ব্যান্ড সঙ্গীতের আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে লোক সাহিত্য
মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী
আধুনিক ব্যান্ড সঙ্গীত ও বাধ্য যন্ত্রের ছন্দ পতনে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এখন আমাদের গ্রাম বাংলার লোক সাহিত্য-সংস্কৃতি। গ্রামের আউল-বাউল, ফকির, মরমী কবি ও বয়াতিদের সেই সূর এবং বাদ্য যন্ত্র বর্তমানে অনেকাংশেই বিলুপ্তির পথে এগুচ্ছে। তাঁদের গানগুলো আজ বিভিন্ন অঙ্গনে গাওয়া হলেও নেই আগেকার সেই সূর ও তাল। এ প্রজন্মের ব্যান্ড সঙ্গীতের আদলে এদেশীয় লোকসাহিত্যে বাউল গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, কবিগান, জারিগান, সারিগান, ঘাটু গান,যাত্রা গান, ঝুমুর গান, জাগের গান প্রভৃতি গান গুলো আজ ক্রমেই নিজস্ব সূর এবং স্বকীয়তা হারাচ্ছে। এ কারণে গ্রাম বাংলার লোকজ সাহিত্যে ব্যান্ডের সংমিশ্রণ নিয়ে অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে সর্বত্র।
গত ১৬ অক্টোবর মঙ্গলবার রাত ৮টায় রংপুর হতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘গান বাংলা’য় সরাসরি সম্প্রচারিত হয় ‘শেকড়ের সন্ধানে’ শিরোনামে এক মেগা কনসার্ট। হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতাদের উপস্থিতিতে কথিত সে মেগা কনসার্টের শুরুতেই একাধিক শিল্পীরা দেওয়ান হাসন রাজা, ফকির লালন শাহ, শাহ আব্দুল করিম, রাধা রমন দত্ত, দূর্বিন শাহর রচিত একাধিক গান পরিবেশন করেন। যা আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য যে সেই কনসার্টে ব্যান্ড সঙ্গীতের আধুনিকতায় প্রত্যেকটি গানের নিজস্ব সূর ও ছন্দ বিকৃত হয়েছে। এমন কি পরিবেশিত জনপ্রিয় গান গুলোর বিকৃত বাধ্য যন্ত্রের তালে মূলত শেকড়ের মূলই কেটে দেয়া হয়েছে বলে আমি মনে করছি। গ্রামীণ জনপ্রিয় বেশ কয়েকটি গানের ছন্দও বিকৃত হয়েছে ব্যান্ডের আদলে বাউল সঙ্গীতের বাধ্যযন্ত্রের অবলীলা শব্দে।
গান বাংলা টিভি’র সরাসরি সম্প্রচারিত মেগা কনসার্টের শুরুতে জনৈক এক শিল্পী হাসন রাজার জনপ্রিয় গান ‘‘আগুন লাগাইয়া দিল কোনে, হাসন রাজার মনে’’ এই গান মুখরোচক সুরেই গাইলেন। আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ও বিকৃত সূরের কারণেই পুরো গানটিই যেন বিকৃত ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। জনপ্রিয় এই গানটি হারিয়েছে সেই আদি সুর। ‘‘কাদতে যদি না পাই তরে/ তাই বুঝি আজ বুক ভেসে যায় নয়নের জলে/ভাল বাসি বলেরে বন্ধু আমায় কাঁদালে’’। জনপ্রিয় এই বাউল গানটিও শেষমেষ জারি গানের সুরে মূল গানের কথা ও সূরের ছন্দ পতন ঘটে। একই ভাবে ‘‘ কমলায় নিত্য করে চমকিয়া চমকিয়া’’ জনৈক মহিলা শিল্পীর সূরে ভেসে উঠে আধুনিক ব্যান্ড সঙ্গীতের মোর্ছনা। সরাসারি মেগা কনসার্টের এক পর্যায়ে প্রতিটি গানের সুর ও তাল ঠিকঠাক না থাকায় অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি সময়ে ‘গান বাংলা’ টিভি কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই সম্প্রচার বন্ধ করে অন্য অনুষ্ঠানে চলে যেতে হয়েছে। পুরো অনুষ্ঠান জুড়েই কনসার্টের বিকৃত বাদ্যযন্ত্রের সুর যেন শ^দ দোষণের সৃষ্টি হয়েছিল।
