প্রায় ২৭০০ বছর আগে মূল অলিম্পিক গেমস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে গ্রীক সভ্যতার প্রভাব সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো।এর মাত্র ২০০ বছর সময়ের মধ্যে গ্রীস তার ক্ল্যাসিকাল যুগে প্রবেশ করে।এ সভ্যতা তখন রাজনীতি,শিল্প,সাহিত্য আর দর্শনে চরম উৎকর্ষতা লাভ করে।সেই প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সভ্যতার কেন্দ্রে আবির্ভাব ঘটে চিকিৎসাশাস্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি---হিপোক্রেটিস(৪৬০-৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)এর। তিনি গ্রীসের কস উপদ্বীপে জন্মগ্রহন করেন।
চিত্রঃ হিপোক্রেটিস
গ্রীক চিকিৎসাশাস্ত্র মিশরীয় চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে নানান বিষয় ধার করলেও রোগশোক হবার পূর্ববর্তী ধারনা(রোগবালাই সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে একধরনের শাস্তি)থেকে তারা সরে এসেছিলো।গ্রীক চিকিৎসকরা মনে করতেন চারটি ধাতুর মধ্যে ভারসাম্যহীনতার কারনে অসুখ দেখা দেয়। এই ধাতুগুলোকে হিউমর(Humor) বলা হয়।এ ধারণাটি পরবর্তী ২০০ বছর ধরে বলবৎ ছিলো।এই হিউমরিজম(Humorism) এর ধারণা সম্ভবত মিশর কিংবা মেসোপটেমিয়া থেকে গ্রীসে এসেছে। আবার হিপোক্রেটাসের কয়েক দশক আগে দার্শনিক এমপেডক্লেস এর দেয়া “পৃথিবীর চারটি উপাদান—মাটি,বাতাস,আগুন আর পানি’’—এই ধারণা থেকেও আসতে পারে।
উৎপত্তি যেখান থেকেই হোক না কেনো হিউমরিজমের ধারণা অনুসারে মানবদেহে রয়েছে চার ধরনের হিউমর বা ধাতু।এগুলো হলো—রক্ত,হলুদ পিত্ত,কালো পিত্ত এবং কফ।একটি সুস্থ দেহে এই হিউমারগুলি সুষম এবং ভারসাম্য অবস্থায় থাকে।কিন্তু কোনভাবে যদি এই ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটে তাহলে অসুস্থতা দেখা দিবে।এই জীবদেহনিঃসৃত রস কিংবা ধাতুগুলোর ভারসাম্যহীনতার ধরন এবং বিশেষভাবে জড়িত কোন ধাতু যেকোন রোগকে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করে।কেননা প্রতিটা ধাতুর নিজস্ব বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং এগুলো শুধু নিজেদের সাথেই নয় দেহের অন্যান্য অংশের সাথেও সম্পর্কযুক্ত। রক্ত—বায়ু,যকৃত,বসন্তকাল,উষ্ণতা আর আর্দ্রতার সাথে যুক্ত।হলুদ পিত্ত সম্পর্কিত আগুন,প্লীহা,গ্রীষ্মকালের সাথে।কালো পিত্তের সাথে মাটি,পিত্তথলি,শরৎকাল,শীতলতা আর শুষ্কতার সম্পর্ক রয়েছে এবং কফ সম্পর্কিত পানি,ফুসফুস,মস্তিষ্ক,শীতকাল,ঠান্ডা এবং ক্লেদাক্ততার সাথে।উদাহরণস্বরূপ, ধাতু হিসেবে রক্তের পরিমাণ যদি বেড়ে যায় তাহলে অসুস্থতার ধরণ হবে শরীর উষ্ণ এবং আর্দ্র হয়ে যাওয়া। এছাড়া লালভাব,ফোলাভাব, নাড়ির দ্রুত স্পন্দন এবং ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস,ঘাম হওয়া,ঘুমে ব্যাঘাত,প্রলাপ বকা ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ এটা কোন ধরনের সংক্রমনের কারনে হওয়া জ্বর । এর চিকিৎসা হবে রক্তপাত ঘটানো যাতে শরীরের রক্ত এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্য ধাতুর পরিমাণ কমে যায়।
