somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবরের খবর

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবরে সমাহিত লাশে পুনরায় প্রাণ দেওয়া হবে, মুনকার-নাকীর এসে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, শুদ্ধ উত্তর দিলে কবরবাসীর শান্তি আর ভুল বললে শাস্তি – এসব কথা মুসলিমগণ বিশ্বাস করেন। বিশ্বাসটা কি শুদ্ধ? শুদ্ধ হলে কোন্ পর্যায়ের? অস্বীকার করলে কী সমস্যা? আমি এ নিয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে অনুরুদ্ধ হয়েছি। ফাতওয়া নয়, সংক্ষেপে আমার চিন্তা ও সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করতে চাইছি।

কবরে মানুষ জীবিত থাকে, কর্ম অনুযায়ী শান্তি বা শাস্তি পায় – এ বিশ্বাসটি ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসাবলির অন্তর্গত নয়। ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস্য বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে পবিত্র কুরআনে বিবৃত হয়েছে। তাতে ‘কবর’ সম্পর্কে কিছুই বলা হয় নি। এমনকি কুরআনে ‘কবর’ শব্দটিরই উল্লেখ নেই। তবে ‘বরযখ’-এর কথা আছে। ‘বরযখ’ হলো মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মাঝখানের অপেক্ষার সময়। যে পরকালে বিশ্বাস করে, তার পক্ষে ‘বরযখ’ অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তবে কবরের জীবন ও সেখানকার শ্রুত ঘটনাবলি অস্বীকার করা সম্ভব। তবু অস্বীকার করা উচিত নয়। কেননা কুরআনে কবরজীবন স্বীকার করবার পক্ষে অস্পষ্ট কিছু ইঙ্গিত এবং হাদীসে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও কেউ অস্বীকার করলে তাকে কাফির বলা যাবে না – এটা মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। এর কারণ, কবরজীবনে বিশ্বাস স্থাপন আকীদার ব্যাপার। কিন্তু হাদীস (খবর-ই ওয়াহিদ) দ্বারা আকীদা সাব্যস্ত করা যায় না।

কবরজীবন সম্পর্কে সংশয়ের কারণ আছে। এই বিশ্বাস আপাতচোখে অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক এবং অন্যায্য। বলা হয়েছে, কবরে পুণ্যবান ব্যক্তি পুরস্কৃত ও সম্মানিত হবে, পাপীকে দেওয়া হবে কঠিন সাজা। অথচ পাপ-পুণ্যের বিচারের জন্যে ‘বিচার-দিবস’ প্রতিশ্রুত ও নির্ধারিত। আর কবরের সময়টা বিচারের আগের সময়। বিচারের আগেই পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান সঙ্গত নয়। যদি একে সঙ্গত বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে তার অর্থ হবে ‘বিচার-দিবস’ নিছক একটা অর্থহীন প্রয়োজনহীন আনুষ্ঠানিকতা। এভাবে আরো নানা দিক থেকে নানা আপত্তি তোলার অবকাশ আছে। অবশ্য শরীয়ার ‘অকাট্য প্রমাণ’ থাকলে যৌক্তিক কিংবা কোনো রকম আপত্তি-সংশয়ের সুযোগ থাকত না।

কবরজীবনের পক্ষে কুরআনে দূরবর্তী কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায় সূরা ইবরাহীমের ২৭, সূরা আনয়ামের ৯৩, সূরা মুমিনের ৪৬, সূরা তাওবার ১০১ প্রভৃতি আয়াতে। কিন্তু পরোক্ষতা, প্রাসঙ্গিক দূরত্ব ও বিবিধ ব্যাখ্যার অবকাশের কারণে এগুলো ‘অকাট্য প্রমাণ’ উপস্থিত করে না।

কবরে শাস্তি ও পুরস্কার-বিষয়ে বহু হাদীস রয়েছে। পূর্ণ উদ্ধৃতি দিলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে। তাছাড়া এ হাদীসগুলি এত বেশি বেশি পঠিত ও আলোচিত যে, কোনো-না-কোনো সময়ে প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তিরই এগুলো কমবেশি জানাশোনা হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে সংক্ষেপে দুয়েকটি উল্লেখ করব।
বুখারী-মুসলিমে উদ্ধৃত: একবার নবী (সা.) দুটি কবরের ধার দিয়ে যাচ্ছিলেন। বললেন, এই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এদের একজন চোগলখোরি করত, অন্যজন প্রস্রাব থেকে সতর্ক থাকত না।
মুসলিম শরীফে বর্ণিত: হযরত আয়েশা (রা.) রাসূল (সা.)-কে কবরের আযাব সত্য কি না জিজ্ঞেস করলে তিনি হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলেন।
বুখারীতে আছে: এক বিকেলে রাসূল (সা.) হাঁটতে বেরিয়ে আওয়াজ শুনলেন। বললেন, এক ইহুদিকে কবরে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এ তারই আওয়াজ।
আরো কিছু হাদীসে বলা হয়েছে: কবরে পাপীদেরকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। সর্প-দংশনের শাস্তি। আগুনে পোড়ানোর শাস্তি। অন্ধ ও বধির ফেরেশতা তাদেরকে লোহার মুগুর দিয়ে এমন প্রহার করবে, যে প্রহারে পাহাড় চূর্ণ হয়ে ধুলোয় মিশে যেত। তারা বিকট চিৎকার করবে। মানুষ ও জ্বীন ছাড়া আর সকল প্রাণী তাদের চিৎকার শুনতে পায়। এই চিৎকার এবং মানুষ ও জ্বীন ছাড়া আর সকলের তা শুনতে পাওয়ার কথাটি পুনরাবৃত্ত হয়েছে অনেক অনেক হাদীসে। এছাড়া, রাসূল (সা.) প্রায়ই তাঁর সাহাবিদেরকে কবরের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ প্রার্থনা করতে বলতেন। বলতেন, কবরের ঘটনা ঘটা শুরু হয়ে যায় দাফনের সঙ্গে সঙ্গেই, যখন সমাহিত ব্যক্তি প্রস্থানরত দাফনকারীদের জুতোর শব্দও শুনতে পায়।

