড়া পাটা থাকতে হয়, মগজে উর্বর মস্তিস্ক থাকতে হয়।
তখন ছাত্ররা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রতি বছর শিক্ষা দিবসে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পন করা হবে এবং মধ্যবর্তি কর্মসূচী হিসাবে ছাত্ররা ক্যাম্পাসে মৌন মিছিল করার সিদ্ধান্ত আসে, প্রশাসন মৌন মিছিল বন্ধে চাপ প্রয়োগ করলেও ছাত্ররা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে, এই মৌন মিছিলে পুলিশ লাঠি চার্জ করতে গেলে ছাত্ররা জগ্ননাথ হলের শহীদ মিনারে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং পুলিশ সেখানে লাঠি চার্জ করে একজনকে গ্রেফতার করে। এই মৌন মিছিল সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠে যখন ছাত্রদলের ছেলেরা ঐ মিছিলের ব্যানারে “এরশাদের পতন চাই” স্লোগান জুড়ে দেয়।
এর সাত দিন পরে ২৩ সেপ্টেম্বর ডঃ মাজেদ খান শিক্ষা কমিশন, মার্শাল ল স্টাডি কমিশনের সুপারিশের আলোকে নতুন শিক্ষা নীতি ঘোষনা করে যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর থেকেই ইংরেজি ও আরবি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এই সিদ্ধান্তর বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে ছাত্রদল ও দেশের অন্যান্য ছাত্র সংগঠন। মূলদলের সুপারিশে ছাত্রদল শিক্ষনীতি বিরোধী আন্দোলনে ভিত্তি ধরে সার্বিক আন্দালন ও সংগঠন দৃঢ় করার কৌশল গ্রহণ করে। দেশের তৎকালীন বুদ্ধিজীবীরা ছাত্রদের সাথে একমত পোষণ করলে আরো সুদৃঢ় হয়ে ওঠে, স্বৈরাচার বি্রোধী ছাত্র আন্দালনের অগ্নিকুণ্ড সম ক্ষেত্র।
১৯৮২, ৭ নভেম্বর
এই দিন আরো একটি সভা পুলিশ পণ্ড করে দিতে লাঠিপেটা করে, ঐ দিন বেগম খালেদা জিয়া উক্ত সভাতে উপস্থিত হয়ে স্বয়ং ছাত্রদের শপথ বাক্য পাঠ করান। লাঠিপেটা ও সভাপণ্ডের প্রতিবাদে পরদিন ৮ নভেম্বর ক্যাম্পাসে দুটি মিছিল প্রদক্ষিণ করে , একটিতে ছাত্রদল নেতৃত্ব দিলে অন্যটিকে জাসদ ছাত্রলীগ নেতৃত্বে ছিল। স্বৈরাচার এরশাদের পুলিশ এই মিছিলেও আক্রমণ করে বসে, ফলে দুটি দলের অভ্যন্তরীণ দুটি রাজনৈতিক মিছিল হলেও ব্যাপক ছাত্রসমর্থন ছাত্র নেতৃত্বের পক্ষে চলে আসে এবং শুরু হয়ে যায় খন্ড খন্ড বিক্ষিপ্ত লড়াই। এই পরিস্থিতিতে চলমান থাকলে ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া হয় ১৪ তারিখ পর্যন্ত, ১৪ তারিখ ভার্সিটি খুললেও ছাত্ররা ক্লাস বর্জন অব্যাহত রাখে। এই প্রেক্ষিতে ১৪ ছাত্র সংগঠন অপরাজেয় বাংলার পদ দেশে এবং ছাত্রদল মধুর ক্যান্টিনে ছাত্র সমাবেশ করে। দুটি সমাবেশ থেকে যুগপত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২৯ নভেম্বর ১৯৮২" দাবী দিবস" পালন হবে বলে ঘোষনা দেওয়া হয়। এই দাবী দিবসের ঘোষণাটি ছিল ধীরে ধীরে ছাত্র আন্দালনকে এগিয়ে নিয়ে স্বৈরাচারকে ব্যাতিব্যাস্ত রাখার রাজনৈতিক কৌশল।
উক্ত ১৪ সংগঠন ২১ নভেম্বর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ঘোষনা দেয়, ছাত্রদল এই পরিষদে যোগদানে বিরত থাকে আরো বৃহত্তর ঐক্য গঠনের লক্ষে, তবে ১৪ দলের পরিষদকে সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা করার নীতিগত সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়।
২৯ নভেন্বর দাবী দিবসে ১৪ দল ও ছাত্র দল শিক্ষা বিষয়ক দাবি দাওয়ার সাথে সামরিক শাসন তুলে নেবার দাবীও উত্থাপন করে এবং ১৩ ডিসেম্বর ১৯৮২ শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে সার্বিক ধর্মঘট ডাক দেয়।
ধর্মঘটের আগের দুই দিন ১১ ও ১২ ডিসেম্বর ছাত্রদলের দুদিন ব্যাপী বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং শিক্ষা নীতি বিষয়ক আন্দালনকে সামরিক শাষন বিরোধী আন্দালনে পরিনত করার মাস্টার প্লান তৈরী করা হয়। এই সভাতে ছাত্রদল প্রথম, খালেদা জিয়া কে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিএনপি’র মূল নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান করে এবং এই সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে দলের কাছে উত্থাপন করে।
এই ঘটনার চারদিন পরে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ছাত্র দল ১১ দফার দাবি পেশ করে।
এই দিন ১৪ দলীয় ছাত্র পরিষদ ও ছাত্রদল ১১ জানুয়ারী ১৯৮৩ সালে সচিবালয় ঘেড়াও করার সিধান্ত নিলেও পরে তা ১৪ ফেব্রুয়ারি নির্ধারন করা হয়।