মূলত তৎকালীন ইউরোপে বেশিরভাগ রোগের কারন রক্তের সাথে সম্পর্কিত বলে ভাবা হতো। যার কারনে রক্ত-ঝরানোর অনুশীলন বেশ সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠে।এই ধাতু বা হিউমরগুলোর সাম্যতা বজায় রাখার অন্য পদ্ধতি হচ্ছে ভেষজ উদ্ভিদ এবং খাবারের সাথে বিশেষ ধরনের রস মিশিয়ে দেয়া।এটি হিউমরের পরিমাণ বাড়ানো না কমানো হবে তার উপর ভিত্তি করে দেয়া হতো।হিপোক্রিটাস হিউমর বা ধাতু সম্পর্কে বিশদভাবে লিখে গেছেন তার ‘হিপোক্রেটিক করপাস’ নামক বিশাল এক সংকলনে। এ সংকলনে প্রায় ৬০টি লিখিত নথি,বিক্ষিপ্ত নোট এবং ছোট বড় নানারকম যুক্তিসম্পন্ন গবেষণাপত্র ছাড়াও বিভিন্ন রোগীর রোগের ইতিহাসের বর্ননাও রয়েছে।
তবে বর্তমানকালে ধারনা করা হয় যে এই সবগুলো নথিপত্র হিপোক্রেটিস একা লিখেননি।কেননা এদের রচনাশৈলী,লেখার প্রকৃতি এবং মতামতের মধ্যে ভিন্নতা পাওয়া যায়।এ থেকে বুঝা যায় পরবর্তী তিন থেকে চার শতাব্দী ধরে তাঁর ছাত্র,শিষ্য ও অনুসারীরা এই সংকলনে অবদান রেখেছে। এই সংকলনগুলোর বিষয়বস্তুতে দার্শনিকতা ও প্রাকৃতিক জ্ঞান থেকে শুরু করে চিকিৎসাশাস্ত্রের জ্বরের উপসর্গ,মহামারীর আক্রমণ,ভাঙ্গা হাড়ের সমস্যা,স্থানচ্যুত অস্থিসন্ধি।মহিলাদের বন্ধ্যাত্ব, শিরা, দাঁত ,পরিচ্ছন্নতার স্বাস্থ্যবিধি, স্বপ্ন, অর্শ্বরোগ এবং মৃগীরোগ নিয়ে বিশাল পরিসরে বর্ননা করা হয়েছে।শেষের রোগটি মানে মৃগীরোগকে অনেক গ্রীক ‘পবিত্র রোগ’ হিসেবে চিহ্নিত করতো। অনেকে ভাবতো শয়তান ভর করার কারনে এই রোগ দেখা দেয়। তবে হিপোক্রেটিসের মতামত এই ধারণাকে বাতিল করে দেয় এবং বলা হয় যে,এই রোগ দেখা দেয়ার কারন শরীরের মধ্যেই নিহিত।মানুষ কেবলমাত্র অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার জন্য একে ঐশ্বরিক রোগ হিসেবে বিশ্বাস করে।
তথ্যের সীমাবদ্ধতার কারনে হিপোক্রেটিসের সম্পর্কে তেমন কিছু জানা সম্ভব হয়নি।তবে তিনি সক্রেটিসের সমসাময়িক ছিলেন এবং বিভিন্ন গ্রীক ব্যক্তিত্ব তাঁর নাম উল্লেখ করেছেন নিজেদের গ্রন্থাবলীতে।এদের মধ্যে প্লেটো ও সক্রেটিসও রয়েছেন। হিপোক্রেটিসের মৃত্যুর সময় প্লেটোর বয়স ছিলো ৩৫ এবং এরিস্টটল তখন তরুন বয়সের ছিলেন।হিপোক্রেটিসের বাবা সম্ভবত চিকিৎসক ছিলেন এবং তিনি কস দ্বীপেই প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত হন। অ্যাস্ক্লেপিয়ন(Asclepeion) হচ্ছে একটি মন্দির যা গ্রীক নিরাময় ও চিকিৎসার দেবতা অ্যাসক্লেপিওসকে উৎসর্গ করে বানানো হয়েছিলো। সেখানে অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হতো। অ্যাসক্লেপিওস নিজে হয়তো প্রাচীন মিশরের দেবতা বনে যাওয়া চিকিৎসক ইমহোটোপের গ্রীক সংস্করন।তার ট্রেডমার্ক ‘দ্য রড অব অ্যাসক্লেপিওস’ বা ‘অ্যাসক্লেপিওসের দন্ড’ নামে পরিচিত যা একটির লাঠি এবং একে ঘিরে থাকা কুন্ডলিত সাপের প্রতীক।হয়তো সাপের বিষ অল্পমাত্রায় রোগ সারাবার কাজে ব্যবহৃত হতো বলে অথবা সাপের খোলস নির্মোচন পুরনো সমস্যা ও অসুস্থতা দূর করে নতুন জীবনের শুরুর ইঙ্গিত দেয় বলে ট্রেডমার্কটি এমন হয়েছে।
চিত্রঃ কস দ্বীপে অবস্থিত অ্যাসক্লেপিয়ন মন্দির
