বিশ্বমানবতার শান্তির বারতা নিয়ে এসেছে ইসলাম, শুধু মুসলমানদের নয়; তেমনি ইমলামের নবীও শুধু মুসলমানের নবী নন, তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের। তাই তাঁর কর্মনীতি ও দয়াশীলতার বিস্তারও ছিল যথার্থই সর্বজনীন। ভেবে দেখুন সেই মূর্তিপূজক বেদুইনের কাণ্ড, যে মসজিদে নববীর ভেতরে প্রশ্রাব করতে শুরু করেছিল। সবাই হতভম্ব। ওমর উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দয়ার আদর্শ নিয়ে যিনি এসেছিলেন, তিনি বললেন— 'থামো! ওকে প্রশ্রাব শেষ করতে দাও।' অতঃপর রাসূল নিজে পানি ঢেলে মসজিদ ধুয়ে দিলেন। তিনি লোকটিকে বুঝিয়ে বললেন কেন তার এ কাজ ঠিক হয় নি; এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন। বেদুইন তাতে খুশি হয়ে বলল: 'হে আল্লাহ! আমাকে ও মুহাম্মাদকে অনুগ্রহ করুন, আমাদের ছাড়া অন্য কাউকে নয়।' তার এ অম্ভুত দুয়া শুনেও রাসূল তাকে ভর্ৎসনা করলেন না। একজন স্নেহশীল অভিভাবক ও প্রজ্ঞাবান শিক্ষকের মতো শুধু এটুকুই বললেন — 'ব্যাপক বিস্তৃত একটা বিষয়কে তুমি সঙ্কীর্ণ করে দিলে।' (সহীহ বুখারী-৬০১০।)
মহানবীর এ উদার জীবনদর্শনই মানুষকে ইসলামের দিকে আকর্ষণ করেছে, সত্যবোধ জাগিয়ে তুলেছে। সেই বেদুইনের কথাও হাদীসে এসেছে, যে খোলা তরবারি নিয়ে রাসূলের ওপর চড়াও হয়েছিল যখন তিনি গাছের ছায়ায় একাকী ঘুমুচ্ছিলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূলের হাতে সে কাবু হয়ে যায় এবং আত্মসমর্পন করে। তিনি তাকে হত্যা করতে পারতেন, বন্দি করে নিয়ে যেতে পারতেন, ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করতে পারতেন — কিন্তু দয়ার নবী সেসব কিছুই করলেন না। শুধুই দয়া করলেন। নিঃশর্তে ক্ষমা করে দিলেন। পরে লোকটি স্বেচ্ছায় মুসলমান হয়ে ইসলামপ্রচারে আত্মনিয়োগ করে এবং অনেক মানুষ তার হাতেই ইসলামের দীক্ষা নেয়। (সহীহ বুখারী-২৯১০।)
এমনিভাবে ইহুদি পণ্ডিত যায়েদ ইবনে সাইয়া, যে মহানবীকে যাচাই করবার ফন্দি নিয়ে এসেছিল। নবী তাকে শুধু ক্ষমাই করেন নি, ওমরকে বললেন— 'ওকে কিছু পুরস্কার দাও।'
আবূ হুরায়রা বলেন: রাসূলকে বলা হলো, 'হে আল্লাহর রাসূল! মুশরিকদের বিরুদ্ধে দুয়া করুন।' জবাব দিলেন: 'আমাকে কারও অমঙ্গল কামনার জন্যে পাঠানো হয় নি। পাঠানো হয়েছে জগতের রহমত হিসেবে।' (সহীহ মুসলিম-২৫৯৯।)
তায়েফের মর্মান্তিক ঘটনা সবাই জানি। তিনি তো সেখানে আল্লাহর কথা বলতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত করে দেয়া হলো। আল্লাহর আদেশে পাহাড়ের ফেরেশতা এসে বললেন— 'আদেশ করুন, দু পাহাড় এক করে এদের পিষে ফেলি।' নবী বললেন— 'না, এদের পরপ্রজন্ম তো ইসলাম গ্রহণ করতে পারে।' (সহীহ বুখারী-৩২৩১।)
এই হলো ইসলামের প্রেম ও মানবদর্শন। আজ ইসলামকে প্রতিক্রিয়াশীল বলা হচ্ছে, অথচ কুরআন-সুন্নাহর কোথাও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াকে প্রশ্রয় দেয়া হয় নি, বারণ করা হয়েছে। যে-নবী অমুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে গিয়েছেন, তাঁর উম্মত কী করে সাম্প্রদায়িক হতে পারে! ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন, সর্বপ্রথম মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রেই সংখ্যালঘুরা সমান রাষ্ট্রীয় সুযোগ ও মর্যাদা পেয়েছিল। আজ তাঁর উত্তরসূরীরা সংখ্যালঘু নির্যাতনের অপবাদ মাথায় নিয়ে বেড়াচ্ছে। এর কারণ, আমরা মহানবীর দয়াদর্শন থেকে ছিটকে পড়েছি। আমদানি করা অপসংস্কৃতির রং মেখে সঙ্ সেজেছি, ভুলে গেছি আমাদের আসল আত্মপরিচয়।