মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী
প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান সিলেটের ইসলামি আন্দোলনের একজন কিংবদন্তি আলেম ছিলেন। তিনি একাধারে লেখক-গবেষক ও একসময়ে সিলেটের রাজপথ কাঁপানো সংগ্রামী নেতা ছিলেন। ৯০ এর দশকে ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড নাস্তিক-মুরতাদদের বিরুদ্ধে তিনি গর্জে উঠেছিলেন। তখন থেকেই তিনি বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় হন। তাঁর ডাকে হাজার হাজার আলেম-ওলামা, ছাত্র শিক্ষকেরা এক কাতারে সমবেত হওয়ার দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছিলেন। ১৯৯০ সালের পরবর্তী সময়ে আমি খুব কাছ থেকে দেখিছে আলেম সমাজের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমানের আন্দোল-সংগ্রামের স্পৃহা। তাঁর আহবানে শুধু আলেম সমাজই নন বৃহত্তর সিলেটের সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মানুষ সাড়া দিতেন। ঐতিহাসিক কোর্ট পয়েন্টে তাঁর প্রতিষ্ঠিত অরাজনৈতিক বিপ্লবী সংগঠন ‘সাহাবা সৈনিক পরিষদ’ এর মঞ্চে তাঁর প্রদত্ত বক্তব্য আজো হৃদয়ে সাড়া জাগে। দেশের অভ্যন্তরীণ এমনকি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইসলাম ও মুসলমানদের কান্তি লগ্নে তিনি গর্জে উঠেছেন। সবসময় আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন ব্রতী। তৎসময়ের আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথ কাঁপানোর কারণে পরবর্তী সময়ে তিনি সর্ব মহলে ‘বুলবুলি’ হুজুর নামেও সমধিক পরিচিত ছিলেন। আমৃত্যু তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির, জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজিরবাজার মাদরাসার প্রতিষ্ঠিাতা ও প্রিন্সিপালের দায়িত্বপালন করেছেন। তাঁর চলে যাওয়ায় সিলেট বিভাগের আলেম-ওলামাগণ একজন বরেণ্য আলেম ও প্রখর মেধাবীকে হারিয়েছেন। যাঁর শূণ্যতা কখনো পূরণ হবার নয়।
প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান ১৯৪৯ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি দেশের প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সিলেটের গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ি আলিয়া মাদরাসায় ফাজিল পাশ করে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা হতে কৃতিত্বের সঙ্গে কামিল পাশ করেন।
১৯৭৪ সালের জুনে দেশের শীর্ষ আলেমদের তত্ত্বাবধানে সিলেটের কাজির বাজার এলাকায় সুরমা নদীর তীরে প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহ্যবাহী জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার মাদরাসা। দারুল উলুম দেওবন্দের নীতিতে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটি সিলেট বিভাগের মধ্যে অন্যতম দ্বীনি বিদ্যাপীঠ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। এটি কওমী মাদরাসা হিসেবে সু প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান নিজের স্বীয় মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে শুরু থেকেই ওই প্রতিষ্ঠানে ইসলামী উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশী আধুনি শিক্ষার বিকাশে সিলেবাসে বাংলা, ইংরেজিসহ জাগতিক বিষয় যুক্ত করে নতুন ধারার সূচনা করেন। বৃহত্তর সিলেটের অন্যান্য ক্বওমী মাদরাসা হতে কাজির মাদরাসা শিক্ষা নীতি ছিল স্বতন্ত্র। এ কারণে পরবর্তী সময়ে কওমী পড়ুয়াদের জন্য ‘জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার’ ইসলামী উচ্চ শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার সুথিকাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। উল্লেখ্য, প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান কওমি মাদরাসার প্রধানের পরিচয় মুহতামিম হলেও, তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন প্রিন্সিপাল হিসেবে। সকলের কাছে তিনি প্রিন্সিপাল হাবীব নামে সু পরিচিত।