উৎস যাই হোক না কেনো এই লাঠি এবং একে ঘিরে থাকা সর্প যুগযুগ ধরে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ছবিঃ অ্যাস্ক্লেপিওসের দন্ড
অ্যাস্ক্লেপিওসের দুই মেয়ে ছিলো যারা চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষার মাধ্যমে আজও জীবন্ত।হাইজিয়া(Hygieia) সম্পর্কিত ‘Hygiene’ এর সাথে আর প্যানাসিয়া(Panacea)কে সর্বজনীন নিরাময়ের দেবী হিসেবে দেখা হয়।
জীবনের বেশ কিছুটা সময় হিপোক্রেটিস সম্ভবত ঈজিয়ান সাগরের উপকূলে এবং এর অন্তর্দেশীয় অঞ্চলে চড়ে বেড়িয়েছেন যা বর্তমানে বুলগেরিয়া ও তুরসক নামে পরিচিত।তিনি চিকিৎসক হিসেবে চর্চা করেছেন,বক্তৃতা দিয়েছেন,ছাত্র পড়িয়েছেন এবং নিজের চিকিৎসা বিষয়ক ধ্যান ধারণা ও চর্চা নিয়ে মেতে ছিলেন।বলা হয়ে থাকে,তিনি এসবের চেয়ে বেশী কুশলী ছিলেন সঙ্গীত,কবিতা,গণিত এমনকি শারীরচর্চাতেও।সম্ভবত এক পর্যায়ে তিনি ২০ বছরের জন্য কারারুদ্ধ হন। কারন তিনি আত্মা কিংবা দেব-দেবীকে রোগ বালাইয়ের কারন হিসেবে মানতে নারাজ ছিলেন।সেসময়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাকে এই শাস্তি দিয়েছিলো যারা নিজেদের মানুষ আর দেব-দেবীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ভাবতো।হিপোক্রেটাসের শিক্ষা –দীক্ষা তাদের শক্তিকে ক্ষয় করে তুলছিলো।দুঃখের বিষয়—এরপর হিপোক্রেটিসের কি হয়েছিলো তা আর জানা যায়নি।এমনকি কোথায় তাঁর মৃত্যু হয় তাও সঠিকভাবে জানা যায়নি।তবে অস্পষ্টভাবে যা জানা যায় তাতে বলা হয়েছে তিনি গ্রীসের উত্তরপশ্চিমের লারিসা নামক স্থানে মারা যান।
আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক কিছুই হিপোক্রেটিসের বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি থেকে এসেছে।আমরা অসুস্থতাকে তীব্র(হঠাৎ আরম্ভ হয় এবং স্বল্পস্থায়ী) এবং ক্রোনিক( দীর্ঘস্থায়ী)—এ দুভাগে ভাগ করি।আর রোগবালাইকে এন্ডেমিক( একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বা জনগোষ্ঠী ঘন ঘন দেখা দেয়) এবং এপিডেমিক বা মহামারী( হঠাৎ জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশে ছড়িয়ে পড়ে)—এ দু শ্রেণিতে বিভক্ত করি।বর্তমানে চিকিৎসারীতি অনুযায়ী যেভাবে রোগীর রোগের ইতিহাস,পর্যবেক্ষন,পরীক্ষন করা হয় তাঁর মূল পথিকৃৎ হচ্ছে ‘হিপোক্রেটিক স্কুল অব মেডিসিন’।পর্যবেক্ষন করা সেসময়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তবে হিপোক্রেটিস এটাকে একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ার মাঝে নিয়ে আসেন।প্রতিদিন কমপক্ষে একবার রোগীকে পর্যবেক্ষন করা হতো যাতে রোগ নির্নয় এবং রোগের প্রাকৃতিক কারন জানার মাধ্যমে পরবর্তীতে রোগের অবস্থা সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়া যায় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যায়।হিপোক্রেটিস মনে করতেন রোগের ব্যাপারে পূর্বাভাস দেয়ার অভ্যাস চর্চা করা একটি চমৎকার ও কার্যকরী ব্যাপার। তাঁর মতে,‘সেই ভালো চিকিৎসা করতে পারবে যে রোগের বর্তমান উপসর্গ দেখে পরবর্তীতে কি হতে পারে তা ধারণা করে নিতে পারে।’