ওরে কলাবেরী, ওরে কলাবেরী। একটানা সুর করে গেয়ে যাচ্ছে। হোটেলে কেউ এসে চা-সিঙ্গাড়া চাইলে নিজ মনে দিয়ে যাচ্ছে। আর মুখে সেই কথা- "ওরে কলাবেরী, ওরে কলাবেরী"। কদিন থেকে বেশ ভাব জমে উঠেছে ওর সাথে। নিয়মিত আসি তাই চিনতে অসুবিধা হয়না।
আসলেই "কী লাগবে"?
তারপর আবার সেই "ওরে করাবেরী"।
গতকাল জিজ্ঞাসা করলাম-তুই রোজ একটা গানের একটাই লাইন গাইতে থাকিস কেন?
আমি আর বেশি জানি না।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে ছবি তুলতে চাইলে দেখলাম প্রচন্ড অনীহা।
উৎসুক হয়ে বললাম কেনরে, কেন ছবি তুলতে দিবিনা?
কাইল বালা গেজ্ঞি পইরা আইতাম তখন ছবি তুইলেন। বললাম ঠিকআছে। আজ যখন ছবি তুলতে চাইলাম প্লেট-গ্লাস নিয়ে ছবি তুলতে নারাজ। নিজের স্বাভাবিক অবস্থান মানুষের কাছে হয়তো কখনো তৃপ্তিদায়ক হতে পারেনা-তার একটা প্রমাণ পেলাম। ছবি তুলতে গিয়ে দেখি সঙ্গে আরেকজন নিয়ে এসেছে। বললাম তোর নামতো জানা হয়নি।
বাপ্পী দাস। হেইটা হুজুর। বললাম-স্কুলে যেতে ইচ্ছে করেনা? কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু একটু হাসলো।
আর কিছু বললাম না। কিন্তু এর সমন্ধে যা যা ধারণা করে নেওয়া যায় তা হলোঃ বয়স ৮-১০ বছর হবে। বাড়ীতে উপার্জনক্ষম এমন কেউ নেই যে তাকে স্কুল যাওয়ার খরচ দিতে পারে, তাই তার এই পথে আসা। ভাবলাম শুধু বাপ্পী দাস নয় দেশে এই রকম হাজার-হাজার শিশু রয়েছে যারা শুধু অর্থাভাবে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে।
একটা সময় ছিল যখন নিজের কোনো কিছু পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে খুব হিসাব করতাম। কোনো হিসাবই অনুকুলে হতো না। ভাবতাম আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে কিছুই পাইনি। বিষয়টা খুব অমুলক নয়। যাদের সাথে স্কুলে বা পাড়ায় বড় হয়েছি তাদের দিকে তাকালে নিজেকে কেমন অচেনা মনে হতো। সবসময় উপর দিকে চেয়ে দেখেছি। হয়তো কখনো নিচ দিক দেখা হয়নি। অথচ মানুষের জীবন সমান্তরালে চলেনা। প্রতিনিয়ত পট পরিবর্তিত হয়। কখনো সুখ, কখনো দুঃখ, হাসি-কান্না এসব নিয়েই আমাদের জীবন। বুঝলাম আজ আবার নতুন করে ভাবতে হতে। পাইনি পাইনি করে অনেক পেয়েছি। যা পেয়েছি তার চেয়ে বেশি পেতে পারতাম। হয়তো পরিশ্রম করিনি। মানুষ জীবনটা স্বচ্ছ হয়ে উঠে মুলতঃ মেধা আর পরিশ্রমে। একটা একটু কম থাকলে অন্যটা বাড়িয়ে নিতে হয়। আমার কোনোটাই ছিলনা। তাই নিজের অপ্রাপ্তির জন্য কেউ দায়ী নয়। দায়ী আমি। সব ভাবনা শেষ কথা এটাই।
বাপ্পীর মত আমারও আজ একটা গানের একটাই লাইন গাইতে ইচ্ছে করছে "কখনো চেনা ভিড়ে একা লাগে নিজেকে"।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১২ রাত ৮:২৭