বাঙলাদেশের আলিম সমাজে নানা বিষয়ে বহু পণ্ডিত ব্যক্তি আছেন। কেউ ফিকহ শাস্ত্রে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন, কেউ তাফসীর শাস্ত্রে অসাধারণ প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখেছেন, কেউ হাদীস শাস্ত্রে স্মরণীয় খিদমাত আঞ্জাম দিয়ে গিয়েছেন, কেউ বা আবার আরবী-বাঙলা, বাঙলা-আরবী ও উর্দু-বাঙলা অভিধান রচনার মতো কঠিন কাজে সফল হয়ে বিরল সম্মানের অধিকারী হয়েছেন – কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে কীর্তিমানদের মধ্যে আজকাল একজন আলিমও খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা বড় বেশি আকাবিরভক্ত, কিন্তু তাঁদেরকে আমরা অনুসরণ করতে পারি নি, পারছি না। ভারত ও পাকিস্তান দু দেশেরই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন আলিমগণ। উর্দু সাহিত্যের অধিকাংশ লেখকই আলিম। ওই দু দেশের জাতীয় সংস্কৃতিতে আলিমদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু বাঙলাদেশে ঘটেছে ঠিক এর উলটোটি। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে আলিমরা যেমন নেতৃত্ব দিতে পারেন নি, তেমনি জাতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিতে মুখ্য স্থান দখল করতে পারেন নি। নতুনদের মধ্যে কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও তা খুবই ক্ষীণ। মাদরাসার পাঠ্যসূচি এখনো মূলত বিভাষী, এমনকী শিক্ষার উচ্চস্তরেও বাঙলা শেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। জাতির মেধা ও মননকে প্রভাবিত করতে না পারলে মিছিল করে লাভ কী? দফা দিয়ে কি কোথাও ইসলাম-প্রতিষ্ঠা হয়েছে?
কাজী নজরুল ইসলাম এ বিষয়টি গভীর বেদনার সঙ্গে উপলব্ধি করেছিলেন। ধর্মীয় ভাষা হিসেবে আরবী ও অন্যান্য বিদেশি ভাষা শেখার গুরুত্ব তিনি স্বীকার করতেন, তবে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় মাতৃভাষায় দক্ষতা ছাড়া সমস্ত পাণ্ডিত্যই যে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে, তা-ও স্পষ্ট করে বলতেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম অ্যাডুকেশন সোসাইটির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতির অভিভাষণে নজরুল এই কথাটাই বড় জোর দিয়ে বলেছিলেন। বলেছিলেন:
"“কোনো মুসলমান যদি তার ইতিহাস ধর্মশাস্ত্র কোনো কিছু জানতে চায়, তাহলে তাকে আরবি-ফার্সি বা উর্দুর দেওয়াল টপকাবার জন্য আগে ভাল করে কসরৎ শিখতে হবে। ইংরেজি ভাষায় ইসলামের ফিরিঙ্গি রূপ দেখতে হবে। কিন্তু সাধারণ মুসলমান বাঙলাও ভাল করে শেখে না, তার আবার আরবি-ফার্সি; কাজেই ন’ মণ তেলও আসে না, রাধাও নাচে না।”"