প্রত্যেক রোগীর জন্য সেসময় নথি রাখা হতো যাতে রোগের লক্ষন ও উপসর্গ যেমন—শ্বাস প্রশ্বাসের হার,তাপমাত্রা,ত্বক ও গাত্রবর্ন, চোখ ও মুখের অবস্থা এবং রেচন পদার্থের প্রকৃতি ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করা থাকতো। মল-মূত্র অর্থাৎ রেচন পদার্থের প্রতি হিপোক্রেটিসের আগ্রহ ছিলো কারন তিনি বিশ্বাস করতেন শরীরের বিভিন কার্যাবলী জানতে এসব নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে।একজন ব্যক্তির খাবারের অনুপাতের উপর নির্ভর করে দৈনিক এক কি দুইবার-বিশেষ করে সকালে মলত্যাগ হওয়াটাই সুস্থতার লক্ষন।উদরস্ফীতি হবার চেয়ে নিয়িমিত পায়খানা হওয়াটাই শরীরের পক্ষে ভালো বলে তিনি মনে করতেন।
রেক্টাল স্পেকুলাস—চিমটা জাতীয় এক ধরনের যন্ত্র যা শরীরে ক্ষুদ্র ছিদ্র করে শরীরের ভিতরের অবস্থা পর্বেক্ষনে ব্যবহার করা হতো।এটাই এখনকার এন্ডোসকপির প্রাচীনতম সংস্করন।এর মাধ্যমে প্রাকৃতিক উপায়ে আভ্যন্তরীণ অংশ দেখা কিংবা উদ্দেশ্যজনকভাবে শরীরে কাটাছেঁড়া করা হতো। এছাড়া কষ্টকর অর্শ্বরোগ থেকে শুধু করে বন্ধ্যাত্ব সবক্ষেত্রেই ঔষধ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের মলম ব্যবহার করার কথা জানা যায়।
হিপোক্রেটিস পরামর্শ দেন যে সকল নথি এমনভাবে লিপিবদ্ধ করা উচিত যাতে তা স্পষ্ট,বস্তুনিষ্ট এবং বিশৃঙ্খলামুক্ত সহজ সাবলীল হয়।এতে করে এসকল অভিজ্ঞতাতে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী চিকিৎসাক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা নেয়া সম্ভব হবে। অন্যান্য চিকিৎসকগণের এইসব নথিপত্র কাজে লাগিয়ে চিকিৎসা করার সুযোগ থাকতে হবে।
অবাক হতে হয় সেসময়ে হিপোক্রেটিসের চিকিৎসাপদ্ধতির ধরণ ছিলো রোগীর প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে সতর্ক ও সাবধানী হয়ে চিকিৎসা দেয়া যার উপর বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।সবচেয়ে কার্যকরী প্রতিকার ধরা হতো—পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা,আরামদায়ক স্থানে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ এবং নিয়মিত পর্বেক্ষনে থাকা যাতে প্রাকৃতিক শক্তিই রোগ নিরাময়ে সহায়ক হয়।ব্যান্ডেজিং, ম্যাসেজিং এবং মলমের ব্যবহার থাকলেও শক্তিশালী ঔষধ আর নিষ্ঠুর ও কষ্টকর কিছু কৌশল ছিলো শেষ অবলম্বন।
চিকিৎসকদের জন্য প্রধান অনুশাসন ছিলোঃ ‘প্রথমত,কোন ক্ষতি করা যাবেনা’।আক্রমণাত্মক এবং নিষ্ঠুর কৌশল যদিও বিরল ছিলো। গ্রীসে এবং পরবর্তী প্রাচীন রোমে শারীর শিক্ষা বা চিকিৎসার জন্য মানবদেহ ব্যবচ্ছেদ করা ছিলো নিষিদ্ধ ।সার্জারি বা অস্ত্রোপচার শুধুমাত্র ক্ষত এবং আকস্মিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিলো।এই কারনে মানবদেহের ভিতরটা সেসময় রহস্য হিসেবেই রয়ে গিয়েছিলো।
