‘সর্বজনীন’ শুদ্ধ। ‘সার্বজনীন’ গ্রাহ্য। গঠন – সর্ব + জন = সর্বজন + ঈন = সর্বজনীন। অর্থ – সকলের জন্য (কৃত, উদ্দিষ্ট, অনুষ্ঠিত, উপযোগী)। ‘ঈন’ একটি প্রত্যয়, সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয়। কেউ কেউ বলেন, ‘ঈন’ প্রত্যয় যোগ হলে শব্দের আদ্যস্বরের বৃদ্ধি হয় না। তাই সর্বজন + ঈন = সর্বজনীন শুদ্ধ, সার্বজনীন ভুল। কিন্তু এ ধারণা অপূর্ণ। কেননা সংস্কৃত ‘ঈন’ প্রত্যয় একটি নয়, দুটি। একটি যোগ হলে আদ্যস্বরের বৃদ্ধি হয় না, আরটিতে হয়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’-এ ৮৭টি সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয়ের তালিকা দিয়েছেন। তাতে ‘ঈন’ দু বার, ৩৬ ও ৩৭ নম্বরে। হুবহু উদ্ধৃত করি:
[৩৬] “-ঈন” [১] [খ]: “কুল—কুলীন; সর্বজনীন, বিশ্বজনীন”।
[৩৭] “-ঈন” [২] [খঞ]: “সার্বজনীন, বৈশ্বজনীন”।
মৃত সংস্কৃত ভাষার কবরে এই দুই ‘ঈন’-এর অর্থগত সূক্ষ্ম কোনো পার্থক্য ঢাকা পড়ে থাকলে থাকতেও পারে, তবে খোঁড়াখুঁড়ি করে কেউ তা উদ্ধার করেছেন বলে শুনি নি। অনুমান করি, পার্থক্যটা ‘দ্বারা’ ও ‘জন্য’-এর মতো কিছু। আসলে আমাদের দরকার হলো ‘সর্বজন’-এর বিশেষণ বানানো। ‘সর্বজনীন’ বললে সেটি হয়ে যাচ্ছে। অতএব ‘সার্বজনীন’ বলে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। এ কারণেই অধিকাংশ আধুনিক অভিধানে ‘সার্বজনীন’ শব্দটি নেই, আছে সর্বজনীন। কোনো কোনো অভিধানে ‘সর্বজনীন’-এর একই ভুক্তিতে ‘সর্বজনহিতকর’ ও ‘বারোয়ারি’ এই দুই অর্থ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা এ দ্বিবিধ অর্থেই ‘সর্বজনীন’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারি। কিংবা অন্যভাবে বানাতে পারি বিশেষণ, যেমন: সার্বজন, সার্বজনিক (এখানে আদ্যস্বরে বৃদ্ধি জরুরি)। আধুনিক বাঙলায় ‘বৈশ্বজনীন’ শব্দটি কাউকে লিখতে দেখি না, ‘বিশ্বজনীন’-এর চেয়ে তার অর্থবৃদ্ধি বা অর্থভেদ কোনখানে তা নিয়েও তর্ক করতে দেখি না। তেমনি যাঁরা ‘আভ্যন্তরীণ’ লেখেন তাঁরা ‘অভ্যন্তরীণ’-এর বেশি কী বোঝাতে চান কখনো খোলাসা করেন না। খামাখাই ঝামেলা বাড়ান ‘সার্বজনীন’ টেনে। এই ঝামেলা দূর হোক। “সর্বজনীন” সকলের হোক!