জিলা স্কুলের হোস্টেলে জীবনের সবচাইতে রঙ্গিন সময়গুলো কাটাতে কাটাতে আমি পড়তাম চাচা চৌধুরী কমিকস, সাইমুম সিরিজ ইত্যাদি। খেলাধূলায় তেমন পটু না হওয়ায় বিকের বেলায় মাঠে ঘাসের উপর বসে বসে অবসর কাটাতাম। তেমনি এক বিকেলে পাশের মসজিদ মার্কেট থেকে হাতখরচের টাকা দিয়ে প্রথম কিনেছিলাম হুমায়ূন আহমেদের "কিছু শৈশব"। সেই থেকে শুরু।
তথাকথিত পন্ডিতদের কাছে যিনি সস্তা লেখক। বস্তুত, তারা কিসের ভিত্তিতে হুমায়ূন আহমেদকে সস্তা লেখক বলে। সেটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে যিনি বইমুখী করেছে। এক বইমেলায় যার হাজার হাজার কপি বই বিক্রি হয়। যার অটোগ্রাফের জন্য লাইন বাড়তে বাড়তে মেলা প্রাঙ্গন পেরিয়ে যায়। তিনি সস্তা লেখক?
"নন্দিত নরক" দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে যাত্রা করে। যিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ।
" কিছু শৈশব" পড়ার পর ধীরে ধীরে কিনতে থাকলাম হিমু সিরিজের বইগুলো। মনে আছে স্পষ্টত, বাড়ি থেকে যে টাকা দিত হাতখরচের জন্য সেটা দিয়ে বই কেনার পর তেমন কোন টাকাই হাতে থাকত না। কখনো কখনো সকালের নাস্তায় ৫ টাকার ডালভাজি, চা দুিজনে ভাগাভাগি করেছি।
হিমু হওয়ার বাসনা অনার্স ৩য় বর্ষ পর্যন্ত বেশ ভাল ভাবে ঝেঁকে বসেছিল। এখনো মাঝে মাঝে পুরনো রোগ উগলে উঠে। আসলে, বই এবং বইয়ের চরিত্র গুলোও এক ধরনের নেশা তৈরী করতে পারে।
জুনিয়র বৃত্তি পরিক্ষার আগের রাতেও বইয়ের ভেতরে লুকিয়ে লুকিয়ে হিমু সিরিজের বই পড়েছি।
মিসির আলী'কে নিয়ে কখনোই কোন আগ্রহ আমার ছিল না। কেন আগ্রহ ছিল না? সে প্রশ্নের সমাধান আমার কাছে নেই।
অষ্টম শ্রেণীর পর কোন এক কারণে জিলা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হবার পর আমি যে পরিবেশে বসবাস করতে লাগলাম। বখে যাওয়াটা তখন স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু, একমাত্র হূমায়ূন স্যারের মত মানুষদের লেখা আমায় আঁটকে রেখেছে বইয়ের মাঝে।
বইয়ের প্রতি অধম্য আগ্রহ থাকলেও পাঠ্য বইয়ের প্রতি মাধ্যমিকেন পর আর কোন আগ্রহ ছিল না।
ক্লাস টেনে যখন স্যার জিজ্ঞেস করতো। এইম ইন লাইফ কি? মা চাইতেন, আমি ইঞ্জিনিয়ার হই। বাবা চাইতেন, ডাক্তার।
আর আমি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বাদ দিয়ে যখন লেখক হতে চাইতাম। ক্লাস ভর্তি হাসির রোল পড়ে যেত। একজন মানুষ কিভাবে এমন রিখতে পারত। সেই পিচ্ছি বয়েসে, সেটা ভেবেই অবাক হতাম।
ইন্টারে ভর্তি হয়ে ক্লাস রুমের পরিবর্তে আমি হয়ে উঠলাম কলেজ লাইব্রেরীর নিয়মিত যাত্রী। সে সময় অজস্র বইয়ের মাঝে হুমায়ূন আহমেদ থেকে খানিকটা বিচ্যুত ঘটলেও, তিনি হৃদয় থেকে মুচে যান নি। সে সময় এমন এক বন্ধুবর শিক্ষকের সান্নিধ্য পেলাম। শ্রদ্ধেয় ঈসমাইল মাহমুদ স্যার। তিনি তিনি আমাকে সন্ধান দিতে লাগলেন। নতুন নতুন বই আর লেখকের। হুমায়ূন স্যারের মৃত্যুর কিছুদিন আগে স্যারের প্রতি এমন আগ্রহ দেখে, ঈসমাইল স্যার আমাকে নিয়ে নুহাশ পল্লীতে যাওয়ার কথা বললেন। কিন্তু, হুমায়ূন স্যারকে আর দেখা হয় নি।
বাংলার অজস্র তরুণ তরুণী সহ সকল বয়েসের মানুষকে যিনি বইমুখী করেছেন। তার হাত তৈরী হয়েছে হিমু, মিসির আলি আর শুভ্র'রা।
বাকের ভাই এর মত চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন। একটা চরিত্রের জন্য ফাঁসি রুখতে দর্শকের মিছিল করার মত ঘটনা পৃথিবীতে বিরল।
তার হাতে তৈরী হয়েছে ঘেটু পুত্র কমলা'র মত বিখ্যাত চলচ্চিত্র।
প্রত্যেক বাংলাদেশী এবং বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে স্যারের জোছনা ও জননীর গল্প এবং দেয়াল উপন্যাস দুটি পড়া প্রয়োজন। তিনি কতখানি রাজনীতি এবং রাষ্ট্র সচেতন ছিলেন, সেটা বুঝতে পারা যায় তার উক্ত রচনাদ্বয়ে।
এখনো, প্রতিটি বইমেলায় এক জোড়া, এক জোড়া করে। আমার মত লক্ষ লক্ষ জোড়া চোখ খোঁজে হুমায়ূর স্যারকে।
এখনো, নিমফুল ফোটে রয় সবুজ সাথী'দের পথ চেয়ে উড়ে যায় বকপঙ্খী এই মেঘ এই রৌদ্রে। কোথাও কেউ নেই জেনেও তারা তিন জন হেঁটে যায় নক্ষত্রের রাতে।
শুভ জন্মদিন হুমায়ূন আহমেদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৫৪