এ সংক্রান্ত সমস্ত হাদীস একত্র করা কঠিন কাজ। তারপর এগুলোর ভিত্তি, সূত্র ও গ্রহণযোগ্যতা বিশ্লেষণ আরো শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। কবরের প্রশ্নোত্তর ও শান্তি-শাস্তির এসব সরল বর্ণনা আক্ষরিক অর্থেই মেনে নিতে পারলে সেটাই নিরাপদ ও আরামদায়ক। অধিকন্তু, কারো কারো মতে বর্ণনার আধিক্যের কারণে এ বিষয়ক সব হাদীস সার্বিকভাবে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এতে বর্ণনাগুলো হুবহু মেনে নেওয়ার তাগিদ আরো বেড়ে যায়।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে। একদিকে দ্ব্যর্থহীন ও অকাট্য প্রমাণের অভাব, অন্যদিকে যুক্তি ও বাস্তববুদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যের অভাবে কবরজীবনের বাস্তবতা ও ধরন নিয়ে তর্ক চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। শৈশব থেকেই শুনে আসছি— ‘কাফির ও পাপীদের কবরে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, সুড়ঙ্গ খুঁড়ে দেওয়া হয় জাহান্নামের সঙ্গে।’ প্রশ্ন করেছি, ‘এই আগুন কি সত্যিকারের আগুন?’ “হ্যাঁ।” ‘মাটিতে সমাহিত না হলে কী হবে?’ “দেহ যেখানে থাকবে সেটাই কবর।” ‘তা হলে, কাফির বা গোনাহগার ব্যক্তিকে যদি বাঘে খায়, তার কবর হবে বাঘের পেট। বাঘের পেটে জাহান্নামের আগুন জ্বালালে বাঘ তো পুড়ে মরার কথা। এমন কি কখনো ঘটতে শোনা গেছে?’ – আর জবাব পাই নি। এ বিতর্কে যখন জড়াই, তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর। সেই থেকে প্রশ্ন আছে, প্রশ্ন জমছে, প্রশ্ন বাড়ছে – কিন্তু জিজ্ঞেস করে কাউকে বিব্রত করা কিংবা তর্কে জড়ানোর প্রবণতা দিন দিন গিয়েছে কমে।

আজকের যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান, যুক্তি, প্রত্নতত্ত্ব প্রভৃতি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের বহু নতুন মাপকাঠি। কবরের শাস্তির বর্ণনাগুলোও বিজ্ঞান দিয়ে অনেকখানি যাচাই করা সম্ভব। বার বার বলা হয়েছে, কঠিন শাস্তির ফলে কবরবাসী এমন বিকট চিৎকার করে, যা মানুষ ও জ্বীন ছাড়া বাকি সবাই শুনতে পায়। এই বর্ণনাটা ভালোমতো পরীক্ষা করা সম্ভব। আমরা জানি, মানুষের শোনার ক্ষমতার সীমা হলো সেকেন্ডে বারো থেকে কুড়ি হাজার কম্পাঙ্কের শব্দ। এর কম কম্পাঙ্কের শব্দ আমাদের কানে পৌঁছয় না, আর এর বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ আমাদের শ্রবণসীমার বাইরে দিয়ে যায় যাকে আমরা বলি “আলট্রাসোনিক সাউন্ড”। কিন্তু কানে শুনতে না পেলেও আলট্রাসোনিক শব্দ যন্ত্রে ধারণ করা সম্ভব এবং সেই শব্দ বৈজ্ঞানিক উপায়ে নামিয়ে এনে শ্রবণ করাও সম্ভব। বাঁদুড় যে আলট্রাসোনিক শব্দের সাহায্যে ওড়ে, সেটিও এভাবেই উদ্ভাবন করা হয়েছে। আমার জানামতে, কবর নিয়ে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোথাও হয় নি, কিন্তু হওয়া দরকার। হাতে কম্পাস থাকলে উত্তর-দক্ষিণ চেনার জন্যে পূর্বপুরুষদের সত্যায়িত বিবরণ অনুসন্ধানের কোনো মানে নেই।

আমার গ্রামের গোরস্থানে গরু-ছাগল চরানো হতো। ছোটবেলায় আমি বহুবার নিবিড়ভাবে সেই গরু-ছাগলদের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। না, মুগুরের বাড়ি খেয়ে কবরবাসীর চিৎকারে কোনো গরুকে লাফাতে দেখি নি, দড়ি ছিঁড়ে পালাতে দেখি নি।

ফলে ধরে নিয়েছি, কবরে কেবল লাশ পড়ে থাকে, লাশ পচে যায়, লাশের হাড়গোড় দিনে দিনে মাটিতে মিশে যায় – এছাড়া আর কিছুই হয় না। মৃত্যুর পরে পুণ্যবানের আত্মা যায় ঊর্ধ্বলোকে (ইল্লিয়্যূন), আর পাপীর আত্মা নিক্ষিপ্ত হয় অলৌকিক কারাগারে (সিজ্জীন)।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×