হিপোক্রেটিসের নিকট পরীক্ষিত এবং বিশ্বাসযোগ্য বেশ কিছু প্রতিকার ব্যবস্থা ছিলো।এসবের মধ্যে জলপাই তেল,মধু এবং প্রায় ২০০ রকমের শাকসবজি আর ভেষজ যেমন—ডুমুর,রসুন,পেঁয়াজ, পোস্তদানা,গোলাপ ফুল,ক্যামোমিল,জিরাজাফরান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।অপরিণামদর্শী ও বোকার মতো খাদ্যগ্রহন দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতার কারন হতে পারে বলে মনে করতেন তিনি।হিপোক্রেটিসের মতে,‘খাদ্যই তোমার ঔষধ এবং ওষধই তোমার খাদ্য’। অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে খাদ্য খাওয়ার ব্যাপারে তিনি মনে করতেন এতে করে রোগটাকেই খাবার খাওয়ানো হচ্ছে।
হিপোক্রিটাসের চিন্তার আরেকটি দিক হলো, রোগীর ‘সঙ্কটাবস্থা’র ধরণ পর্বেক্ষন করা।এতে রোগের উন্নতি হওয়া কিংবা হঠাৎ এমন মুহুর্তে রোগের অবস্থা চলে যাওয়া যাতে রোগের অবস্থা সারাবার সাধ্যের বাইরে চলে যায় আবার হয়তো প্রাকৃতিক উপায়েই রোগের উপশম হওয়া ইত্যাদি লক্ষ করা হয়। হিপোক্রেটীয় তত্ত্বানুসারে, রোগ শুরু হওয়ার একটি বিশেষ সময় পরেই সঙ্কটের সময় শুরু হয়। এই নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে যদি সঙ্কটমুহুর্ত আসে, তবে তা বারবার ফিরে আসতে পারে। গ্যালেনের মতে, এই ধারনা হিপোক্রেটিস প্রথম প্রচলন করেন, যদিও তাঁর পূর্ব থেকেই এই ধারণা প্রচলিত ছিল এমন মত রয়েছে।
অনেক রোগ রয়েছে যেগুলো বর্ননা প্রথমে হিপোক্রেটিস ও তাঁর অনুসারীরা দিয়েছিলো।নখ ও আঙ্গুল একত্র হয়ে যাওয়া এর মধ্যে একটি।এটি ‘হিপক্রেটিক ফিঙ্গার’ নামে পরিচিত।হিপোক্রেটিসের শিক্ষা ও রীতিনীতি অন্যান্য গ্রীক চিকিৎসকদেরও প্রভাবিত করেছিলো।হেরোফিলাস(Herophilus) নামের আলেকজান্দ্রিয়ার এক চিকিৎসক তখন মানবদেহ ব্যবচ্ছেদ করার অনুমতি পেয়েছিলেন।তিনি ফুদফুদ, রক্তের নালী,মস্তিষ্ক,চোখ এবং স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেছিলেন।তাকেই প্রথমদিককার অন্যতম একজন এনাটোমিস্ট( অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ) হিসেবে গণ্য করা হয়।তার কিছুকাল পরে এরাসিস্ট্রাটোস(Erasistratus)নামের আলেকজান্দ্রিয়ার আরেকজন চিকিৎসক মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফুসফুস ও রক্ত পরিবহনব্যবস্থার উপর বিশেষ কাজ করেন।
ধীরে ধীরে হিপোক্রেটিক আন্দোলন চিকিৎসকদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলাতে ভূমিকা রেখেছিলো।উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে চিকিৎসকদের সামাজিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলোনা কারন পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে সমস্যা সমাধানের চেয়ে সমস্যা বৃদ্ধিতেই তাদের ভূমিকা বেশি ছিলো।জনমনে ধারণা পরবর্তনে মূল ভূমিকা রেখেছিলো অবশ্য বিখ্যাত ‘হিপোক্রেটিক স্বাস্থ্যসেবার আচরণবিধি’। আমরা হিপোক্রেটিসের শপথের মাধ্যমে এর সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি এবং এর প্রয়োজনীয়তা যে যুগ যুগ ধরে রোগী ও সাধারণ মানুষের জন্য উপকারী তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাছাড়া কেইবা চাইবে উন্মাদ, বেপরোয়া, অপরিচ্ছন্ন, খামখেয়ালী, অনৈতিক, অমানবিক এবং আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে যোগাযোগহীন কোন চিকিৎসকের কাছে যেতে !
