ইশারায় মানবেতর জীবন-সংগ্রামের কথা তুলে ধরে নিজেরা কাঁদলেন ও কাঁদালেন। শুক্রবার (১৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জের শিল্প শহর ছাতকের মন্ডলীভোগে ‘ছাতক বধির সংঘে’র এক অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজেই আবেগে আপ্লোত হয়ে পড়ি। প্রায় অর্ধশতাধিক লোক এক সঙ্গে জড়ো হয়ে নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন আমাদের কাছে।
চারিদিক অনেকটা নীরব নিস্তব। পেছনে ছবি সম্বলিত বধির সংঘের বন ভোজনের ব্যানার। ছাতকের বিশিষ্ট সমাজসেবী আলহাজ¦ মো. জাহাঙ্গীর আলম সহ আমরা তিন জন ব্যতিত সবাই মুখ ও বধির প্রতিবন্ধী। নিজেদের মধ্যে পরষ্পর ভাব বিনিময় করছেন ইশারায়। তন্মধ্যে ওই সংঘের সাধারণ সম্পাদক আবু সায়েদ (বধির) এগিয়ে এসে কাগজ-কলম হাতে নিয়ে লিখতে শুরু করেন। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত বধির স্কুলের শিক্ষকও বটে। কাগজের টুকরায় তিনি স্পষ্ট বাংলা অক্ষরে লিখনে আপনি কোন পত্রিকার সাংবাদিক? আমি আমার পেশাগত কর্ম প্রতিষ্ঠানের নাম লেখার পর তিনি দাঁড়িয়ে সহকর্মীদের ইশারায় সকলের সঙ্গে আমার পরিচয় বিনিময় করলেন। উপস্থিত সবাই তখন তার কথা বুঝতে পেরে কড়তালির মাধ্যমে আমাদের কে শুভেচ্ছা জানালেন। কিংপতন নীরবতায় বলতে শুরু করেন তাদের মানবেতর জীবন সংগ্রামের কথা। নিজে কান্না জড়িত কন্ঠে ইশারা ভাষায় বলেন, ‘আমি আবু সায়েদ নিজে একজন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। এই এলাকায় আমার মতো আরো অনেক ভাইয়েরা আছেন। তারা নানা কারণে এ সমাজ ব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলিত ও বঞ্চিত। আমি আমার প্রতিবন্ধী ভাইদের কথা ভেবে নিজে অক্ষর জ্ঞান ও ইশরা ভাষা শিক্ষা করি। পরবর্তীতে সমাজের এইসকল প্রতিবন্ধীদের খোঁজে খোঁজে বের করি। প্রায় অর্ধশত বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নিজের প্রচেষ্ঠায় ‘ছাতক বধির সংঘ’ নামে একটি সংগঠন করি। এই সংগঠনের পরিচালক আমি নিজেই। ২০১৫ সালে ছাতক শহরের একটি ভাড়াটে ভবনে বধির স্কুল প্রতিষ্ঠা করি। প্রতি মাসে স্কুলের ভাড়া নিজেরাই পরিশোধ করি। বিগত বেশ কিছু দিন ধরে ভাড়া দিতে না পারায় স্কুলটি পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। পরিশেষে আমার প্রতিবন্ধী ভাইদের কথা চিন্তা করে নিজের বাসায় ফের স্কুল কার্যক্রম শুরু করি। আমরা নিজেদের কখনো এই সমাজে ছোট রাখতে চাইনা। নিজেদের কর্ম দক্ষতা আর মেধার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে চাই। আমরা আমাদের মেধা ও কর্ম দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। তাই আমার সহকর্মীদের নিয়ে আজ আমার এ পথচলা। আমি নিজে একজন কাট মিস্ত্রী। আমার ভাইয়েরাও ইতোমধ্যে বিভিন্ন পেশায় নিজেদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। আমরা সমাজের কথা বলতে পারা ও শোনতে পারা সুস্থ লোকদের মতোই প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। কিন্ত মননে এমন সাধ থাকলেও যে আমাদের সাধ্য নেই। প্রতিনিয়ত শ্রমিকের কাজ করেও তারা প্রতি শুক্রবারে আমার স্কুলে শিক্ষা অর্জন করছে। আমার সহকর্মীরা অত্যন্ত আনুগত্যশীল। তাদের নিয়ে আমি সুখী। ইশারা ভাষায় এমন কথা গুলো বলছিলেন। আর তার দু চোখ ছেয়ে পানি গড়াচ্ছিল। তার ইশারা ভাষায় বলা কথাগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার পর নিজেও আবেগাপ্লোত হয়ে যাই। একটা এলাকায় সমাজের এ অসহায় প্রতিবন্ধীদের কথাগুলো হয়তো কেই বুঝেনা। কিন্ত সরকার যেখানে ওইসব প্রতিবন্ধীদের জন্য সারা দেশে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন । কিন্ত হয়তো সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ এখানকার প্রতিবন্ধীদের কপালে নেই। স্থানীয় বয়োজেষ্ট এক সমাজসেবী আজিজুর রহমান জানালেন, ২০১৫ সালে প্রতিবন্ধী আবু সায়েদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি স্থানীয় একটি ভবনের ভাড়াটে রুম নিয়ে বধির স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমি তাদের পাশে রয়েছে। বিভিন্ন ভাবে সাহায্য-সহযোগিতা এনে তাদের পাশে রয়েছি। কিন্ত সর্বশেষ ভাড়া দিতে না পারায় ঘরের মালিক রুম তালাবদ্ধ করে দিলে বন্ধ হয়ে যায় স্কুল কার্যক্রম। এখন তার নিজের বাসায় বধির স্কুল প্রতিষ্ঠা করে প্রতি শুক্রবার ইশরা ভাষায় শিক্ষাদান করছেন।
পৌর শহরের জাবা মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালের স্বত্তাধিকারী বিশষ্ট সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ আলহাজ¦ মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বধির আবু সায়েদের সঙ্গে পরিচয় দীর্ঘ দিন ধরে। তিনি একজন দক্ষ কাঠ মিস্ত্রীও। আমার সকল কাজ-কর্ম তাকে দিয়ে সবসময় করি। অতীতে তাদের এই সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি এসেছি। সাধ্য মতো তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। সমাজের বিত্তবানরা সহ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তাদের বধির স্কুল প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা প্রয়োজন। একসময়ে এই প্রতিবন্ধীরাই এ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১১:১৭