১৪ ফেব্রুয়ারীর আগের এই সময়ে ঘটে ন্যাক্কার জনক আরো একটি ঘটনা। আমলা, শীর্ষ জেনারেল ও খোদ প্রেসিডেন্ট ছাত্র নেতৃত্বকে বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে বস করার চেষ্টা করে, এবং অনেকাংশে সাফল্য পায়। সেই সময়ের ডাকসু জিএস, বর্তমান জাতিয় পার্টির নেতা ও মন্ত্রী, জিয়াউদ্দিন বাবলুকে অর্থের বিনিময়ে কিনে ফেলে এরশাদ সরকার, পুরস্কার স্বরুপ জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মন্ত্রী বানানো হয়।
চরম এই বিভক্তির মাঝেও সাধারন ছাত্ররা আন্দালন চালিয়ে যায় এবং সচিবালয় ঘেরাও করে।
এর আগে ১২ ফেব্রুয়ারী ছাত্রদল ও ১৪ দল ২১শে ফেব্রুয়ারী পালন উপলক্ষে ঢাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রস্তুতি মূলক মিছিল করে।
১৪ ফেব্রুয়ারী সকাল ১০ টার মধ্যে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বটতলাতে সমবেত হয় এবং পুলিশ ভার্সিটির চারদিকের সকল রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেয়। হাইকোর্টেরে সামনে বিডিআর আর শিক্ষা ভবনের সামনে দাঙ্গা পুলিশ সতর্ক অবস্থান নেয়।
বটতলাতে অবস্থান নেওয়া ছাত্রছাত্রীরা ১২.৩০ নাগাদ শিক্ষা ভবনের উদ্দেশ্যে উদ্ধত মিছিল নিয়ে যাত্রা করলে দোয়েল চত্তরে পুলিশের সাথে তীব্র লড়াই শুরু হয়ে যায়, পুলিশের টিয়ার সেল, গরম পানির প্রতিরোধে ছাত্ররাও ইটপাটকেল, লাঠি নিয়ে পুলিশের উপর চরাও হলে বিপুল সংখ্যক যুদ্ধাংদেহি পুলিশ পিছু হটে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বেগতিক অবস্থা দেখে পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
পুলিশের গুলিতে জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, আয়ুব, ফারুক ও দীপালী সাহা শাহাদত বরন করে, দীপালী শাহা ছিল ছোট্ট বালিকা। হাজার হাজার ছাত্র আহত হয়, বেপরোয়া পুলিশ হলে হলে তল্লাশি চলিয়ে সেখান থেকে নিহত লাশগুলি তুলে নিয়ে চলে যায়। গ্রেফতার কৃত ছাত্রদের শাহবাগ আঞ্চলিক সামরিক অফিসে নিয়ে যেয়ে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়।
এই খবর পাওয়ার সাথে সাথে প্রথম, বেগম খালেদা জিয়া ভার্সিটির উদ্দেশে বাসভবন ত্যাগ করেন। পথে ঢাকা ক্যান্টোনমেন্টের থার্ড গেটে তার গাড়ি আটকে দেওয়া হয়, তিনি চালাকি করে এরপর বনানী গেট দিয়ে বাহির হয়ে আসেন, পথে শাহবাগে এরশাদের সিপাহীরা খালেদা জিয়ার গাড়ির গতিরোধ করে...এরপর কৌশলে বেগম জিয়া সরাসরি ঢাকা মেডিকেল কলেজে শহীদ দের লাশের সামনে হাজির হলে সেখানে এক হৃদয় বিদায়ক পরিস্থিতি তৈরী হয়। বেগম জিয়া পৌঁছানোর দুই ঘন্টার কিছু সময় পরে সেখানে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ও অন্যান্যরা উপস্থিত হন।
১৪ তারিখের হত্যাযজ্ঞের প্রেক্ষিতে ১৫ ফেব্রুয়ারী দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গর্জে ওঠে। মুর্হু মুর্হু মিছিলে প্রকম্পিত হতে থাকে ঢাকার পথঘাট । পুলিশের তান্ডবে এদিন আবারো গুলি চালানো হয় প্রতিবাদী ছাত্রদের বুকে। ১৫ তারিখে ১৫ জন ছাত্রের তাজা রক্তে ভেসে যায় রাজপথের পীচঢালা পথ। চট্টগ্রামে পুলিশ হত্যা করে ১০ জন ছাত্রকে এবং যথারীতি লাশ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে দীর্ঘদিন সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত কারফিউ জারি হয়।
এহেন পরিস্থিতির মাঝেই ছাত্রদল ও বেগম জিয়া ২১ শে ফেব্রুয়ারী শহীদ মিনারে যাবার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ব্যাপক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি বলাকা সিনেমা হলের সামনে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পন করেন। বিকেলে জাসাস আয়োজিত সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রমনার বটমূলে অনুষ্ঠানে হাজির হন বেগম জিয়া।
২১ ফেব্রুয়ারীর আগের সময়ে কর্নেল অলি , ছাত্র নেতা ও হাজার হাজার নেতা কর্মি গ্রেফতার হয়ে গেলেও বেগম খালেদা জিয়া , নিজে, নিজ দায়িত্বে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে আন্দালনের গতি ক্রমবৃদ্ধি করেন এবং ছাত্রদলকে দেশের আন প্যারালাল সংগঠনে পরিনত করেন।
প্রসঙ্গতঃ ছাত্র আন্দোলন শুরু হবার আগে ৩০০০ বিএনপি নেতা কর্মী যাদের ৭০% ছাত্রদল কর্মী তাদের সামরিক আইনে সামরিক আদালতে বিচার করে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়।
বাকি ইতিহাস আগামী পর্বে