প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান ১৯৯৪ সালে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়ে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি করেন। তৎসময়ে সারা দেশে ধর্মপ্রাণ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হন সিলেটের প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান। তার সংগঠন ‘সাহাবা সৈনিক পরিষদে’র ব্যানারে সিলেটে অসংখ্য সভা-সমাবেশ করেন। মূলত সিলেট থেকে তাঁর এই আন্দোলনের সূচনা থেকেই সারা দেশে প্রত্যন্ত এলাকায় বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সাহাবা সৈনিক পরিষদ’র ব্যানারে তৎকালে বৃহত্তর সিলেটের সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দৃষ্টান্ত মূলক নজির তিনি দেখিয়েছিলেন। এছাড়াও দেশের নাস্তিক-মুরতাদবিরোধি আন্দোলনের সবসময়ই তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।
অভিভক্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের রাজনীতি থেকে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ খেলাফত মসজিলের আমির নির্বাচিত হন প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান। ২০১২ সালে ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশে খেলাফত মজলিসের আমির শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক মৃত্যুবরণ বরণ করার পরে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্তে দলের আমির নিযুক্ত হন মাওলানা হাবিবুর রহমান।
জীবদ্দশায় তিনি সময়পযোগী ও ইসলামী গবেষণা ধর্মী অসংখ্য বই, গ্রন্থ লিখেছেন। এক সময়ে বরেণ্য এই আলেমের ক্ষুরধার লেখনিতে বৃহত্তর সিলেটের সর্বস্তরের আলেম-ওলামাসহ বিশেষ করে কওমী ঘরানার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছেন। মসজিদ-মাদরাসা রক্ষা ও সর্বক্ষেত্রে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সবসময় তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য নিবেদিত প্রাণ পুরুষ। কিন্ত পরবর্তী সময়ে শারীরিক অসুস্থতা ও নানা কারণে সিলেটের এই বর্ষিয়ান আলেম রাজনীতির মাঠে অনেকটা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েন। বিশেষ করে ২০১২ সালের পরবর্তী সময়ে উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর পরলোক গমনের পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে ভাঙন দেখা দিলে প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান এই ধারার রাজনীতিতে ধ্বস নামে। সাবেক মন্ত্রী অধ্যক্ষ মাওলানা ইসহাক ও অধ্যাপক ডক্টর আহমদ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিসের বড় একটি অংশ পৃথক হয়ে গেলে তিনি অপর অংশ নিয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর নির্বাচিত হন। আমৃত্যু তিনি এই দলের আমীর হিসেবে দায়িত্বপালন করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক স্ত্রী, চার ছেলে ও তিন কন্যা সন্তানের জনক। তার বড় ছেলে মাওলানা মুসা বিন হাবীব জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল। দ্বিতীয় ছেলে মাওলানা ইংল্যান্ড প্রবাসী। তৃতীয় ছেলে তারেক বিন হাবীব সিলেট মহানগর ছাত্র মজলিসের সভাপতি, চতুর্থ ছেলে তায়েফ বিন হাবীব ইংল্যান্ড প্রবাসী। তাঁর বড় জামাতা মাওলানা তাজুল ইসলাম, দ্বিতীয় জামাতা মাওলানা আতাউর রহমান ইংল্যান্ড প্রবাসী, ছোট জামাতা মাওলানা সহল আল রাজি ব্যবসায়ী ও সিলেট জেলা পরিষদের সদস্য।
ইসলামি আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির, জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজিরবাজার
মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান শুক্রবার (১৯ অক্টোবর) রাত সাড়ে ১২টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করেন। তিনি পরলোক গমন করায় বৃহত্তর সিলেটের আলেম-ওলামাদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা মাঠে তাঁর জানাযায় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে তিনি কতটা ভালবাসার মানুষ ছিলেন। সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ধর্মপ্রাণ মানুষের ঢল নামে কিংবদন্তি ওই আলেমের জানাযায়। আল্লাহ পাক তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন করুন এই কামনা করি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৩:০৯