এই যদি হয় আমাদের আধুনিকতার ছোঁয়া, তাহলে অচিরেই আমাদের গ্রামীণ লোক সাহিত্যে সূর ও ছন্দের পতন ঘটবে। সব মিলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ঐতিহ্য লোক সঙ্গীত ‘জগা খিচুরীতে’ পরিণত হবে। এখানে আমি অসঙ্গতি প্রকাশ করছি এ জন্য যে- ব্যান্ড সঙ্গীতের আদলে লোক সাহিত্য সংস্কৃতির বড় এই অংশটার সংমিশ্রণ ঘটালে আগামী প্রজন এক সময় ভুলে যাবে গ্রামীণ সেই চির চেনা ও জনপ্রিয় সূর গুলো।
অথচ বাংলাদেশের লোক সাহিত্য বাংলা সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সৃষ্টি হয়েছে গ্রমীণ জনগোষ্ঠির মাধ্যমে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এর প্রসার ঘটেছে মৌখিকভাবে। তথাপি বাংলা সাহিত্যকে এ লোক সাহিত্য ব্যাপ্তি প্রদান করেছে, করেছে সমৃদ্ধ। পৃথক পৃথক ব্যক্তি-বিশেষের সৃষ্টি পরিণত হয়েছে জনগোষ্ঠির ঐতিহ্যে যার মাধ্যমে প্রকাশ ঘটেছে ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তা চেতনার। যুগ যুগ ধরেই বাউল গান, মরমী গান পল্লী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ লোক সাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখেছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে-বাংলার মাঝিরা নৌকায় পাল তুলে মনের সুখে ভাটিয়ালি গান গায়। ভাটি অঞ্চলে রাত ভর একিত্রত হয়ে বাউলেরা একতারা বাজিয়ে তাঁদের তত্ত্ব তুলে ধরেন । বাউল আসরে গানের সুর তুলে মাতিয়ে তোলেন প্রত্যন্ত এলাকা। দেশের উত্তরাঞ্চলের গাড়োয়ান বা গরুর গারির চালক গাড়ি চালাতে চালাতে ভাওয়াইয়া গান গেয়ে যান মনের আনন্দে। বাংলাদেশের লোক সাহিত্যের অগ্রজ পুরোধাদের মধ্যে ফকির লালন শাহ, শাহ আব্দুল করিম, রাধা রমন দত্ত, দুর্বিন শাহ, তথ্যের ভান্ডার বাউল কফিল উদ্দিন সরকার অন্যতম। এদের রেখে যাওয়া গান আজো গ্রামবাংলার ঐতিহ্য হিসেবে স্থান দখল করে আছে। এদেশের লোক সাহিত্য ও তাঁদের কীর্তি আমাদের সামনে তুলে ধরতে কিছু মানুষ অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন।
এদেশীয় সংগীতে বাদ্যযন্ত্রের চেয়ে মৌখিক সুরের দক্ষতার উপর অধিক নির্ভরশীলতা লক্ষ করা যায়। লোকগীতির শ্রেণি গুলোর মধ্যে প্রেম, ধর্মীয় বিষয়, দর্শন ও ভক্তি, কর্ম ও পরিশ্রম, পেশা ও জীবিকা, ব্যাঙ্গ ও কৌতুক এবং এসবের মিশ্রণ।
আমি আধুনিক ব্যান্ড সঙ্গীত কে কোনো ভাবেই খাটো করে দেখছিনা। ব্যান্ডের যে নিজস্ব সূর ও স্বকীয়তা রয়েছে তা অব্যাহত রেখে সেই আলোকে গান তৈরী ও সূর তৈরী প্রয়োজন। কিন্ত ব্যান্ড অঙ্গনে যেন কোনো মিশ্রণ না ঘটে সে দিকে শিল্পী-কলা কৌশলীদের বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। পাশাপাশী আমাদের ঐতিহ্য লোক সাহিত্য বাঁচাতে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ একনিষ্ট গবেষণা এবং আন্তরিক প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ২:৪৯