‘হিপোক্রেটিক করপাস’ এর চিকিৎসক সম্পর্কিত অংশে একজন আদর্শ চিকিৎসক কেমন হবে তা বলে দেয়া আছে।একজন আদর্শ ডাক্তারকে হতে হবে সৎ, ন্যায়পরায়ণ,দুর্নীতিমুক্ত এবং সেবা করার মানসিকতা সম্পন্ন।তাকে রোগীর সাথে ভদ্রভাবে সৌজন্যতার সাথে কথা বলতে হবে,রোগীর অবস্থার যত্ন নিতে হবে এবং রোগের লক্ষনগুলো গুছিয়ে লিপিবদ্ধ করতে হবে।ডাক্তারখানা হতে হবে পরিষ্কার-পরিপাটি এবং খোলামেলা পরিবেশযুক্ত।আরেকটি উল্লেখযোগ্য হিপোক্রেটিক মতাদর্শ হলো, রোগীর গোপনীয় তথ্য বিশ্বস্ততার সাথে গোপন রাখা।এতে চিকিৎসকগণ কেমন পোশাক পরবে কিংবা কিভাবে চলাফেরা করবে সে সম্পর্কেও বলে দেয়া হয়েছে এই নির্দেশনায়। হিপোক্রেটিসের এই আদর্শ ডাক্তারের ধারণা এসেছে হিপোক্রেটিসের শপথের সাথে বিভিন্ন নব্য সংযোজনের মাধ্যমে।শপথটির নানানরকম সংস্করনের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটা এখানে দেয়া হলোঃ
“আমি শপথ করতেছি নিরাময়ের দেবতা অ্যাপোলো ও অ্যাস্ক্লেপিয়স,হাইগিয়া এবং প্যানাসিয়ার নামে---
সকল দেবতা ও দেবীদের সাক্ষী রেখে আমি আমার সামর্থ্য ও বিচারবুদ্ধি অনুসারে নিম্নলিখিত শপথ পালন করার চেষ্টা করবো।আমি আমার সাধ্যমতো রোগীর উপকারের জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করবো---আমি কখনো কারো ক্ষতি করবোনা—কোন মারাত্মক পথ্য রোগীকে দিবনা—আমি আমার জীবন এবং অর্জিত জ্ঞানের শুদ্ধতা বজায় রাখবো—প্রতিটা বাড়িতে আমি শুধুমাত্র রোগীর ভালো করার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করবো—নিজেকে সকল প্রকার ইচ্ছাকৃত দুর্ব্যবহার এবং মোহাবিষ্ট করা থেকে বিরত থাকবো।বিশেষ করে নারী ও পুরুষ উভয়ের সাথে প্রেম আনন্দ করা থেকে দূরে থাকবো—হোক তারা মুক্ত কিংবা দাস—যা কিছু আমার জানার গোচরে আসে সেটা আমার পেশার সাথে সম্পর্কিত কিংবা সম্পর্কিত নয় তা আমি অবশ্যই গোপন রাখবো,কখনো কারো নিকট প্রকাশ করবো না।”
চিত্রঃ ‘হিপোক্রেটিসের শপথ’ এর ইংরেজি সংস্করণ
সারা বিশ্বজুড়ে মেডিকেল ছাত্ররা তাদের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক চয়নকৃত হিপোক্রিটাসের শপথ নিয়ে থাকেন।যদিও মূলের সাথে বর্তমানকালের শপথের অনেকটা অমিল রয়েছে।তবুও এ শপথ নৈতিকতা,সতর্কতা,পরিচ্ছন্নতা এবং সহানুভূতিশীলতার উপর জোর দিয়ে থাকে যাতে করে রোগীর এবং চিকিৎসক উভয়েরই মঙ্গল সাধিত হয়।
তথ্যসূত্রঃ
1/Hippocrates and Greek Medicine, Kill or Cure: An Illustrated History of Medicine By Steve Parker
2/ https://en.wikipedia.org/wiki/Hippocrates
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:১৯